বাংলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রে বিশেষ গ্যাসমজুদ অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত। তবুও অনুসন্ধান হয়নি সন্তষজনক। আর তাই জ্বালানি সংকট নিয়েই চলতে হচ্ছে। সিদ্ধান্তহীনতায় বড় ঝুঁকিও দেখা দিয়েছে। এনার্জি বাংলা’র সাথে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক বদরূল ইমাম।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রফিকুল বাসার।
বাংলাদেশ তো খনিজ মজুদের একটা সম্ভাবনাময় অঞ্চল। সেই অনুযায়ি কী আমাদের অনুসন্ধান হয়েছে? অনুসন্ধান না হওয়াটাও কী এখনকার এই সংকটের কারণ বলে মনে করেন?
আসলে দেশে কোনও সময় খুব একটা জোরাল বা সিরিয়াস অনুসন্ধান হয়নি। আমরা জানি বাংলাদেশ একটা বদ্বীপ অঞ্চল। পৃথিবীর যত বদ্বীপ অঞ্চল আছে সবই কিন্তু তেল এবং গ্যাসে সমৃদ্ধ। যেমনÑ নাইজার ডেল্টা, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া। বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ডেল্টা। এখানে যে প্রচুর গ্যাস থাকবে এটা খুব স্বাভাবিক। আমাদের দেশে যে পরিমাণ সম্ভাবনা তার আংশিক অনুসন্ধান হয়েছে; কেবল দেশের একটা অংশে, পূর্বাংশটা। যে ২৭টা ক্ষেত্র আবিষ্কার হয়েছে সবই এই অঞ্চলে। বাকি দুই-তৃতীয়াংশ সমতল ভূমি এবং সাগর বক্ষে অনুসন্ধান হয়নি। পশ্চিম দিকে যে সমতলভূমি, সেখানে যে সম্ভাবনা, তা অনুসন্ধান করা হয়নি। ফলে সেই সম্ভাবনাটা রয়ে গেছে। গত ২০ বছরে ২৬টা খুপ খনন করা হয়েছে। তারমানে বছরে গড়ে একটা বা তার কিছু বেশি। গ্যাসের সম্ভাবনাময় অঞ্চলে বছরে একটা করে খুপ খনন করা কোন অনুসন্ধান কাজই না। এখানে অনুসন্ধান বাড়ানো অত্যাবশ্যক। অনুসন্ধান হলে এই গ্যাস সংকট থাকত না।
পশ্চিমাঞ্চলে অনুসন্ধান না হওয়ার কারণ কি?
অনুসন্ধান হয়নি তার কারণ হচ্ছে যে, পূর্ব দিকে সহজভাবেই গ্যাস বের করা যায়। বের করা সহজ এবং উত্তোলন করা সহজ। সেই কারণেই পূর্বদিকেই আমাদের অনুসন্ধানটা বেশি হয়েছে। পশ্চিম দিকে যে কাঠামো তা তুলনামূলক জটিল। এগুলো বের করা কঠিন। খনন করা তুলনামূলক কঠিন। কিন্তু বিশ্বব্যাপী এমন জটিল এবং কঠিন কাঠামোগুলোতে গ্যাস আবিষ্কার করে তোলা হচ্ছে। আমাদের দেশে এই কাজটা করা হয়নি। যদি করা হয় তবে দেখা যাবে আমাদের দেশে যথেষ্ট পরিমাণ গ্যাস বের হয়ে আসছে।
আমাদের সাগরেও তো অনুসন্ধান হল না।
হ্যাঁ, আমাদের যে সাগরবক্ষ সেখানে অনুসন্ধান কাজ খুবই কম হয়েছে। সাগরে আমাদের যে সীমানা ছিল মিয়ানমারের সাথে এবং ভারতের সাথে এটা অমীমাংসিত ছিল। এটা নির্ধারণ হওয়ার পরে মিয়ানমার যথেষ্ট পরিমাণ কাজ করেছে। তারা যথেষ্ট গ্যাস পেয়েছে। ভারতও কিন্তু করেছে। মিয়ানমার এই গ্যাস চীনে রপ্তানি করছে। সুতরাং আমাদের এখানে সেইরকম গ্যাস পাওয়া যাবে নাÑতা অবশ্যই বলা যাবে না। আমি মনে করি আমাদের এই অঞ্চল গ্যাস সমৃদ্ধ। কিন্তু এখানে সেইরকম অনুসন্ধান হয়নি। কিংবা এখনও হচ্ছে না। আমরা অর্জন করলাম কিন্তু ব্যবহারটা করতে পারলাম না। এই আমাদের সবচেয়ে হতাশার জায়গা।
এখন কি করা উচিত?
এখন যেটা করা উচিত গ্যাস অনুসন্ধানের যে ধীরগতি বা দুর্বল গতি তা বদলে দেয়া। এটা যদি বদলে জোরাল করা যায় তাহলে অবস্থার পরিবর্তন হবে। কয়েক বছর পরে হলেও সংকট কেটে যাবে। বিশেষ করে সাগরবক্ষে মিয়ানমারের ঐদিকে যেখানে তারা গ্যাস পেয়েছে তার পাশে আমাদের সীমানায়, আমাদের অঞ্চলে অবশ্যই প্রচুর পরিমাণ গ্যাস মজুদ আছে বলে আমি বিশ্বাস করি। আমার মতে বাংলাদেশে বড় গ্যাসক্ষেত্রগুলো কিন্তু এখনও আবিষ্কারের অপেক্ষায় আছে। যেগুলো এখন আবিষ্কার হবে, আবিষ্কারের অপেক্ষায় আছে, সেগুলো বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমারের সীমানায়, ঐ অঞ্চল বরাবর হবে। যদি সেখানে যথেষ্ট পরিমাণ অনুসন্ধান কাজ করা হয়।
এলএনজি কি সংকট মেটানোর বিকল্প হতে পারে?
এলএনজির বিষয়টা হচ্ছে, এই অবস্থায় যেখানে আমরা জানি বাংলাদেশে আরও গ্যাসের সম্ভাবনা আছে এবং সেটা ব্যবহার করতে পারি, তখন কেন যাব? যতদিন দেশের গ্যাসে নির্ভর থাকব ততদিনই লাভ। যখনই দেশীয় গ্যাস থেকে এলএনজিতে যাব তখনই খরচ বাড়বে। যেটা এখনি বেড়েছে। আমাদের এই মুহূর্তে এলএনজিতে যাওয়ার প্রয়োজন আছেÑ কি আছে না এই প্রশ্ন করা হলে, আমি মনে করি স্থানীয়ভাবে চাহিদা মেটানো উচিত। এই মুহূর্তে আমাদের এলএনজিতে যাওয়াটা আগাম হয়ে গেছে। একটা সময় এলএনজিতে যেতে হবে। যখন গ্যাসটা শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু এখন এলএনজিতে গিয়ে, বিশেষ করে স্পট মার্কেট থেকে নিতে গিয়ে প্রচুর উচ্চমূল্য দিচ্ছি। এটা মোটেই সুখকর না। এতে অর্থনীতিতে বড় চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। বিকল্প যেটা আছে, নিজস্ব দেশীয় মজুদÑ সেটা অনুসন্ধান করে, উত্তোলন করে বর্তমান চাহিদা মেটানো সবচেয়ে ভাল।
এখনই সংকট মেটাতে এলএনজির বিকল্প কিছুও তো নেই। নাকি এর বিকল্প আর কিছু হতে পারে?
একটা হচ্ছে গ্যাস তোলা। আর একটা দীর্ঘমেয়াদি অনুসন্ধান। এখন অনুসন্ধান শুরু করলে কয়েক বছর আগে হয়তো সেই গ্যাস পাওয়া যাবে না। কিন্তু অনেক সময় দেখছি স্পট মার্কেটের এলএনজি কেনার ফলে, সামান্য পরিমাণ কেনার ফলে, ৮০ কোটি বা ১০০ কোটি ঘনফুট কেনার ফলে, এত দাম বেশি যে অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করছে। এখন এই গ্যাস কিন্তু বিকল্পভাবে পেতে পারি। যে কূপগুলোর গ্যাস শেষ হয়ে গেছে কিম্বা যেগুলোর উৎপাদন কম সেগুলো ওয়ার্কওভার বা সংস্কার করে। অনেক কূপ থাকে যেখানে উত্তোলন বন্ধ হলেও গ্যাস রয়ে যায়। এইগুলোকে সংস্কার করা যায়। যতগুলো সম্ভব সংস্কার করে সমস্যার সমাধান সম্ভব। অন্তত যে পরিমান স্পট মার্কেট থেকে কিনছি সেই পরিমাণ ওয়ার্কওভার করে আনতে পারি। এর জন্য অনুসন্ধান কূপ দরকার নেই। এটা তৈরি কূপ। শুধু ঐ সব কূপে গিয়ে কিছু কাজ করলেই, কিছু সংস্কার করলেই সেই গ্যাসটা চলে আসতে পারে। কোনটার বেশি, কোনটার অল্প মেরামত করলেই হয়ে যাবে। যদি বড় আকারের কার্যকর পরিকল্পনা না নিই তাহলে হবে না।
এভাবে কত পরিমাণ গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ করা যেতে পারে?
এমন অনেক আছে। বিদেশি এক কোম্পানি দিয়ে জরিপ করা হয়েছিল। সেই জরিপে ৪০টার বেশি কূপ শনাক্ত করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, এই কূপগুলো সংস্কার করলে গ্যাস পাওয়া যেতে পারে। এভাবে ৩০ থেকে ৪০ কোটি ঘনফুট যোগ করা সম্ভব।
সিদ্ধান্তহীনতায় কয়েকটা আবিষ্কার করা গ্যাসক্ষেত্র তো পড়েই আছে। যেমন টেংরাটিলা।
হ্যাঁ। আমাদের ছাতক বা টেংরাটিলা পড়ে আছে। ফেনী পড়ে আছে। সীতাপাহাড় পড়ে আছে। এগুলো আটকে পড়া গ্যাস। পটিয়াতেও কিন্তু একসময় গ্যাস পাওয়া গিয়েছিল। এই আটকে পড়া গ্যাসগুলো তুলে নিয়ে আসা যায়। তার জন্য খুব একটা বেশি সময় লাগে না। এর জন্য যে দীর্ঘমেয়াদি অনুসন্ধান কাজ করতে হবে তাওÑনা। এই আটকে পড়া গ্যাসগুলো অল্প সময়ের মধ্যে তুলে আনা যায়।
- আমরা অর্জন করলাম কিন্তু ব্যবহারটা করতে পারলাম না। এই আমাদের সবচেয়ে হতাশার জায়গা।
- কেবল দেশের একটা অংশে অনুসন্ধান হযেছে, পূর্বাংশটা। যে ২৭টা ক্ষেত্র আবিষ্কার হয়েছে সবই এই অঞ্চলে। বাকি দুই-তৃতীয়াংশ সমতল ভূমি এবং সাগর বক্ষে অনুসন্ধান হয়নি। পশ্চিম দিকে যে সমতলভূমি, সেখানে যে সম্ভাবনা, তা অনুসন্ধান করা হয়নি। ফলে সেই সম্ভাবনাটা রয়ে গেছে।
- এখন যেটা করা উচিত, গ্যাস অনুসন্ধানের যে ধীরগতি বা দুর্বল গতি তা বদলে দেয়া। এটা যদি বদলে জোরাল করা যায় তাহলে অবস্থার পরিবর্তন হবে। কয়েক বছর পরে হলেও সংকট কেটে যাবে।
এবার একটু বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র নিয়ে কথা বলি। বিবিয়ানার উপর একক এই নির্ভরতা আমাদের জ্বালানি খাতকে ঝুঁকিতে রেখেছে বলে মনে করেন?
অবশ্যই ঝুঁকি। দেশের মোট দৈনিক উৎপাদনের প্রায় ৪৫ শতাংশ গ্যাস আসে বিবিয়ানা থেকে। বড় আকারের এই নির্ভরতা জাতীয় পর্যায়ে দুর্যোগ আনতে পারে।
সম্প্রতি সেখানের কূপ থেকে গ্যাসের পরিবর্তে বালি উঠেছে। বলা হচ্ছে ক্ষমতার বেশি গ্যাস তোলার জন্য বালি উঠেছে। বালি ওঠাটা একটা গ্যাস ক্ষেত্রের জন্য কতটা ক্ষতির?
কোন গ্যাসক্ষেত্র থেকে যদি তার ক্ষমতার বেশি গ্যাস তোলা হয় তাহলে তা ঐ ক্ষেত্রর জন্য ক্ষতিকর। সেটাকে আমরা ওভার প্রডাক্টশন বলি। তাহলে ঐ গ্যাস স্তরের ক্ষতিসাধন হবেই। অনেক সময় বালি এসে কূপের ক্ষতি করতে পারে। আর এই বালি শুধু কূপটিকেই নয়, তা যদি গ্যাস প্রসেস প্ল্যান্টে পৌঁছায় তবে সরবরাহে আরও ব্যাপক বিপত্তি ঘটাতে পারে। এখন আমরা জানি যে, উৎপাদন বাড়ানোর জন্য শেভরণ কিছু দিন আগে ৬ ইঞ্চি টিউব পরিবর্তন করে সাড়ে ৭ ইঞ্চি লাগিয়েছে। এখন এটা ওভার প্রডাকশন কিনা তা যদি খোঁজ করেন তবে পেট্রোবাংলার ওয়েবসাইটে গেলে দেখা যাবে, বিবিয়ানার উৎপাদন ক্ষমতা ১২০ কোটি ঘনফুট। আর উৎপাদন হচ্ছে ১২৭ কোটি থেকে ১৩০ কোটি ঘনফুুট। সেই অর্থে এটা ওভার প্রডাকশন। তবে শেভরণ বলছে, এটা ওভার প্রডাকশন না। শেভরণের কাছে এ বিষয়টা জানতে চেয়েছিলাম, তারা বলছে, এখানে উৎপাদন ক্ষমতা ১৩০ কোটি ঘনফুট। তারা নাকি পেট্রোবাংলাকে কয়েকবার জানিয়েছে।
অতীতে সাঙ্গু গ্যাস ক্ষেত্রও তো অতিরিক্ত উৎপাদনের জন্য বন্ধ হয়েছে।
হ্যাঁ, সে উদাহরণ তো আমাদের সামনে আছেই।
এখন এটা যদি ওভার প্রডাকশন হয়েও থাকে পেট্রোবাংলাও তো মেনে নিচ্ছে। তাদের অনুমোতি ছাড়া নিশ্চয় এই উৎপাদন সম্ভব না। মন্ত্রণালয়ও তো এই বাড়তি উৎপাদনের জন্য সাধুবাদ দিচ্ছে। বিষয়টাকে কীভাবে দেখছেন। বিষয়টা দেখভাল করার জন্য পেট্রোবাংলার দায় আছে কিনা?
এটা তো বটেই। পেট্রোবাংলার অনুমোতি সাপেক্ষেই সে উৎপাদন করে। পেট্রোবাংলার তরফ থেকে এটা খোলসা করা উচিত। তা না হলে কারো জন্যই সুখকর হবে না। আমরা তো অবশ্যই ধরে নেব এটা ওভার প্রডাকশন। এটা আমাদের ঘুম ভাঙানোর ডাক। বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রে মোট ২৬টি উৎপাদন কূপ। তারমধ্যে ৬টি সাময়িক বন্ধ থাকায় যে সংকট হল, যদি ১০টি কূপ বন্ধ হয় কিংবা গ্যাসক্ষেত্রটি বর্তমানের শীর্ষ উৎপাদন অবস্থান থেকে নিচে নেমে যায়, তখন পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে, তা সহজেই অনুমেয়। অদূর ভবিষ্যতে ধীরে ধীরে অথবা হঠাৎ করেই এর উৎপাদন শক্তি হারিয়ে আরও দুর্বল হবে, এটাই বাস্তবতা। বিষয়টা পেট্রোবাংলাকেই পরিষ্কার করতে হবে। নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
ধন্যবাদ আপনাকে।
আপনাকেও ধন্যবাদ।