প্রিন্সেসের সাত মানিক
এখনও পালক গজায়নি। পুরোপুরি দাঁড়াতে গেলে ঢলে পরে। লালচে ছোট্ট ইঁদুরছানা রং। ভোঁতা মুখে চিঁচিঁ করার চেষ্টা। পেছন থেকে দেখলে মনে হয়, পিঠ মোড়া দিয়ে হাত বাঁধা। পাশাপাশি গলাগলি সময় কাটাচ্ছে ওরা। কৃষ্ণকলি চোখে ডাগর চেয়ে পৃথিবীর আলো দেখছে মাত্র কদিন। ওরা সাতটি প্রাণ। প্রিন্সেসের সাত মানিক।
কারও বয়স এক সপ্তাহ। কারও পাঁচদিন। কারও তিনদিন। গাঢ় সবুজ, সোনা ঝরা পালক ফুটেছে যার, তার বয়স সপ্তাহ পার হয়েছে। সে ওদের বড়। বুক দিয়ে ঠেলে ঠেলে সামলে রাখছে ছোটদের। হোক না এক সপ্তাহের,তবুও ছোট-ই তো। অন্যদুটির শরীরে প্রায় সব পালক উঠেছে। তবে সোনা ঝরা চকচকে রং ধারণ করেনি এখনও। তিনটির গায়ে এখনও পশম, যেন সব আবদার ওদের। নেড়া শরীর মাথায় কালো চোখ দুটো চক চক করে তাকিয়ে আছে।
মায়ের অনেক সাধনার ধন এই সাতটি প্রাণ। মামলা মোকদ্দমার পর সাত সাগর আর তের নদী পাড় থেকে ওদের ঔরস আনতে হয়েছে। তাই এত কদর। তাছাড়া একসাথে এত ভাই বোন – এটা বিরল। এমনটির নজির মেলা ভার।
কথাগুলো সেই ম্যাকাও প্রিন্স ও প্রিন্সেসকে নিয়ে। রাজধানির হাতিরপুলে মিনি চিড়িয়াখানায় একে একে সাতটি বাচ্চা ফুটিয়েছে তারা। এক সাথে এমন সাত ম্যাকাও এর বাচ্চার নজির বাংলাদেশে আর নেই। বাংলাদেশ কেন, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন সাতটি বাচ্চা একসাথে ফোটার দৃষ্টান্ত পৃথিবীতেই বিরল।
বহুল আলোচিত প্রিন্সের সাথে ঘর ভাঙ্গার পর, গত বছর জুনে নতুন সঙ্গী আলেকজান্ডারের সাথে প্রিন্সেস আবারও জুঁটি বাঁধে। ডিম দিতে থাকে তারা। কিন্তু বাচ্চার দেখা নেই। এভাবে কেটে যায় পাঁচ পর্ব। পাঁচ পর্বে তেরটি ডিম। কিন্তু একটিতেও বাচ্চা ফোটেনি। শেষমেষ ষষ্ঠ পর্বে সাতটি ডিম। আর একে একে সেই সাত ডিম থেকেই সাত বাচ্চা। ২/১ দিন বিরতির পর সবকটি ডিম থেকে ছানা ফুটেছে। শেষ বাচ্চা ফুটেছে বৃহস্পতিবার। মা ও বাচ্চারা সুস্থ আছে।
ম্যাকাও প্রজাতির পাখি প্রিন্স ও প্রিন্সেস। খুবই দুর্লভ ছিল সেই জুটি। ওদের সংসার ভেঙ্গে যাওয়ার কাহিনী রূপকথার গল্পের মতোই। পাখি দুটির মালিক ছিলেন দুজন। মালিকানা নিয়ে বিরোধের জের ধরে ভেঙে যায় ম্যাকাও দম্পতির সুখের সংসার। ঘটনার শুরু ২০১০ সালে। বিদেশে অবস্থান এবং বাড়ি বদল করায় ইকরাম সেলিম তাঁর পাখিটি আবদুল ওয়াদুদকে উপহার দেন। ড. ওয়াদুদ সেই পাখিটির সঙ্গী খুঁজে আনেন ব্রাজিল থেকে। নাম রাখেন প্রিন্স। তিন বছরের সুখের সংসারে চারবারে ওই দম্পতির পাঁচটি বাচ্চা হয়। তিন বছর পর ইকরাম সেলিম দেশে ফিরে প্রিন্সকে ফেরত চাইলে বাধে জটিলতা। সুখের সংসারে শুরু হয় ঝামেলা। উভয় পক্ষ ছিলেন অনড়। আদালতের নির্দেশে পাখি দুটি আলাদা হয়ে যায়। চলে যায় দুই মালিকের কাছে। গত বছরের ৩রা জানুয়ারির পর থেকেই প্রিন্স ও প্রিন্সেস আলাদা থাকছে। প্রিন্স থাকছে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায়। প্রিন্সেস ২২/২, হাতিরপুল ফিকামলি সেন্টারের মিনি চিড়িয়াখানায়। দুই মালিকই চেষ্টা করেছেন নিজের পাখির বিপরীত লিঙ্গ বিদেশ থেকে এনে জোড় বাঁধতে। মেয়ে পাখি প্রিন্সেসের মালিক ড. আবদুল ওয়াদুদ বিদেশ থেকে আরেকটি পুরুষ পাখি জোগাড় করে আনেন। ওর নাম দেয়া হয় আলেকজান্ডার। প্রথমে সংসার পাততে চায়নি প্রিন্সেস ও আলেকজান্ডার দম্পতি। কিন্তু হাল ছাড়া হয়নি। বেশ কয়েক মাস ঝগড়া-ঝাটির পর ওরা জোড় বাঁধে। কৃত্রিম ঝড় ও বৃষ্টির আবহ তৈরী করা হয়। পরিবেশ সৃষ্টি করা হয় একে অপরকে কাছে ঠেলে দেয়ার। এই অসাধ্য সাধনের এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব তৈরী হয়।
পাখি বিশেষজ্ঞ ড. আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, গত বছর জুনে আলেকজান্ডারের সাথে সঙ্গী হওয়ার পর পাঁচবারে মোট ১৩টি ডিম দেয় তারা। কিন্তু ডিম থেকে একটি বাচ্চাও ফোটেনি। সফল গবেষণার ফলে এবং অধিকতর অনুকূল পরিবেশ তৈরী করায় ষষ্ঠবারে ডিম থেকে এতগুলো বাচ্চা ফুটল। একবারে ম্যাকাও পাখির সাতটি বাচ্চা হওয়ার নজির এই প্রথম বলে দাবি করলেন তিনি।
রং, রূপ সৌন্দর্যের জন্য ম্যাকাও পৃথিবীজুড়ে পাখিপ্রেমিকদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় পোষা পাখি। এটিকে বলা হয় ড্রইং-রুম কেইজ বার্ড। এদের আয়ু ষাট থেকে সত্তর বছর। দক্ষিণ আমেরিকার আমাজান অববাহিকার গভীর জঙ্গলে বড় বড় পাইনগাছে বাসা বাঁধে ম্যাকাও। এরা বিভিন্ন ফল ও বীচি জাতীয় খাবার খায়।