ফুরিয়ে যাওয়া গ্যাসের বিকল্প কত মূল্যে?

জাতীয় সংসদে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গত ২৮ জুন জানিয়েছেন, দেশের জ্বালানি গ্যাসের মজুত বর্তমানে যে হারে উত্তোলিত ও ব্যবহৃত হচ্ছে, তাতে আগামী ১৬ বছরে তা শেষ হয়ে যাবে। দেশে বর্তমানে প্রায় ১৪ দশমিক ১৬ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস মজুত রয়েছে এবং বছরে প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ঘনফুট হারে গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। ফলে ১৬ বছর সময়জুড়ে বিদ্যমান মজুত জোগান দেবে, তা ধরে নেওয়া যায়। তবে মজুত গ্যাসের পুরোটা আহরণ করা যায় না এবং গ্যাসের ব্যবহার ও চাহিদা স্থির অঙ্ক নয়। বর্তমানে দেশের মজুত গ্যাস থেকে প্রতিদিন প্রায় ২ হাজার ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলিত হচ্ছে। উত্তোলিত গ্যাসের সিংহভাগ (৫৮%) বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় করা হয়। এক অর্থে, বর্তমানে দৈনিক উত্তোলনের ক্ষমতা কাজে লাগানোর বিবেচনায় দেশের গ্যাস উৎপাদনের প্রায় সর্বোচ্চ সামর্থ্য ব্যবহৃত হচ্ছে। আগামী দুই-এক বছরের মধ্যেই গ্যাস উত্তোলনের সামর্থ্য হ্রাস পেতে থাকবে এবং পর্যায়ক্রমে সেই সামর্থ্য সংকুচিত হবে। ফলে দেশে গ্যাসের চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ব্যবধান বাড়তে থাকবে (বর্তমানে এ ব্যবধান দৈনিক ৩০০ থেকে ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস)। ২০১৯ সাল নাগাদ গ্যাসের সরবরাহ-ঘাটতি (দেশের উৎপাদন থেকে) দৈনিক প্রায় ১ হাজার ৩৪২ ঘনফুটে উত্তীর্ণ হবে বলে পেট্রোবাংলার অনুমান। ২০৩১ সাল নাগাদ পুরোপুরি নিঃশেষিত না হয়ে দেশের উৎপাদন-কূপগুলো থেকে নগণ্য পরিমাণ গ্যাস উৎপাদন বহাল থাকার কথা।
দেশের সিংহভাগ শিল্পকারখানা, পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলের ব্যবসা, গৃহস্থালি সুবিধাভোগী মানুষ নগণ্য মূল্যে পাইপলাইনে গ্যাস পেতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে (১২% গ্যাস গৃহস্থালি খাতে ব্যবহার হয়)। এ কারণে গ্যাসের ঘাটতি বা সরবরাহে বিঘ্ন ঘটলে চারপাশে হাহাকার রব ওঠে। জ্বালানি খাতের নীতিনির্ধারকেরা দীর্ঘদিন ধরে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করে ক্রমবর্ধমান জ্বালানি গ্যাসের ঘাটতি মেটানোর কথা বলছেন। এ-সংক্রান্ত কাজের বর্তমান অগ্রগতি বিবেচনায় আগামী দুই-তিন বছরেও আমদানি করা তরল গ্যাস পুনরায় গ্যাসে রূপান্তরিত করে দেশের পাইপলাইনে সঞ্চালন করা সম্ভব হবে না। ফলে গৃহস্থালি গ্যাস-সংযোগসহ শিল্পকারখানায় বাড়তি গ্যাস রেশনিং অবধারিত হয়ে উঠছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী সংসদে দেওয়া বক্তব্যে সহজ ভাষায় বলে দিয়েছেন, চাহিদা অনুযায়ী গ্যাসের জোগান না পাওয়ায় গৃহস্থালি কাজে ব্যবহারের জন্য নতুন গ্যাস-সংযোগ বন্ধ করা হবে এবং গ্যাসের অধিকতর মূল্য সংযোজন হয় বলে শিল্পে গ্যাস-সংযোগ অগ্রাধিকার পাবে।
স্থলভাগে নতুন বড় আকৃতির গ্যাসক্ষেত্র খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ বলে দেশের সমুদ্রসীমায় গ্যাস অনুসন্ধানের উপর্যুপরি তাগিদ সত্ত্বেও বড় পরিসরে সে অনুসন্ধান এখনো শুরু করা যায়নি। আগামী শুকনো মৌসুমে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া গেলে এবং কোনো আশাপ্রদ আবিষ্কার সম্ভব হলে সমুদ্র থেকে সে গ্যাস সরবরাহ পাইপলাইনে আসতে ৯ থেকে ১০ বছর লেগে যাবে। আর ব্যয়বহুল এবং ঝুঁকিপূর্ণ এই অনুসন্ধান সফলভাবে কোনো বাণিজ্যিক গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার অবধারিত করবে, এমন গ্যারান্টি নেই। সে কারণে প্রাথমিক জ্বালানির বহুমুখিনতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এবং বিদ্যমান জ্বালানি ব্যবহারে দক্ষতা বাড়ানো দরকার। এ ক্ষেত্রে সচেতনতা বাড়ানো, অপাত্রে ভর্তুকি মূল্যে গ্যাস সরবরাহ না দেওয়া ও জ্বালানি ব্যবহারে দক্ষ প্রযুক্তি ব্যবহারে মনোযোগ দেওয়া খুবই জরুরি।
আমাদের প্রাথমিক জ্বালানি খাতের নাজুক অবস্থা ক্রমেই বেশি বেশি আমদানি করা তেলনির্ভর হয়ে উঠছে। বিদ্যমান প্রবণতা অব্যাহত থাকলে আমদানি করা তেল দিয়ে প্রায় ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন (বর্তমানে ২৯%) অবধারিত হয়ে উঠবে

জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নির্ভার ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, আমদানি করা জ্বালানি দিয়ে দেশের চাহিদা পূরণে সরকার নজর দেবে এবং সরকার এ নিয়ে খুব উদ্বেগে নেই। কেননা, জাপান এবং ইউরোপের অনেক দেশ জ্বালানি আমদানি করেই অর্থনীতির চাহিদা মেটাচ্ছে। তিনি আরও জানিয়েছেন, আগামী তিন বছরের মধ্যে আবাসিক খাতের ৭০ শতাংশ বাসাবাড়িতে পাইপ-গ্যাসের বদলে সিলিন্ডার গ্যাস (এলপিজি) সরবরাহের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
তরলীকৃত গ্যাস আমদানি নিয়ে যে বিস্তর কথা তিন-চার বছর ধরে চলছে, এখনো তা বাস্তবায়নের আবশ্যিক অবকাঠামো নির্মাণের কাজে হাতই দেওয়া হয়নি। পেট্রোবাংলা কেবল একটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন ও দৈনিক ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট পরিমাণ এলএনজি আমদানি করে তা গ্যাসে রূপান্তর ও পাইপলাইনে সরবরাহ করার একটি বাণিজ্যিক বিনিয়োগ চুক্তি এখনো স্বাক্ষর করতে পারেনি। বিদ্যমান আন্তর্জাতিক বাজারদরে এলএনজি আমদানি করে তা দিয়ে স্থানীয় বিদ্যুৎকেন্দ্রে ও অন্যান্য ব্যবহারকারীর ক্রয় সামর্থ্যে কতটুকু সরবরাহ করা যাবে, সেটিও প্রশ্ন। ভারতীয় রিলায়েন্স কোম্পানির আলোচিত মহেশখালীর প্রস্তাবিত আমদানি করা এলএনজি-নির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের মূল্য প্রাথমিক অনুমান অনুযায়ী প্রায় সাড়ে আট টাকা হবে। বর্তমানে দেশে উৎপাদিত গ্যাস দিয়ে উৎপাদিত বিদ্যুতের প্রতি ইউনিটের মূল্য বিবেচনায় তা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেশি।
আমদানি করা কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের মহাপরিকল্পনা নিয়েও বিস্তর কথা হচ্ছে বেশ কয়েক বছর। এ লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকও অনেকগুলো স্বাক্ষর করা হয়েছে। তবে জাপানের সহায়তায় মহেশখালীর ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি (অর্থায়নসহ) ছাড়া আমদানি করা কয়লা দিয়ে বিদ্যুতের অন্য উৎপাদনব্যবস্থার উদ্যোগ এখনো অনির্দিষ্ট। দেশের আবিষ্কৃত কয়লা উত্তোলন নিয়ে অতি রাজনীতির আঁচ আমদানি করা কয়লাভিত্তিক রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন উদ্যোগেও ভালোভাবে লেগেছে। ফলে সম্ভাব্য বিনিয়োগকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা-ব্যাংকগুলো এ প্রকল্পে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে চাইছে না। আমদানি করা কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সে কারণেও দ্রুত, নাটকীয় অগ্রগতি আশা করা যাচ্ছে না।
উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোয় মাথাপ্রতি উচ্চ আয় এবং ক্রয় সামর্থ্যের কারণে আমদানি করা তরল গ্যাস (এলএনজি), তেল, কয়লা ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিভিন্ন উৎসে মনোযোগ দিতে পেরেছে। একই সঙ্গে জাপান এবং ইউরোপের অনেক জ্বালানি আমদানিনির্ভর দেশ তাদের দেশের বিদ্যমান সব উৎসের প্রাকৃতিক জ্বালানিও আহরণ ও ব্যবহার করছে।
আমাদের প্রাথমিক জ্বালানি খাতের নাজুক অবস্থা ক্রমেই বেশি বেশি আমদানি করা তেলনির্ভর হয়ে উঠছে। বিদ্যমান প্রবণতা অব্যাহত থাকলে আমদানি করা তেল দিয়ে প্রায় ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন (বর্তমানে ২৯%) অবধারিত হয়ে উঠবে। আপাতত বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য সহনীয় হলেও বিশেষজ্ঞ অনুমান, কয়েক বছরের মধ্যেই জ্বালানি তেলের বাজার ঊর্ধ্বমুখী হবে। তেমন পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির জন্য আমাদের কত ব্যয় করতে হবে?
ড. মুশফিকুর রহমান: খনি প্রকৌশলী, জ্বালানি ও পরিবেশ-বিষয়ক লেখক।