প্যারিস থেকে রূপপুর রামপাল

গত ৩০ নভেম্বর প্যারিসে জলবায়ু সম্মেলন শুরুর প্রাক্কালে নিউইয়র্ক টাইমস বলেছিল, ‘আগের দুটো সম্মেলনের মতো প্যারিসেও যদি আলোচনা ব্যর্থ হয় তাহলে সব দেশ সেই পথে যাত্রা অব্যাহত রাখবে, বিজ্ঞানীরা যার সম্পর্কে বারবার সতর্ক করছেন—সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি, আরও ঘন ঘন বন্যা, খরা পরিস্থিতির অবনতি, খাদ্য ও পানির ঘাটতি, ধ্বংসাত্মক ঘূর্ণিঝড়সহ ভয়ংকর প্রাকৃতিক দুর্যোগ।’ একই দিন ইকোনমিস্ট ভবিষ্যদ্বাণী দিয়েছিল, ‘প্যারিসে আসলে কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষী বৈশ্বিক চুক্তিই স্বাক্ষর হবে না। তবে সম্মেলনে যা কিছু দলিলপত্র তৈরি হবে সেগুলোই উল্লেখযোগ্য অর্জন বলে প্রশংসা পেতে থাকবে।’
সংশয় ছিল সবারই। এর কারণও সবাই জানেন। ক্ষমতাবানেরাই যখন অপরাধী তখন তাদের নেতৃত্বে কতটুকু আর অগ্রসর হওয়া যায়? চাপ দিয়ে যতটুকু পারা যায়। চাপ বা জন-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অবশ্য কিছু কাজ হয়েছে, উত্তর আমেরিকা ইউরোপে ‘উন্নয়ন’ নামের পরিবেশবিধ্বংসী তৎপরতা চালানো এখন সহজ নয়। এসব দেশ ছাড়াও জাতিসংঘের আওতায় বহু ধারা যুক্ত হয়েছে, নানা উদ্যোগ জন্ম নিয়েছে। তবে যেসব বহুজাতিক কোম্পানি এসব দেশের ক্ষমতা নিয়ে দীর্ঘদিন পরিবেশবিধ্বংসী তৎপরতায় লিপ্ত তাদের জন্য এখন দুনিয়া খুলে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ যখন বলে আমরা তো বেশি কার্বন-নিঃসরণমুখী উন্নয়ন করিনি, এখন আমাদের সেই সুযোগ দিতে হবে, তখন প্রসন্ন হয় সেই একই ব্যবসায়িক গোষ্ঠী। চীন নিজ দেশে এখন উন্নয়নের ধরনে কয়লাকেন্দ্রিকতা কমাচ্ছে, কিন্তু বাড়াচ্ছে আফ্রিকায়। ভারত যে বাংলাদেশে ও আফ্রিকায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বেশি উৎসাহী তার অন্যতম কারণ নিজ দেশে কার্বন-নিঃসরণের মাত্রা বিশ্বকে কম দেখানো। কিন্তু বিশ্ব, সমুদ্র, নদী, বায়ুমণ্ডল সব তো অভিন্ন, যেখানেই ক্ষতি হোক না কেন তা সবার কাছেই গিয়ে পৌঁছায়।
প্যারিস চুক্তির মধ্যে সবাইকে বিশেষত ক্ষমতাধর অপরাধীদের সন্তুষ্ট করতে গিয়ে বহু রকম ফাঁকফোকর রাখা হয়েছে। কার্বন নির্গমন হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা এই সম্মেলনের ‘ঐতিহাসিক অর্জন’ হলেও তার জন্য কোনো আইনগত বাধ্যবাধকতা রাখা হয়নি। নিজ নিজ দেশে কে কতটা লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করবেন, তা ২২ এপ্রিল ২০১৬ থেকে ২১ এপ্রিল ২০১৭ পর্যন্ত সময়ে জানা যাবে। তবে সম্মেলনে বিভিন্ন দেশ যে মাত্রা ঘোষণা করেছে, তা অব্যাহত থাকলে উষ্ণতা সম্মেলন নির্ধারিত ২ ডিগ্রি থেকে বেশি প্রায় ৩ ডিগ্রি হবে। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ নেই, উপরন্তু তার সুযোগ আছে চুক্তি থেকে বের হয়ে যাওয়ার। উপরন্তু ক্ষতির জন্য দায় নির্ধারণ কিংবা ক্ষতিপূরণ আদায়েরও কোনো সুযোগ রাখা হয়নি।
বিশ্ব উষ্ণায়ন বিপদ এক দিনে তৈরি হয়নি, এর পেছনে তেল, কয়লাসহ জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের উচ্চমাত্রা শুধু নয়, মুনাফাকেন্দ্রিক উৎপাদন ও ভোগের নির্বিচার বৃদ্ধিও যুক্ত। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি উপাদান হলো সমরাস্ত্র খাতের ভয়ংকর বিকাশ। মানুষ ও পরিবেশকে ভয়াবহভাবে খুন করার যাবতীয় আয়োজন হয় এই খাতের প্রয়োজনে, নিত্যনতুন গবেষণা, বিনিয়োগ এবং উত্তেজনা-সংঘাত সৃষ্টির মাধ্যমে। এই খাত কখনোই এসব সম্মেলনে আলোচনায় আসে না। প্যারিস ঘোষণায় জলবায়ু বিপর্যস্ত দেশগুলোকে ১০ হাজার কোটি ডলার অর্থ জোগান দেওয়ার একটা ফাঁকা অনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি আছে। বলা বাহুল্য, এই অর্থের বেশির ভাগ অংশ জোগানদাতা দেশের আমলা, ব্যবসায়ী, কনসালট্যান্ট, গ্রহীতা দেশের সাব কন্ট্রাক্টররাই পাবে, কথিত কাজে যাবে সামান্যই। এই সঙ্গে এই অঙ্কটাও মাথায় রাখা দরকার যে বিশ্বে প্রতিবছর সমরাস্ত্র খাতে খরচ হয় এর ১০ গুণ বা ১০ লাখ কোটি ডলারেরও বেশি অর্থ। যার প্রতিটি টাকা মানুষ ও পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এর সুবিধাভোগী কেবল অস্ত্র ব্যবসায়ী, দখলদার দস্যু আর সন্ত্রাসী রাষ্ট্র ও গোষ্ঠীগুলো।
ফ্যাসিস্ট খুনিদের হাতে নিহত জার্মানির পণ্ডিত বিপ্লবী রোজা লুক্সেমবার্গ ১০০ বছর আগে বিশ্বব্যবস্থা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছিলেন, পঁুজিবাদের অন্তর্গত প্রবণতাই হলো ক্রমাগত নতুন নতুন মুনাফার ক্ষেত্র বের করতে গিয়ে দখল ও ধ্বংসের পথ গ্রহণ করা। এ কারণে অব্যাহত সামরিকীকরণ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার জন্য অনিবার্য। এর ৬০ বছর পর ইউরোপের আরেকজন পণ্ডিত আর্নেস্ট ম্যান্ডেল বিশ্লেষণ করে বলেছেন পঁুজিবাদী বিশ্বব্যবস্থা এখন চিরস্থায়ী সমরাস্ত্র অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। আর সম্প্রতি কানাডার নাওমি ক্লেইন বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার নাম দিয়েছেন ‘ডিজাস্টার ক্যাপিটালিজম’। এই ব্যবস্থার যারা সুবিধাভোগী তাদের দাপট অব্যাহত থাকতে পারলে পরিস্থিতির পরিবর্তন কীভাবে সম্ভব? তারপরও যতটুকু প্রতিশ্রুতি এবং স্বীকারোক্তি আমরা ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ (এসডিজি) সম্মেলন ও জলবায়ু সম্মেলন থেকে পাই, তা বিশ্বে মানুষের জীবনযাপনের সঙিন অবস্থা, ভীতিকর পরিবেশ অবনতি এবং মানুষ-পরিবেশের পক্ষে তাত্ত্বিক কাজ ও আন্দোলনের চাপেই হয়েছে। এর ফলেই নবায়নযোগ্য খাত এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে।
এসব সম্মেলনে উন্নয়ন প্রশ্ন নিয়ে আলোচিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি নয়, জলবায়ু তহবিল পাওয়া নিয়েই বাংলাদেশ সরকারের মনোযোগ বেশি। অন্যদিকে, দেশে তহবিলের অভাবে নয় বরং নিত্যনতুন ঋণ নিয়ে ও বাজেট সরিয়ে তৈরি হচ্ছে এমন সব প্রকল্প, যা জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য ক্ষতির চেয়েও বেশি ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে। জলবায়ু অভিযোজন নিয়ে বহু প্রকল্প দেখছি আমরা। এই দুর্যোগের হাত থেকে উপকূলীয় এলাকার মানুষকে বাঁচানোর কথা বলেও বহু প্রকল্প তৈরি হচ্ছে। কিন্তু একই সময়ে নিজেরা ঋণগ্রস্ত হয়ে সুন্দরবনবিনাশী রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র করা হচ্ছে। এই সুন্দরবনই সব প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে কয়েক কোটি মানুষকে রক্ষা করার প্রাকৃতিক প্রতিরোধব্যবস্থা, যা লাখো কোটি টাকা দিয়েও নির্মাণ করা সম্ভব নয়। এই সুন্দরবন রক্ষার জন্য তহবিলের দরকার নেই, বরং এর ওপর বিনিয়োগ বা অর্থব্যয়ের প্রবণতা কমালেই সুন্দরবন বাঁচে।
বিশাল ঋণ নিয়ে রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বানানোর প্রকল্প নিয়ে সরকার গর্বিত। এ রকম অদক্ষ এবং অরক্ষিত অবস্থায় আর কোনো দেশ কখনো পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বানানোর প্রকল্প নিয়েছে বলে জানা নেই। ষাটের দশকে ছোট্ট একটি পারমাণবিক কেন্দ্র বানানোর জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল, সরকার তার ওপর ভর করেই অগ্রসর হচ্ছে। কিন্তু দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে এর যে নিরাপত্তাবলয় তৈরি করতে হবে, বিশেষজ্ঞদের হিসাব অনুযায়ী, তাতে চারপাশের দেড় কোটি মানুষকে হয় সরাতে হবে নয়তো তারা প্রাত্যহিক নানাবিধ বিপদের ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করবে। দুর্ঘটনার কথা চিন্তা করতেও ভয় হয়, পারমাণবিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়েও সরকারের যে কথাবার্তা তাতে ভরসা পাওয়ার উপায় দেখি না। রাশিয়ান ঋণ, প্রযুক্তি, বিশেষজ্ঞ ও ব্যবস্থাপনায় নির্মিতব্য এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তা নিয়ে যখন রুশ রাষ্ট্রদূত বলেন, এটি এতই নিরাপদ যে এর ওপর বোমা মারলেও এর কোনো ক্ষতি হবে না, এবং যখন সেই কথা মুখস্থ বলতে থাকেন বাংলাদেশের কর্তাব্যক্তিরা, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না আমরা কী রকম বিপদের মধ্যে যাচ্ছি।
দেশে কৃষিজমি, বন উজাড় করে, নদী দখল করে নানা রকম নির্মাণকাজ হচ্ছে। এসব কাজে সরকারই অগ্রণী। সেই পথেই দস্যুদের সদম্ভ দখল তৎপরতা। সরকার দেশে অনেকগুলো ইপিজেড করার উদ্যোগ নিয়েছে। এর জন্য জমি বাছাই ও জমি অধিগ্রহণ-প্রক্রিয়া যে খুবই ত্রুটিপূর্ণ, তা এই মুহূর্তে হবিগঞ্জে চা-শ্রমিকদের প্রতিবাদ থেকেই বোঝা যাচ্ছে। পরিষ্কার দুই ফসলি জমিকে অনাবাদি দেখিয়ে এই প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। যেমন সুন্দরবনকে দেখানো হয়েছিল গ্রামবসতি। মিথ্যা, অস্বচ্ছতা ও প্রতারণার ওপর তো কোনো টেকসই উন্নয়ন হতে পারে না।
বাংলাদেশের ‘উন্নয়ন’ ধরন আসলে মূলধনের আদিম সংবর্ধনের একটি মডেল। আমি আগেও বহুবার বলেছি উন্নয়নের এই ধরন মানুষ ও প্রকৃতিবিদ্বেষী। বন, পাহাড়, নদী, পানি, আবাদি জমি, জীববৈচিত্র্য বিনাশ করে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়াতে আর কিছু লোকের হাতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত করতে এই ধরন উন্মাদনা তৈরি করা হয়েছে। মুনাফামুখী, দখল, লুণ্ঠন ও দুর্নীতি আশ্রয়ী এই ‘উন্নয়ন’ জিডিপি বাড়াতে পারে, স্বল্প মেয়াদে চকচকে দেখাতে পারে কিন্তু এই ধরন, যাকে রাউল প্রেবিশ বলেছিলেন উন্নয়নের ইমিটেশন, তা দীর্ঘ মেয়াদে বিবর্ণ এবং বিপজ্জনক হতে বাধ্য। সে জন্যই একদিকে যখন দেখি প্রতিবছর দেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ৬ শতাংশের বেশি, তখন মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ রয়েছে একদম পেছনের কাতারে, জাতিসংঘের (ইউএনডিপি) মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন ২০১৫ অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান ১৮৮টি দেশের মধ্যে ১৪২তম।
উন্নয়নের ধরনের কারণেই ক্রমবর্ধমান হারে চোরাই টাকার কেন্দ্রীভবন হচ্ছে এবং তা অর্থ পাচার অনিবার্য করে তুলছে। সর্বশেষ আন্তর্জাতিক সমীক্ষা অনুযায়ী বাংলাদেশে বছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ অর্থের সমপরিমাণ বিদেশে পাচার হচ্ছে। ২০১৩ সালে এর পরিমাণ ছিল প্রায় ৭৭ হাজার কোটি টাকা, পরের বছরগুলোতে আরও বাড়ছে। সব তথ্য বিবেচনায় নিলে এর হার আরও বেশি হবে। অনেক বিজ্ঞজন বলেন, দেশে ‘সুশাসনের অভাব’ বলে এই অর্থ দেশে বিনিয়োজিত হতে পারছে না, তাই বাইরে চলে যাচ্ছে! আসলে তথাকথিত ‘সুশাসনের অভাব’ থাকার কারণেই কিছু লোকের হাতে দেশের এই পরিমাণ সম্পদ গিয়ে জমেছে। তাঁরা ÿক্ষমতাবান, যেখানে তাঁদের ভবিষ্যৎ সেখানে তাঁরা এই চোরাই টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছেন। এই দেশ তাঁদের টাকা বানানোর জায়গা, জীবনযাপন বা ভবিষ্যৎ অন্যত্র।
ব্যাংক লুট (ঋণখেলাপি, জালিয়াতি) করে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ, শেয়ারবাজারে প্রতারণা ও প্রভাব বিস্তার, জমি-পাহাড়-নদী-জলাশয় দখল, রাষ্ট্রীয় বৃহৎ প্রকল্পে ২০০ বা ৩০০ শতাংশ বেশি ব্যয়, বিদেশি ঋণে ভোগবিলাসিতা, কমিশনের বিনিময়ে দেশের জন্য সর্বনাশা চুক্তি স্বাক্ষর এগুলো সবই বর্তমান উন্নয়ন মডেলের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যাঁরা শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত, ঋণ নিয়ে যাঁরা বড় বড় খেলাপি, যাঁরা বৃহৎ প্রকল্প থেকে হাজার কোটি টাকা সরাতে পারেন, তাঁরাই তো প্রভাবশালী, ক্ষমতার খঁুটি। তাঁদের স্বার্থ আর বিশ্ব উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী অপরাধীদের স্বার্থ অভিন্ন। বাংলাদেশের বিপদ সেখানেই।

অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।