বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প অন্ধকারে!
দফায় দফায় সময়সীমা বৃদ্ধি আর চিঠি চালাচালির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প। চুক্তির দুই বছর পরও ন্যূনতম কাজই শুরু করতে পারেনি ইতালীয় প্রতিষ্ঠান ‘ম্যানেজমেন্ট এনভায়রনমেন্ট ফাইন্যান্স’।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকা শহরের বর্জ্য অপসারণ করা এবং সাশ্রয়ী মূল্যের বিদ্যুৎ ও জৈব সার পাওয়ার লক্ষ্যে প্রকল্পটি চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল।
ঢাকা সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এবং অতিরিক্ত প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা আবু সালেহ মোহাম্মদ মাঈন উদ্দীন বলেন, বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প এখন অন্ধকারে। এটি বাস্তবায়ন না হওয়ায় অনেক ক্ষতি হচ্ছে। প্রকল্পটির অনেক উদ্দেশ্যের মধ্যে বর্জ্য অপসারণ করা অন্যতম। কিন্তু তা হচ্ছে না। ফলে বর্জ্য ফেলার যে জায়গা রয়েছে তা ক্রমেই ফুরিয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপানসহ বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞ বেশ কয়েকটি কোম্পানি এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। কিন্তু বর্তমান যে চুক্তি রয়েছে সেটি বাতিল না হওয়া পর্যন্ত নতুন করে চুক্তি করা যাচ্ছে না। এতে অন্তত দুই বছর পিছিয়ে গেলাম। চুক্তি বাতিল করে নতুন চুক্তি করতে যত বেশি সময় লাগবে তত পিছিয়ে যাব।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের এই প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০০৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। ২০১১ সালের ২ ডিসেম্বর সরকার এই প্রকল্পের চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়। এরপর ২০১৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ইতালির প্রতিষ্ঠান ‘দ্য ম্যানেজমেন্ট এনভায়রনমেন্ট ফাইন্যান্সে’র সঙ্গে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের চুক্তি হয়। স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব কেএম মোজাম্মেল হক ও ম্যানেজমেন্ট এনভায়রনমেন্টের কো-চেয়ারম্যান বেলিজারিও কসিমো চুক্তিতে সই করেন। গত বছরের ৩১ মার্চ এর মেয়াদ শেষ হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো কাজই শুরু হয়নি।
চুক্তি অনুযায়ী, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির প্রথম দেড় বছরে দুটি প্ল্যান্টে ১০ মেগাওয়াট, দুই বছরে ৩০ মেগাওয়াট ও তিন বছরে ৫০ মেগাওয়াট উৎপাদনে যাওয়ার কথা ছিল। বর্জ্যের সরবরাহ সাপেক্ষে দুটি প্ল্যান্টে উৎপাদন ১০০ মেগাওয়াটে উন্নীত করা হবে। সরকার তাদের কাছ থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুত্ ১২.৫ সেন্ট বা ৮ টাকা ৭৫ পয়সা দরে কিনবে। বিদ্যুতের এই দর আগামী ২০ বছর পর্যন্ত থাকবে। এ ছাড়া এ দুটি বিদ্যুেকন্দ্র থেকে উপজাত পণ্য হিসেবে বছরে নয় লাখ টন জৈব সার পাওয়া যাবে বলেও চুক্তির সময় জানানো হয়।
প্রকল্পটির আওতায় ঢাকার বর্জ্য ফেলার দুটি স্থান আমিনবাজার ও মাতুয়াইলে দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করার কথা ছিল। এ জন্য ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন (উত্তর ও দক্ষিণ) ২৭ দমশিক ১ একর করে মোট ৪৩ দশমিক ৪ একর জমি ইজারা দেবে। প্রতিবছরের ইজারা মূল্য ৬৯ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। তবে পাঁচ বছর পর পর ২০ শতাংশ হারে ইজারার টাকা বাড়বে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য দুই সিটি করপোরেশন প্রতিদিন চার হাজার টন বর্জ্য সরবরাহ করবে।
সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী, প্রকল্পটিতে সরকারের কোনো বিনিয়োগ থাকবে না। ইতালীয় প্রতিষ্ঠানটি ‘নির্মাণ মালিকানা পরিচালনা ও হস্তান্তর (বিওওটি) পদ্ধতিতে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের পাশাপাশি বিনিয়োগ তুলে নিতে কেন্দ্র দুটি ২০ বছর পরিচালনা করবে।
চুক্তি অনুযায়ী, কাজের কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় ২০১৩ সালের ১৮ জুন ইতালীয় ওই কোম্পানিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা চিঠি দেন। জবাবে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বলা হয়, খুব শিগগির তারা কাজ শুরু করবে। কিন্তু তারা কাজ শুরু করতে পারেনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, চুক্তি স্বাক্ষরের পর প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন এবং সেখানকার মাটি পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ ছাড়া আর কোনো কাজই করেনি প্রতিষ্ঠানটি। ইতোমধ্যে তিন দফা সময় বাড়িয়েছে তারা। সর্বশেষ গত বছরের মাঝামাঝিতে সময় বাড়ানোর আবেদন জানালে তাতে অস্বীকৃতি জানায় মন্ত্রণালয়। কিন্তু ফের সময় বাড়ানো হয়।
প্রকল্পটি নিয়ে গত ২২ ফেব্রুয়ারি দুই সিটি করপোরেশনের সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে চুক্তি বাতিলের প্রস্তাব দেওয়া হয়। এর আগে ২০১৪ সালের ১৩ এপ্রিল অনুষ্ঠিত কারিগরি সভাতেও প্রকল্পটির চুক্তি বাতিলের পক্ষে সিটি করপোরেশন তাদের জোরালো অবস্থান তুলে ধরে।
এ বিষয়ে জানতে ইতালীয় ওই প্রতিষ্ঠানের কাছে একটি ই-মেইল পাঠানো হয়। কিন্তু এতে তাদের কোনো সাড়া মেলেনি। তবে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে যে পরিমাণ অর্থ দরকার তা ওই প্রতিষ্ঠানের কাছে নেই। তারা চেয়েছিল পুরো টাকা ঋণ নিয়ে কাজ শুরু করবে। এতে তারা সফল হয়নি। সর্বশেষ চীনের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেছে তারা। কিন্তু তাতেও কোনো অগ্রগতি নেই।
চুক্তিতেও গলদ : বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে চুক্তি করা হয়েছে তাতেও রয়েছে গলদ। এটিকে অসম্পূর্ণ চুক্তি উল্লেখ করে মন্ত্রণালয়কে লিখিত জানিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। তাতে বলা হয়েছে, ঢাকা সিটি করপোরেশন প্রকল্পের ‘স্টেকহোল্ডার’ হওয়া সত্ত্বেও প্রকল্প বাস্তবায়নকারীর সঙ্গে চুক্তি সই করার পর তাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক কোনো সভা হয়নি। ফলে প্রকল্পের বাস্তবায়ন অগ্রগতি সম্পর্কিত কোনো তথ্য সিটি করপোরেশনের জানা নেই। পর পর তিনবার সময় বৃদ্ধি করা হলেও সিটি করপোরেশনকে কিছুই জানানো হয়নি। অন্যদিকে চুক্তি অনুযায়ী, সিটি করপোরেশন নির্দিষ্ট পরিমাণ বর্জ্য সরবরাহে ব্যর্থ হলে টনপ্রতি ৬৫ ডলার ‘লিকুইডেটেট ডেমেজ’ আরোপের বিধান করা হলেও প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠনের ব্যর্থতার কারণে বারবার সময় বৃদ্ধির কারণে কোনো ক্ষতিপূরণ আদায়ের বিধান রাখা হয়নি।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশন থেকে বলা হয়েছে, ইতালীয় কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি হলেও প্রতিষ্ঠানটি চায়নার একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ‘সাব-কন্ট্রাক্টে’ যাওয়ায় প্রকল্পের সার্বিক সফলতা নিয়ে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে।
চুক্তিটি অসম্পূর্ণ আখ্যায়িত করে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এটি বাস্তবায়ন হলেও প্রতিদিনের উৎপাদিত বর্জ্যের কমপক্ষে ৪০ শতাংশ বর্জ্য অপসারণ করতে হবে। ফলে বর্জ্য ফেলার স্থানটির দৈনন্দিন পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজ চলমান রাখতে হবে এবং পাঁচ-সাত বছর পরপর নতুন জমি অধিগ্রহণ করে ল্যান্ডফিল (বর্জ্য ফেলার স্থান) সম্প্রসারণ করতে হবে।