বাংলাদেশে জ্বালানি তেল বিপণনের ইতিহাস ও বর্তমান প্রেক্ষিত
বাংলাদেশে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের বর্তমান অবস্থা:
বর্তমান বিশ্বে তেল-গ্যাস হলো অর্থনৈতিক অগ্রগতির মূল চালিকা শক্তি। কিন্তু এই তেল-গ্যাসের অভাবেই বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে আছে। তেল-গ্যাস সম্পদের যথাযথ উন্নয়ন, সুষ্ট ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনার জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উন্নয়ন অবশ্যই দরকার। বাংলাদেশের মতো বহু উন্নয়নশীল দেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবে তাদের জ্বালানি সম্পদের উন্নয়ন ও ব্যবহার থেকে অনেক বঞ্চিত। প্রয়োজনীয় জ্ঞান এবং দক্ষ জনবলই এর কারণ। হাইড্রোজেন সমৃদ্ধ বাংলাদেশে গ্যাসের মজুদ ছিল ১৭ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফুট। এই পরিমাণ মজুদ ২০০৫ সাল থেকে দেশে প্রতিবছর যে হারে উৎপাদন কারখানায় সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে উক্ত মজুদের অর্ধেকেরও বেশী ব্যবহৃত হয়েছে। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এ অবস্থায় গ্যাসের অনুসন্ধান ও উৎপাদনের পাশাপাশি গ্যাস সম্পদের যথাযথ ব্যবহার ও সংরক্ষণ অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে বায়োমাস জ্বালানি বৃদ্ধি করে ভবিষ্যৎ জ্বালানি চাহিদা পূরণের কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই দেশের উন্নয়নের জন্য বাণিজ্যিক জ্বালানির প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। বাংলাদেশের জ্বালানি সম্পদের মধ্যে গ্যাসই প্রধান। দেশের বিদ্যুৎ স্থাপনা, শিল্প-কলকারখানার অধিকাংশই গ্যাসের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশে এখন প্রতিদিন গ্যাসের চাহিদা ১১০০ মিলিয়ন কিউবিক ফিট। এই গ্যাসের অধিকাংশই বিদ্যুৎ স্থাপনা, সার কারখানা ও সিমেন্ট কারখানার কাজে লাগছে। মোট জনসংখ্যার ৪ ভাগ গ্যাস সুবিধার আওতায় রয়েছে। জিডিপি ৪.৫৫% হারে বৃদ্ধি ধরলেও ২০২০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের গ্যাসের প্রয়োজন হবে ১৬.৮ থেকে ২০ টিসিএফ। অথচ আহরনযোগ্য মজুদ রয়েছে ১২ বা ১৫.৫ টিসিএফ। অর্থাৎ এর অর্থ দাঁড়ায় ২০২০ সাল পর্যন্ত চলার মতো গ্যাস এখন বাংলাদেশের হাতে নেই। গত ২০ বছরে গড় অর্থনীতির অগ্রগতির (জিডিপি) হার ৪.৫৫%। একই সঙ্গে গ্যাসের গ্রোথ রেট ৬.৭%। ২০৫০ সাল পর্যন্ত একই হারে জিডিপি ও গ্যাসের গ্রোথ রেট বাড়লে ২০৫০ সাল নাগাদ গ্যাসের প্রয়োজন হবে ৬৫ থেকে টিসিএফ। এসব ভেবেই করেই দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্র ১৯৯৩ সালে পেট্রোলিয়াম পলিসি ও ১৯৯৬ সালে ঘোষিত জাতীয় জ্বালানি-নীতিতে গ্যাস রপ্তানির কোন সুযোগ রাখা হয় নাই।
অনেকে মনে করেন, আগামি পাঁচ-দশ বছর পর এর চাহিদা আর থাকবে না। সৌরশক্তি, আণবিক শক্তি কিংবা অন্যান্য জ্বালানি বাজার দখল করে নেবে। তখন বাংলাদেশ গ্যাস নিয়ে বসে থাকবে; এ বক্তব্যটি তিনটি কারণে ভুল হতে পারে। প্রথমত, জীবাশ্ম জ্বালানি আরো অন্তত পঞ্চাশ বছর ব্যবহৃত হবে। আন্তর্জাতিক সোলার এনার্জি বিশেষজ্ঞগণ যদিও প্রথমে বলেছিলেন, ২০২০ সালে সোলার এনার্জি ব্যবহার সম্ভব হবে। এখন তারাই বলছেন, ২০৫০ সালের আগে সোলার এনার্জি সহজলভ্য হবে না। ডঃ পিটার ওডেলের ভাষ্যানুযায়ী সৌরশক্তি ২০৫০ সালে গ্যাসের সাথে প্রতিযোগিতায় আসবে এবং ২০৭০ সালে গ্যাস সোলার এনার্জির কাছে হেরে যাবে। দ্বিতীয়ত, অন্যান্য জ্বালানি আবিস্কৃত হলে বা ব্যবহার করা শুরু হলে তা যে বাংলাদেশের মতো অনুন্নত দেশকেও ছেয়ে ফেলবে তার নিশ্চয়তা নেই। হয়তো নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের মতো যথেষ্ট আর্থিক সঙ্গতি বাংলাদেশের তখনও হবেনা। তাছাড়া আমাদের গ্যাসনির্ভর শিল্প, কারখানা বা পাওয়ার প্লান্টগুলো চালাতে তখনো গ্যাস প্রয়োজন হবে। তৃতীয়ত, আগামি পাঁচ দশ বছরের মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার শেষ হলে পশ্চিমা দেশগুলোও তাদের মজুদ এখন খরচ করে ফেলতো; কিন্তু তা তারা করছেনা।
বাংলাদেশে গ্যাস অনুসন্ধান ও আবিস্কারের ক্ষেত্রে সাফল্যের অনুপাত আশাব্যঞ্জক হলেও দেশে জ্বালানি চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট নয়। এ অবস্থায় বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য গ্যাস সম্পদ রপ্তানি করা যেমন সঠিক নয় তেমনি দেশের সকল গ্যাস অনুসন্ধান ব্লককে বিদেশী কোম্পানিগুলোর কাছে ইজারা দান করাও দেশের জন্য মঙ্গলজনক নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, উৎপাদন বন্টন চুক্তির আওতায় বিদেশী তেল কোম্পানির হাতে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের দায়িত্ব দিলে জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্স এর কার্যত কোন কাজ থাকবেনা। তবে এটাও সত্য যে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিশেষ করে সমুদ্র অঞ্চলে তেল-গ্যাস আবিস্কারের উদ্দ্যেশে খনন কার্য চালানোর মতো পর্যাপ্ত অর্থনৈতিক সামর্থ বাংলাদেশের নেই। এজন্য সমুদ্র এলাকায় কিছু বাছাইকৃত বন্টক সুবিধাজনক শর্তে বিদেশী কোম্পানিকে দেয়া যেতে পারে এ আশায় যে, হয়তো গ্যাসের পাশাপাশি তেলের সন্ধানও মিলতে পারে। বঙ্গোপসাগরে মায়ানমারের সাথে জলসীমা নিয়ে যে সংঘাত চলে আসছিল তার আইনগত সমাধান হওয়াতে এটা আশা করা যায় যে, বাংলাদেশ শীঘ্রই সাগরে নতুন তেল-গ্যাসের সন্ধান লাভ করতে সক্ষম হবে।
একথা সত্য যে, তেল-গ্যাস সেক্টরের উন্নয়ন কার্যক্রম অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং প্রযুক্তি নির্ভর। যে কারণে এ ক্ষেত্রে উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের জন্য সরকারগুলোকে অনিচ্ছা সত্তে¡ও বৈদেশিক অর্থনেতিক সাহায্য এবং প্রযুক্তি ও কারিগরি সহযোগিতার উপর নির্ভর করতে হয়। তাছাড়া প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও লোকবলের অভাবে বিদেশী তেল কোম্পানির সাথে উৎপাদন বন্টন চুক্তি সম্পাদন করতে হয়। পৃথিবীর অনেক দেশে উৎপাদন বন্টন চুক্তির প্রচলন আছে। সুতরাং বাংলাদেশ উৎপাদন বন্টন চুক্তির বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে পারে। তবে যেকোন পদক্ষেপ নেয়ার পূর্বে সরকারকে অবশ্যই বাংলাদেশের জ্বালানি শক্তির একমাত্র উৎস প্রাকৃতিক গ্যাস-এর অনুসন্ধান, উত্তোলন ও ব্যবহার কৌশল নির্ধারণে ভবিষ্যত প্রজন্মের কথা ভাবতে হবে এবং জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হবে।
ড. শরীফ আশরাফুজ্জামান
ব্যবস্থাপনা পরিচালক
মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড