বাংলাদেশে জ্বালানি তেল বিপণনের ইতিহাস ও বর্তমান প্রেক্ষিত
স্বাধীন বাংলাদেশে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস: স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে দেশী-বিদেশী কোম্পানিগুলোর তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের কাজে গতি বৃদ্ধি পায়। পাকিন্তান অয়েল এন্ড গ্যাস ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন এর যে অংশটি বাংলাদেশ সরকার অধিগ্রহন করেছিল ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ রাষ্ট্রপতির ২৭নং আদেশের মাধ্যমে সে অংশটির নাম দেন বাংলাদেশ মিনারেল অয়েল এন্ড গ্যাস কর্পোরেশন (বিএমওজিসি)। ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বর খনিজ খনন সংক্রান্ত কাজের দায়িত্ব বিএমওজিসি থেকে আলাদা করে বাংলাদেশ মিনারেল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (বিএমইডিসি) নামক নতুন প্রতিষ্ঠানের হাতে অর্পন করা হয় । আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্যের উর্ধ্বগতির প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু সরকার দেশের তেল-গ্যাস উত্তোলন ও অনুসন্ধানের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নতির বিষয়টি গভীরভাবে গুরুত্ব দিয়ে ১৯৭৪ সালে পালার্মেন্টে পেট্রোলিয়াম আইন (১৯৭৪) পাশ করে। এই আইনটি অনুমোদনের মধ্যদিয়ে বিদেশী কোম্পানিগুলোকে বাংলাদেশের স্থল ও জলসীমায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের আহ্বান জানানো হয়। ১৯৭৪ সালের বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম আইন অনুযায়ী বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের এলাকাটিকে ৬টি ব্লকে বিভক্ত করা হয় এবং ‘উৎপাদন বন্টন চুক্তি’ মোতাবেক উক্ত ৬টি ব্লককে অ্যাসল্যান্ড, আরকো, বিওডিসি (জাপেক্স), ইউনিয়ন অয়েল, কানাডিয়ান সুপারিয়র অয়েল এবং ইনা নাফতাপ্লিনকে অনুসন্ধান কার্য চালানোর অনুমতি প্রদান করা হয় এসব কোম্পানি বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষার পর সাতটি কূপ খনন করে। তাদের মধ্যে একমাত্র ইউনিয়ন অয়েল কোম্পানি ১৯৭৭ সালে কুতুবদিয়াতে সমুদ্রাঞ্চলে একটি গ্যাসক্ষেত্র আবিস্কার করতে সক্ষম হয়েছিল।
১৯৭৪ সালের ২২ আগষ্ট রাষ্টপতির ১৫নং আদেশের মাধ্যমে পূণ:গঠিত বাংলাদেশ অয়েল এন্ড গ্যাস কর্পোরেশন (বিওজিসি) এর সংক্ষিপ্ত নাম দেয়া হয় পেট্রোবাংলা। পেট্রোবাংলা প্রতিষ্ঠার ফলে প্রথমবারের মতো দেশীয় বাংলাদেশী ভূ-তত্ত্ববিদ ও কারিগরগণ তাদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানোর সুযোগ লাভ করে। ১৯৭৬ সালের ১৩ নভেম্বর রাষ্ট্রপতির ৮৮নং আদেশের মাধ্যমে অপরিশোধিত অয়েল এবং পেট্রোলিয়াম পণ্য আমদানি, পরিশোধন এবং বিক্রি করার দায়িত্ব অপির্ত হয় নবগঠিত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) এর উপর। ১৯৮৫ সালের ১১ই এপ্রিল ২১নং অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে বিওজিসি (সংক্ষিপ্ত নাম পেট্রোবাংলা) এবং বিএমইডিসি একীভূক্ত হয়ে নতুন নাম হয় বাংলাদেশ অয়েল, গ্যাস এন্ড মিনারেলস কর্পোরেশন (বিওজিএমসি)। ১৯৮৯ সালের ১১ইং ফেব্রুয়ারী ২১ নং অর্ডিন্যান্স সামান্য পরিবর্তনের মাধ্যমে বিওজিএমসি এর সংক্ষিপ্ত নাম রাখা হয় পেট্রোবাংলা যা এখনো বলবৎ আছে।
১৯৭৫ সালের ৯ই আগষ্ট বঙ্গবন্ধু সরকার বিদেশী তেল কোম্পানির নিকট হইতে পাঁচটি গ্যাস ক্ষেত্র ক্রয়ের মাধ্যমে জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। এজন্য ২০১০ সালের ৯ই আগষ্ট প্রতি বছর এই তারিখে জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৯৮০ এর দশকে পেট্রোবাংলার অনুসন্ধান কাজে গতি সঞ্চার হয়। ১৯৯৩ সালে জাতীয় জ্বালানি নীতি আইন অনুমোদনের পর উৎপাদন বন্টন চুক্তির আওতায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের লক্ষে বাংলাদেশের সীমানার মধ্যে ২৩টি অনুসন্ধান ব্লক চিহিৃত করা হয়। প্রথম পর্যায়ে উৎপাদন বন্টন চুক্তির অধীনে ৪টি বিদেশী কোম্পানিকে মোট ৮টি ব্লকে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের অনুমতি দেয়া হয়। মোট ১১টি অনুসন্ধান কূপ খননের পর তিনটি স্থানে গ্যাস আবিস্কৃত হয়। এগুলো হলো মৌলভীবাজার, সাংগু এবং বিবিয়ানা।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) ও তার কার্যাবলী ঃ দেশে পেট্রোলিয়ামের চাহিদা মিটানোর জন্য ক্রুড পেট্রোলিয়াম আমদানি, পরিশোধন এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ, মিশ্রণসূত্রে লুব্রিক্যাণ্টস উৎপাদন, (প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যতীত) উপজাত পণ্যাদি ও লুব্রিকেণ্টসসহ পেট্রোলিয়ামজাত পণ্য দ্রব্যাদির আমদানি, রপ্তানি এবং বাজারজাতকরণ এবং তৎসংক্রান্ত আনুসংগিক বা সহায়ক কার্য সম্পাদনের উদ্দেশ্যে ১৯৭৬ সালের ১১ই নভেম্বর তারিখের ৮৮ নং অধ্যাদেশ অনুযায়ী বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর ০৩টি তেল বিপণন কোম্পানি, ০২টি ব্লেন্ডিং প্ল্যান্টস এবং ০১টি রিফাইনারিসহ ০৬টি অংগপ্রতিষ্ঠানে সমন্বয়ে ১ জানুয়ারি’১৯৭৭ সালে সংস্থার বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হয়। পরবর্তীতে এলপি গ্যাস লিমিটেড বিপিসি’র সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে যুক্ত হলে বর্তমানে ০৭টি অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে দেশব্যাপী পেট্রোলিয়াম পণ্যের চাহিদা পুরণ করা হচ্ছে। বিপিসি’র প্রধান কার্যালয় চট্টগ্রামে অবস্থিত। ঢাকায় এর একটি লিয়াজোঁ অফিস রয়েছে।
ক্রুড পেট্রোলিয়াম এবং অন্যান্য পরিশোধিত পেট্রোলিয়ামজাত পণ্যাদি সংগ্রহ ও আমদানি করা, ক্রুড পেট্রোলিয়াম শুদ্ধিকরণ এবং বিভিন্ন মানের পরিশোধিত পেট্রোলিয়ামজাত পণ্য সামগ্রী উৎপাদন, রিফাইনারী বা শোধনাগার এবং অন্যান্য সহায়ক সুবিধা-সুযোগ বা অবকাঠামো স্থাপন, বেজ ষ্টক বা কাঁচামাল, আবশ্যকীয় এ্যাডিটিভস এবং অপরাপর রাসায়নিক পদার্থ এবং প্রস্তুত লুব্রিক্যান্টস ইত্যাদিসহ লুব্রিক্যাটিং অয়েল আমদানি, মিশ্রণসূত্রে লুব্রিক্যাটিং পণ্যাদি উৎপাদন, ব্যবহৃত লুব্রিক্যান্টস রীসাইক্লিং বা রীব্রান্ডিং করণের প্ল্যান্টসহ লুব্রিক্যাটিং প্ল্যান্ট স্থাপন, রিফাইনারী বর্জ্য বা অবশিষ্টাংশ পণ্যাদি প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য কার্যক্রম গ্রহণ ও অবকাঠামো স্থাপন, পেট্রোলিয়াম পণ্য (ক্রুড এবং অপরিশোধিত) গুদামজাতকরণের অবকাঠামো বা ফ্যাসিলিটিজ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা প্রণয়ন ও স্থাপন, বিপণন কোম্পানিসমূহের মধ্যে পেট্রোলিয়াম সামগ্রী বরাদ্দ নির্ধারণ, অভ্যন্তরীন অয়েল ট্যাংকার সংগ্রহ, পেট্রোলিয়াম বিপণনের ফ্যাসিলিটিজ স্থাপন ও সম্প্রসারণ, পেট্রোলিয়াম এবং পেট্রোলিয়ামজাত পণ্যাদি রপ্তানি, ম্যানেজিং এ্যাজেন্টস হিসাবে দায়িত্ব পালন বা যে কোন ফার্ম বা কোম্পানির সংগে যে কোন ব্যবস্থাপনার চুক্তি বা অন্য যে কোন প্রকারের চুক্তি সম্পাদন, অংগ প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যাবলীর তদারকি, সমš^য়-সাধন ও নিয়ন্ত্রণ, বিভিন্ন সময়ে সরকার কর্তৃক নির্দেশিত বা অর্পিত অন্য যে কোন দায়িত্ব পালন; এবং অধ্যাদেশের লক্ষ্যসমূহ প্রতিপালনের জন্য আবশ্যকীয় অনুরূপ অন্যান্য কার্য্য ও বিষয়াদি সম্পাদন।
সংস্থা কর্তৃক যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ, সময়োচিত আমদানিসূচি প্রণয়ন, দেশব্যাপী সূষ্ঠু বিপতরণ ও সরবরাহ কার্যক্রম গ্রহণের ফলে এ সংস্থা নিরবচ্ছিন্নভাবে সারাদেশে জ্বালানি তেল সরবরাহের ক্ষেত্রে আস্থাভাজন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। জ্বালানি তেলের আমদানি প্রবাহ অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির জন্য বিপিসি বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রয়াত্ত প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির জন্য বিপিসি যে সব প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে সেগুলো হলঃ- কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, গণচীন, গণচীন, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া। এছাড়া অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রে সৌদি আরব এবং আবুধাবী হতে আমদানির জন্য বিপিসি’র মেয়াদী চুক্তি রয়েছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন ২০১৩-২০১৪ অর্থ বছরে বিভিন্ন উৎস হতে জ্বালানি তেল আমদানি করে দেশের চাহিদাপূরণ ও নিরবিচ্ছিন্ন সরবরাহ অব্যাহত রেখে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিবিধ জ্বালানি তেলের ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশে বর্তমানে জ্বালানি তেলের চাহিদা প্রায় ৫৬.০০ লক্ষমেঃ টন তন্মধ্যে ডিজেলের পরিমাণ প্রায় ৩৩.০০ লক্ষ মেঃ টন এবং ফার্ণেস অয়েলের পরিমাণ ১২.৫০ লক্ষ মেঃ টন অন্যান্য ১০.৫ লক্ষ মে: টন।
এ ছাড়াও, স্থাানীয়ভাবে সুপার পেট্রোকেমিক্যাল (প্রাঃ), পেট্রোম্যাক্স রিফাইনারী লিমিটেড এবং সরকারী গ্যাস ফিল্ড ও বেসরকারী কনডেনসেট ফ্রাকসনেশন প্লান্ট হতে মোট চাহিদার ৫% জ্বালানি তেল পাওয়া যায় । বাংলাদেশে ন্যাফথার চাহিদা কম থাকায় ইআরএল এ উৎপাদিত ন্যাফথা রপ্তানি করা হয়ে থাকে। ২০১৩-২০১৪ অর্থ বছরে রপ্তানিকৃত ন্যাফথার পরিমাণ ছিল ৯৩,০৮৫ মেঃ টন।
চলবে…
ড. শরীফ আশরাফুজ্জামান
ব্যবস্থাপনা পরিচালক
মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড