বদলে যাওয়া বাংলাদেশ
রফিকুল বাসার:
স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তীতে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদার ঘোষণা পেল বাংলাদেশ। স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়শীল দেশ হওয়ার তিন সূচকই পূরণ হয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বীকৃতি এটা।
মাথাপিছু আয় বেড়েছে। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা কমেছে। জীবনমান উন্নত হয়েছে। বেড়েছে মানবসম্পদ সূচক।
পাট, চা আর চামড়া ছাড়া কিছু না থাকা জনপদ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সাত কোটি মানুষের তিন বেলা খাবার জোটা নিয়ে সংশয়ে থাকা অর্থনীতি এখন অনেকের ঈর্ষার কারণ। তলাবিহীন ঝুঁড়ির তকমা ছেড়ে এখন ১৮ কোটি মানুষের বড় বাজার। ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে, ফলে চাহিদাও বেড়েছে।
খাদ্যে সয়ংসম্পূর্ণ। শিল্পে উন্নতি। সবার কাজের সুযোগ। আর উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ। এসবই এখন দৃশ্যমান। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ঘরের দোর গোড়ায়। কৃষি বিপ্লবে চালের উৎপাদন বেড়েছে কয়েকগুণ। বেড়েছে মাছ চাষ। অভাব নেই শাকসবজি ফলমূলের। স্থানীয় ছোট বড় উদ্যোক্তার ছড়াছড়ি। মঙ্গা শব্দ এখন আর নেই। ৪০ থেকে ৫০ লাখ শ্রমিক কাজ করছে পোশাক শিল্পে। বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চিতি ৪৪/৪৫ বিলিয়ন ডলার। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র বেড়েছে। আমূল পরিবর্তন যোগাযোগ ব্যবস্থায়।
মাত্র দুই বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ পাওয়ার জন্য যে অপেক্ষা, তা শেষ। স্থানীয় অনেক উদ্যোক্তা এখন এর চেয়ে বেশি বিনিয়োগে সক্ষম।
আমদানি করা উচ্চমূল্যের জ্বালানি এখন ঘরে ঘরে। শিল্পও চলছে আমদানি করা জ্বালানি দিয়ে। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ। অর্থের কথা ভেবে আর প্রকল্প বাতিল করা হয় না।
হাজার কোটি টাকার বাজেট এখন লাখ লাখ কোটি হয়েছে। ৫০ বছর আগে বার্ষিক বাজেট ছিল হাজার কোটি টাকারও কম, ৭৮৬ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে তা হয়েছে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। ৫০ বছরে লাখগুণ হয়েছে। উন্নয়ন বাজেটের আকারই এখন ২ লাখ ১৫ হাজার ৪৩ কোটি টাকা। ১৯৭২-৭৩ সালে আমাদের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ১২৯ ডলার। এখন প্রায় দুই হাজার ডলার।
তবে এখনও পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠি কম নয়। তাদেরকে সমকাতারে নেয়াই হতে হবে মূল লক্ষ্য। পিছিয়ে থাকা সুবিধা বঞ্চিত জনগোষ্টিকে এইসব সুবিধার আওতায় আনতে হবে।
স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে জাতিসংঘের চূড়ান্ত সুপারিশ পেয়েছে বাংলাদেশ। সব ঠিক থাকলে পাঁচ বছরের প্রস্তুতিকাল শেষে ২০২৬ সালে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশ হবে।
জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি বা ইউএন-সিডিপির চেয়ার টেফারি টেসফাসো এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন। নিউ ইয়র্কে সিডিপির পাঁচ দিনের ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনা সভা শেষে এই ঘোষণার কথা জানানো হয়।
কোন দেশ পরপর জাতিসংঘের দুটি ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনায় উত্তরণের মানদণ্ড পূরণে সক্ষম হলে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল হওয়ার চূড়ান্ত সুপারিশ পায়। বাংলাদেশ দ্বিতীয়বারের মতো মানদণ্ডগুলো অর্জন করেছে।
উন্নয়নশীল হওয়ার সুবিধায় কিছু চ্যালেঞ্জ সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এখন যে সুবিধাগুলো বাংলাদেশ পাচ্ছে তার অনেক কিছুই পাবে না। এখন সে সব সুবিধা যোগ্যতা দিয়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে অর্জন করতে হবে। স্বাবলম্বী, সয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে।
উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠলে কম সুদে ঋণ পাওয়া, রপ্তানি সুবিধাসহ বিভিন্ন সুবিধা হারাবে। ফলে সেই সুবিধাগুলো উত্তরণের প্রস্তুতির সময় চাওয়া হয়েছে। এই সময়ে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে সব সুযোগ-সুবিধা পাবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে আরও তিন বছর অর্থাৎ ২০২৯ সাল পর্যন্ত শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) আওতায় শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা হারাতে হবে। এতে কিছুটা রপ্তানি কমতে পারে। পোশাক শিল্প তার অন্যতম। এখন ওষুধ তৈরিতে মেধাস্বত্বের অর্থ দেয়া লাগে না। তখন দিতে হবে। কম সুদে সহজ শর্তের ঋণ কমতে পারে। বৈদেশিক সাহায্যও কমে যাবে। নিজস্ব ভতুর্কি ব্যবস্থা নজরদারিতে পড়বে। কৃষি ও শিল্পে ভর্তুকি কমাতে হবে পারে। জাতিসংঘের চাঁদা বাড়বে। উন্নত দেশে শিক্ষাবৃত্তি কমবে।
উন্নয়নশীল হওয়ার পর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। বিনিয়োগও বাড়তে পারে। গরিব না থাকার কারণে ঋণ পাওয়ার পরিমান বাড়বে। তবে বৈদেশিক ঋণে সুদ বেশি হবে।
১৯৭৫ সাল থেকে স্বল্পোন্নত দেশ বাংলাদেশ। ২০১৮ সালে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে সিডিপির সব শর্ত পূরণ করে।
মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ সূচক এবং জলবায়ু ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকÑ এই তিনটি সূচক বিবেচনা করে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়শীল দেশের কাতারে নেয়া হয়।
উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার জন্য একটি দেশের মাথাপিছু আয় হতে হয় কমপক্ষে এক হাজার ২৩০ মার্কিন ডলার, ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল এক হাজার ৮২৭ ডলার। মানবসম্পদ সূচকে ৬৬ পয়েন্ট প্রয়োজন; বাংলাদেশের এখন ৭৫ দশমিক ৩০। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে কোনো দেশের পয়েন্ট ৩৬ এর বেশি হলে স্বল্পোন্নতই রাখা হয়। ৩২ এ আসার পর উন্নয়নশীল দেশের যোগ্যতা অর্জন হয়। সেখানে বাংলাদেশের পয়েন্ট এখন ২৫ দশমিক ২০।
এখন ৪৬টি স্বল্পোন্নত দেশ আছে। ১৯৭১ সালে ছিল ২৫টি।
রপ্তানী আয়, বৈদেশিক ঋণ ও প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগে পরিবর্তন হতে পারে। শিল্পে বৈচিত্র্য আনতে হবে। একক নজর পোশাক শিল্পে রাখা যাবে না। অন্য শিল্পেও একইভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। শিল্পের ক্ষেত্র বাড়াতে হবে। দক্ষ, মেধাবী শ্রম শক্তি বাড়াতে হবে।
এই অর্জন ধরে রাখতে হবে। উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে হবে। ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ হওয়ার যে পরিকল্পনা তার পথ ধরে এগিয়ে যেতে হবে।
আজকের বাংলাদেশ বদলে যাওয়া বাংলাদেশ: প্রধানমন্ত্রী
এই অর্জন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, এক যুগ আগের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশ এক নয়। প্রিয় সাংবাদিকবৃন্দ নিশ্চয়ই আপনারা সেটা স্বীকার করবেন। আজকের বাংলাদেশ এক বদলে যাওয়া বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে জাতিসংঘের চূড়ান্ত সুপারিশ পাওয়ার কৃতিত্ব জনগণকে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশের এই অর্জন তুলে ধরতে সংবাদ সম্মেলনে এসে তিনি বলেন, এ কৃতিত্ব সমগ্র বাংলাদেশের জনগণের। দেশে-বিদেশে প্রবাসে সকলকে এই কৃতিত্বের অংশীদার মনে করি। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা এই মাইলফলক অর্জন করতে পেরেছি। সমগ্র জাতির জন্য এটা অত্যন্ত আনন্দের এবং গর্বের। আমাদের এই উন্নয়নের গতিধারা অব্যাহত থাকলে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ অচিরেই একটি উন্নত-সমৃদ্ধ মর্যাদাশীল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় জিডিপি প্রবৃদ্ধি হার ৭ শতাংশ অতিক্রম করে। বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে প্রবেশ করে।
শেখ হাসিনা বলেন, আজকের যেই অর্জন, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ, তা আমাদের বিগত ১২ বছরের নিরলস পরিকল্পনা, পরিশ্রম ও প্রচেষ্টার ফসল। আর দেশের মানুষই কিন্তু এসব কাজ করে দিয়েছে। আমরা শুধু সরকার থেকে নীতি সহায়তা দিয়ে সুযোগ তৈরি করে দিয়েছি।
২০০৮-০৯ বছরে রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ছিল ১৫.৫৭ বিলিয়ন ডলার। আর ২০১৮-১৯ বছরে তা ৪০ দশমিক পাঁচ-চার বিলিয়ন ডলারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০০৮-০৯ অর্থ বছরে ৭ দশমিক চার-সাত বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ৪৪ দশমিক শূন্য-তিন বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। ২০০১ সালে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪৮.৯ শতাংশ এবং হত-দারিদ্র্যের হার ছিল ৩৪.৩ শতাংশ। ২০১৯ সালে দারিদ্র্যের হার কমে দাঁড়িয়েছে শতকরা ২০.৫ ভাগ এবং হত-দারিদ্র্যের হার ১০.৫ শতাংশে।
২০০৯-১০ সালে বিদ্যুতের স্থাপিত ক্ষমতা ছিল ৫ হাজার ২৭১ মেগাওয়াট। বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৪ হাজার ৪২১ মেগাওয়াটে উন্নীত এবং বিদ্যুৎ সুবিধাভোগী জনসংখ্যা ৪৭ থেকে ৯৯ শতাংশে উন্নীত হওয়ার কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।
বাংলাদেশ বিশ্বে ধান উৎপাদনে তৃতীয় এবং মাছ-মাংস, ডিম, শাকসবজি উৎপাদনেও স্বয়ং-সম্পূর্ণ। অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্থানে এবং ইলিশ উৎপাদনকারী ১১ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম।