বঙ্গোপসাগরে গ্যাস হাইড্রেট: আগামীর সম্ভাবনা
বিশেষ প্রতিনিধি:
বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের জলসীমায় সমুদ্রে ও তলদেশে গ্যাস-হাইড্রেট বা মিথেন গ্যাসের একটি জমাট স্তরের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। বাংলাদেশের সমুদ্র সীমানায় ১১ হাজার কোটি থেকে ৬৩ হাজার কোটি ঘনফুট প্রাকৃতিক গ্যাস-হাইড্রেট জমা থাকার সম্ভাবনা রয়েছে, যা ১৭-১০৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট প্রাকৃতিক গ্যাসের সমান।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিট গবেষণার পর এ তথ্য জানিয়েছে।
শুধু গ্যাস হাইড্রেট নয় সাথে চিহ্নিত করা হয়েছে অন্যান্য জলজ সম্পদ। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের একান্ত সমুদ্র এলাকায় বিভিন্ন প্রজাতির মূল্যবান উদ্ভিদজাত এবং প্রাণীজ সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় বিপুল গ্যাস হাইড্রেট ছাড়াও ২২০ প্রজাতির সি-উইড, ৩৪৭ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ৪৯৮ প্রজাতির ঝিনুক, ৫২ প্রজাতির চিংড়ি, ৫ প্রজাতির লবস্টার, ৬ প্রজাতির কাঁকড়া এবং ৬১ প্রজাতির সি-গ্রাস আছে।
বাংলাদেশের কিছু প্রজাতির সি উইড-এ প্রচুর প্রোটিন আছে যা আমদানি করা মাছের খাবার হিসেবে বিকল্প হতে পারে। আবার কিছু প্রজাতি অন্য প্রাণীদের খাবারের মান বাড়াতে ব্যবহার হতে পারে। প্রসাধনীতে ব্যাপকভাবে ব্যবহার হয় এমন কিছু উপাদান পাওয়া যায় এমন সি উইডও অনেক পাওয়া গেছে সমুদ্রে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, গবেষণায় বাংলাদেশের একান্ত অর্থনৈতিক এলাকায় ম্যারিন জেনেটিক রিসোর্স এর অবস্থান চিহ্নিত করা এবং বিবিধ প্রজাতি চিহ্নিত করে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। দেশের মেরিন ও উপকূলীয় অঞ্চলে সকল প্রকার সমুদ্র সম্পদ আহরণ, বাণিজ্যিক জাহাজ, জ্বালানি, পর্যটন ইত্যাদি ঘিরে কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধির নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে এবং এ জন্য নয়টি খাতকে নির্দিষ্ট করে কাজ করা হচ্ছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বঙ্গোপসাগরে বিশেষ করে ভারতের কৃষ্ণ-গোদাভারী এবং মহানন্দা বেসিনে বিপুল গ্যাস- হাইড্রেট মজুদের সম্ভাবনা বিষয়ে ভারত ইতোমধ্যে নিশ্চিত হয়েছে। ভারত কৃষ্ণ-গোদাভারী এবং মহানন্দা বেসিনে এবং আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের তিনটি স্থানে কূপ খনন করেছে। মহানন্দা বেসিনে সাগরের তলদেশে ২০৫ মিটার নিচে ২৫ মিটার পুরু একটি স্তরে প্রায় ১৫ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাস-হাইড্রেটের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্সের সচিব রিয়ার এডমিরাল (অব.) মো. খুরশেদ আলম বলেন, পুরো এলাকায় এখনও জরিপ করতে পারিনি। ২০১৮ সালে বাংলাদেশের অধিকৃত জলসীমায় বঙ্গোপসাগরের তলদেশে গ্যাস হাইড্রেটের উপস্থিতি ও মজুদের পরিমাণ নির্ণয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিট সমীক্ষা করেছিল। এটা মূলত সমুদ্রের জরিপ করা অঞ্চলের তথ্য-উপাত্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রাথমিক ধারণা।
২০১১ সালে জাতিসংঘে মহিসোপানের সীমানা নির্ধারণ কমিশনে বাংলাদেশের দাবি উত্থাপনের আগে বঙ্গোপসাগরে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার লাইন কিলোমিটার ভূতাত্ত্বিক জরিপ করা হয়েছিল। সেসব জরিপের ওপর ভিত্তি করেই এই সমীক্ষা করা হয়েছে। নতুন করে কোনও জরিপ করা হয়নি। যুক্তরাজ্যের সাউদাম্পটনে অবস্থিত ন্যাশনাল ওশেনোগ্রাফি সেন্টারসহ পেট্রোবাংলা, বাপেক্স এবং স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের যৌথ উদ্যোগে তিন বছর ধরে এই গবেষণা করা হয়।
ন্যূনতম ও সর্বোচ্চ ধারণার মধ্যে এতোটা ব্যবধান হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে খুরশেদ আলম বলেন, পুরো এলাকাটা জরিপ করা হয়নি। যে লাইন ধরে করা হয়েছে সেটুকু সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত। বাকি পুরো এলাকা ১০৩ টিসিএফ পর্যন্ত গ্যাস পাওয়া সম্ভব।
পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় এই তথ্য জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে দেবে। জ্বালানি বিভাগ ভূতাত্ত্বিক জরিপসহ অন্যান্য পদক্ষেপ নেবে।
গ্যাস হাইড্রেট কী?
গ্যাস হাইড্রেট হল জমাটবদ্ধ মিথেন গ্যাস। মিথেন গ্যাস উচ্চচাপ ও নিম্ন তাপমাত্রার কারণে জমাট বরফে পরিণত হয়। তখন তাকে গ্যাস-হাইড্রেট বলে। এটি এক ধরনের কঠিন পদার্থ, যা স্তূপীকৃত বালির ছিদ্রের ভেতরে ছড়ানো বরফ আকারে, অথবা কাদার তলানিতে ক্ষুদ্র পিণ্ড, শিট বা রেখা আকারে থাকে।
সাগরতলে মাটির চাপে এটা বরফ হয়ে যায়। সাধারণভাবে ৩০০ মিটারের বেশি গভীর সমুদ্র তলদেশে গ্যাস হাইড্রেট পানি ও মাটির চাপে মিথেন বা স্ফটিক বরফ আকারে থাকতে দেখা যায়। এটা সমুদ্র তলদেশে প্রায় ১০ থেকে একশ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে।
ইউএস জিওলজিক্যাল সার্ভের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, গ্যাস হাইড্রেট হল পানি ও গ্যাসের তৈরি কঠিন স্ফটিক। এটি দেখতে অনেকটা বরফের মতো। তবে এতে প্রচুর মিথেন থাকে। সাগরের তলদেশের নিচে প্রচুর গ্যাস হাইড্রেট পাওয়া যায়। তবে এটি স্বাভাবিক সমুদ্রপৃষ্ঠের চাপ ও তাপমাত্রায় অবস্থানের পরিবর্তন ঘটায়। মূলত উচ্চচাপ ও নিম্ন তাপমাত্রায় গঠিত জমাট বরফের মধ্যে স্তূপ আকারে থাকে। বালুর ভেতরে ছড়ানো স্ম্ফটিক আকারে কিংবা কাদার তলানিতে ক্ষুদ্র পিণ্ড, শিট বা রেখা আকারে থাকে। এই গ্যাস হাইড্রেট থেকে মিথেন গ্যাস পাওয়া সম্ভব, যা ব্যবহারযোগ্য।
সাধারণত সাগরের পানির নিচে নির্দিষ্ট গভীরতা এবং চাপে জমাট আকারে এর অবস্থান। সাগরের অগভীর ও গভীর উভয় অঞ্চলে এটা থাকতে পারে। মেরু অঞ্চলের বরফের নিচে বিশাল এলাকায় মিথেন হাইড্রেটের মজুদ রয়েছে। যা হাজার হাজার টিসিএফ গ্যাসের সমপরিমাণ। সাগরের গভীর থেকে এই মিথেন হাইড্রেটকে তোলার মতো সহজলভ্য প্রযুক্তি এখনও আবিস্কার হয়নি। গ্যাস হাইড্রেটের অনুসন্ধান জটিল প্রক্রিয়া। বহু বছর ধরে বিজ্ঞানীরা এই গ্যাস ব্যবহারের সহজ উপায় বের করার চেষ্টা করছে। এজন্য একে কেউ কেউ ‘ভবিষ্যতের সুখবর’ আখ্যা দিয়েছেন।
এই বিপুল গ্যাস হাইড্রেট এর উপস্থিতি ও মজুদ আগামী শতকে বাংলাদেশের জ্বালানি খাতের সামগ্রিক চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে এমন আশার কথা জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।