বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সমুদ্রাঞ্চলের অধিকার
১৯৮২ সালে সমুদ্র আইন যে চুক্তিটি হয়েছিল তাতে রয়েছে ৩২০টি ধারা ১৭টি অধ্যায়ে বিভক্ত এবং ৯টি সংযোজন। এই সমুদ্র আইন চুক্তির ভিত্তিতে সচল উপকূলীয় দেশ তাদের ভেজলাইন থেকে ১২ মাইল আঞ্চলিক সমুদ্র, ২৪ মাইল সন্নিহিত এলাকা, ২০০ মাইল নিজস্ব অর্থনৈতিক এলাকা ও ২০০ মাইল মহিসোপান এলাকা ভোগের অধিকারী। সমুদ্র চুক্তির ৭৬ নম্বর ধারায় বর্ণিত নিয়ম অনুযায়ী উপকূলীয় দেশ মহিসোপানের অধিকার ২০০ মাইলেরও অধিক প্রায় ৩৫০ নৌমাইল পর্যন্ত ভোগ করতে পারবে। তবে এই অতিরিক্ত ১৫০ মাইলের অধিকার পেতে হলে ২১ সদস্যের মহিসোপান কমিশনের কাছে তত্ত্ব ও উপাত্তসহ দাবি জানাতে হবে। তারই প্রেক্ষিতে মিয়ানমার ১৬ ডিসেম্বর ২০০৮, ভারত ১১ এপ্রিল ২০০৯ এবং বাংলাদেশ ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১১ সালে তাদের নিজ নিজ দাবি ঐ কমিশনের কাছে জমা দেয়।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ সরকার আঞ্চলিক সমুদ্র ও সামুদ্রিক অঞ্চল আইন পাস করে। সে আইনের ৯টি ধারায় আঞ্চলিক সমুদ্র সন্নিহিত অঞ্চল, নিজস্ব অর্থনৈতিক এলাকা মহিসোপানের দাবি এবং পরিবেশ সংরক্ষণ নীতিমালা ঘোষিত হয়। সে আইনে শুধু সন্নিহিত এলাকা ৬ মাইল ঘোষণা করা হয় কিন্তু অন্যান্য অঞ্চল চিহ্নিত করা হয়নি। একই বছর এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সকল সামুদ্রিক অঞ্চলের দূরত্ব ঘোষণা করে। যা আঞ্চলিক সমুদ্র ১২ মাইল সন্নিহিত এলাকা, ১৮ মাইল নিজস্ব অর্থনৈতিক এলাকা মহিসোপান ২০০ মাইল ধার্য করা হয়। কিন্তু ভেজলাইন নির্ণয়ের জন্য কোনো ভূখণ্ডকে চিহ্নিত না করে বঙ্গোপসাগরের সন্নিহিত সমুদ্রে যেখানে ৬০ ফিট গভীরতা সে জায়গায় ৮টি পয়েন্ট ধার্য করে ভেজলাইন নির্ধারণ করে। এই পদ্ধতিকে বলা হয়, গভীরতা নীতি যা বিশ্বের অন্য কোনো দেশ গ্রহণ করেনি। অথচ ১৯৫১ সালে আন্তর্জাতিক আদালতে যুক্তরাজ্য বনাম নরওয়ের ভেজলাইন নির্ণয়ের একটি পদ্ধতি প্রেরণ করে। যা প্রথম থেকেই যুক্তরাজ্য অস্বীকার করে আসছে। উল্লেখ্য যে, নরওয়ের তীরভূমি কিন্তু স্বাভাবিক নয়। সমুদ্রের কাছাকাছি অনেকগুলো ছোট ছোট খাড়া পাহাড়কে চিহ্নিত করে তাদের ভেজলাইন নির্ণয় করে। যা তীরবর্তী এলাকা থেকে ৫০ মাইল দূরে অবস্থান করে। যেহেতু শত শত বছর ধরে নরওয়েজিও মাত্স্যজীবীরা ঐ অঞ্চলে মত্স্য আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করছে তাই যুক্তরাজ্যের মত্স্য জাহাজও ঐ অঞ্চলে প্রবেশ করতে চাইলে নরওয়ের সঙ্গে বিরোধের সৃষ্টি হয়। ১৯৩৫ সালের ঘোষিত নরওয়ের ঐ ভেজলাইন পদ্ধতি গ্রহণ করে আসছিল তা যুক্তরাজ্য কখনো প্রতিবাদ জানায়নি। হঠাত্ করে ১৯৪৭ সালে আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হয় এবং আদালত ন্যায্যতার ভিত্তিতে (ইকুইটি) নরওয়ের পক্ষে রায় দেয়।
যেহেতু, বাংলাদেশ ১৯৭৪ সালের আইনে অপ্রচলিত গভীরতার ভিত্তিতে ভেজলাইন নির্ধারণ করে ঘোষণা করায় পার্শ্ববর্তী দুটি দেশ ভারত ও মিয়ানমার প্রথমে প্রবল আপত্তি জানায়। এটাও ঠিক যে, ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘ সমুদ্র আইন সম্মেলনের কোনো অধিবেশনেই বাংলাদেশের এই অপ্রচলিত ভেজলাইন পদ্ধতি গ্রহণীয় হয়নি।
যা হোক, বাংলাদেশ ১৯৭৪ সালে ৬টি বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে বঙ্গোপসাগরের তেল, গ্যাস উত্তোলনের জন্য ব্লক চিহ্নিত করে প্রডাকশন উত্তোলন চুক্তি (পিএসসি) স্বাক্ষর করে। যেহেতু ভারত ও মিয়ানমার ১৯৭৪ সাল থেকে আমাদের ভেজলাইন নির্ধারণ পদ্ধতির আপত্তি জানিয়ে আলোচনা শুরু করে এবং যার কারণে সেই আলোচনার সুরাহা হয়নি।
ভারতের সঙ্গে ১৯৮০ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত আলোচনায় বসতে রাজি হয়নি। এমনকি মিয়ানমারের সঙ্গে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত অসফল আলোচনা চলতে থাকে। তারপর ২০০৮ সাল পর্যন্ত আলোচনা বন্ধ থাকে। এবং যেহেতু উভয় পক্ষের আপত্তির প্রেক্ষিতে ৬টি বৈদেশিক স্বাক্ষরকারী কোম্পানির কাছে তাদের আপত্তি জানায়। ১৯৭৫-৭৬ সালে চুক্তিবদ্ধ বঙ্গোপসাগরের অঞ্চলে অল্প কিছু ড্রিলিং করে তারা এখান থেকে চলে যায়।
হঠাত্ করে ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২৮টি তেল গ্যাস ব্লক ঘোষণা করে। এর মধ্যে ৮টি হচ্ছে অল্প পানি আর বাকি ২০টি হচ্ছে গভীর সমুদ্রের ব্লক। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ঘোষণার প্রেক্ষিতে মিয়ানমার বঙ্গোপসাগরে আমাদের দাবিকৃত এলাকায় কোরিয়ান কোম্পানির সাথে চুক্তির ভিত্তিতে তৈল ও গ্যাস উত্তোলনের পাঁয়তারা শুরু করে, বাংলাদেশের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও। অপরদিকে ভারতও আমাদের সুন্দরবনের কাছে সমুদ্র অঞ্চলে তাদের নৌবাহিনী টহল শুরু করে দেয়। এই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ কূটনৈতিক তত্পরতা এবং আমাদের নৌবাহিনীর জাহাজ ঐ দুই অঞ্চলে অবস্থান নেয়, যার ফলে উভয় রাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে পুনরায় আলোচনায় বসতে আগ্রহ প্রকাশ করে। উল্লেখ্য যে, ১৯৭৪ সাল থেকে যে আলোচনা চলে আসছিল বাংলাদেশ ন্যায্যতার ভিত্তিতে সমুদ্রাঞ্চলের বিরোধ নিষ্পত্তি করার প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রদ্বয় সমদূরত্বের ভিত্তিতে সমুদ্রসীমা নির্ধারণে প্রচেষ্টা নেয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে বলে নেয়া ভাল, ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার আঞ্চলিক সমুদ্র নির্ধারণে সমদূরত্ব নীতিমালার ভিত্তিতে, সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। যা ২০০৮ সালে আলোচনায় বসেও মিয়ানমার, ভারত, বাংলাদেশ ঐ সমদূরত্ব নীতিমালার সমঝোতা পুনর্ব্যক্ত করে। কিন্তু বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থনৈতিক এলাকা এবং মহিসোপানের ২০০ মাইলের দাবি ন্যায্যতার ভিত্তিতে নির্ধারণ করার দাবি জানায়। যা উভয় রাষ্ট্র প্রত্যাখ্যান করে। বাংলাদেশ যেহেতু অন্তর্মুখী সমুদ্র এবং পার্শ্ববর্তী দুটি দেশের বহির্মুখী সমুদ্র থাকায় বাংলাদেশ মাত্র ১৩০ মাইল পর্যন্ত যাবার বাধ্য-বাধকতা তৈরি করে। অর্থাত্, মিয়ানমার তার সমুদ্রাঞ্চল পশ্চিম দিকে দাবি জানায় এবং ভারত পূর্বদিকে তাদের সমুদ্রাঞ্চল দাবি জানালে বাংলাদেশের এই অবস্থা হয়।
ভৌগোলিকভাবে ব্লকটি অবরুদ্ধ হয়ে যায়। যার জন্য বাংলাদেশের পক্ষে সমুদ্র আইন চুক্তি বা আনক্লজের ভিত্তিতে ২০০ মাইল নিজস্ব অর্থনৈতিক এলাকা এবং ২০০ মাইল মহিসোপান যে দাবি জানিয়েছে তা রুদ্ধ হয়ে যায়। তাতে বাংলাদেশের পক্ষে একদিকে যেমন অতিরিক্ত ১৫০ মাইল মহিসোপানের দাবির স্থাপন করা অথবা বহিঃসমুদ্রে যাবার যে অধিকার তা ক্ষুণ্ন হওয়ার উপক্রম হয়।
এরই প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক আইন ও আনক্লজের ভিত্তিতে আলোচনার মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের দাবি স্থাপন করতে ব্যর্থ হয়ে বাংলাদেশ ২০০৯ সালের ৮ অক্টোবর জাতিসংঘের কাছে সালিশী ব্যবস্থার মাধ্যমে নিষ্পত্তির নোটিস পাঠায় এবং ঢাকায় অবস্থিত উভয় দেশের রাষ্ট্রদূতের কাছে নোটিসের কপি পাঠায়। যার ফলে প্রথমে উভয় দেশের সরকার প্রথমে ক্ষুব্ধ হয় কিন্তু খুশির বিষয় হচ্ছে ভারত পরবর্তীকালে আনক্লজের সংযোজন ৭-এর ভিত্তিতে পাঁচ জন বিশিষ্ট আইনজ্ঞের দ্বারা ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয় এটি নেদারল্যান্ডের হেগ নগরে অবস্থিত স্থায়ী সালিশী আদালতকে দায়িত্ব দেয়া হয় এবং মিয়ানমার হাম্বুর্গে অবস্থিত সমুদ্র বিষয়ক ২১ সদস্যের আদালতে যেতে সম্মত হয় এবং বাংলাদেশও খুব আনন্দের সঙ্গে উক্ত প্রস্তাব গ্রহণ করে। উল্লেখ্য যে, আনক্লজের ভিত্তিতে ২১ সদস্যের তৈরি আদালত (ইটলস) ১৬তম মামলা হিসাবে এটি ধার্য করা হয়। বাংলাদেশ মিয়ানমারের সমুদ্র সীমা নির্দিষ্টকরণে তাই মামলাটি একটি অন্যতম মামলা হিসাবে চিহ্নিত হয় এবং সেই ইটলজের রায় ২০১২ সালের ১৪ মার্চ রায়ে বাংলাদেশে ভেজলাইন পশ্চিমে মান্দারবাড়িয়া দ্বীপ থেকে কুতুবদিয়া এবং কুতুবদিয়া থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ৪১৩ মাইল আমাদের ভেজলাইন নির্ধারণ করে দেয় আদালত। রায়ে আমরা সেন্ট মার্টিন দ্বীপের চারদিকে ১২ মাইল আঞ্চলিক সমুদ্রের সার্বভৌম অধিকার লাভ করি এবং ন্যায্যতার ভিত্তিতে ২০০ মাইল নিজস্ব অর্থনৈতিক এলাকা এবং ২০০ মাইল মহিসোপান এলাকার সার্বভৌম অর্থনৈতিক অধিকার লাভ করি। কোর্ট আরও একটি বিষয় উল্লেখ করেছে, ২০০ মাইলের বাইরে একটি গ্রে এলাকা চিহ্নিত করে দিয়েছে যেখানে বাংলাদেশের অতিরিক্ত মহিসোপানের এলাকা দাবি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং তার উপরে যে পানির অংশ তা মিয়ানমার ভোগ করবে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে এই রায়ের ভিত্তিতে ১ লাখ ১১ হাজার ৬শ’ তেত্রিশ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র অঞ্চল লাভ করেছে। এরকমভাবে অবশ্য মিয়ানমারও ১ লাখ ৭১ হাজারের উপরে এলাকা পেয়েছে। ২৫৬০২ বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যে, ভারত বাংলাদেশের সালিশী আদালতের রায়ে বাংলাদেশ পেয়েছে ১৯ হাজার ৪শ’ ৬৭ বর্গকিলোমিটার এবং ভারত পেয়েছে ৬ হাজার ১শ’ ৩৫ কিলোমিটার। এই রায়ের ফলে প্রতিবেশী মিয়ানমার ও ভারতের সাথে সমুদ্র সীমা নির্ধারণের বিষয়টি সুরাহা হওয়ায় বাংলাদেশ প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার ৮শ’ ১৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা সর্বসাকুল্যে লাভ করল। উল্লেখ্য, আমরা যে ২০০ মাইলের নিজস্ব অর্থনৈতিক এলাকা লাভ করেছি তার দূরত্ব হচ্ছে চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৪৪ নৌ মাইল। অর্থাত্ ঐ অঞ্চলে আমাদের মহিসোপানের তলদেশে অবস্থিত সব ধরনের প্রাণীজ ও অপ্রাণীজ সম্পদের উপর সার্বভৌম প্রতিষ্ঠার অধিকার নিশ্চিত হয়েছে।
লেখক: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়