বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে পাঁচটি সমঝোতা স্মারক সই
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বাংলাদেশে সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে পাঁচটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। এছাড়াও এই বৈঠকে ভার্চুয়ালি বেশ কয়েকটি প্রকল্পের উদ্বোধন করা হয়।
শনিবার ( ২৭শে মার্চ) প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে দুই দেশের সরকার প্রধানের মধ্যে এই বৈঠক। নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে পৌঁছালে কার্যালয়ের টাইগার গেটে নরেন্দ্র মোদিকে স্বাগত জানান শেখ হাসিনা।
প্রথমে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী একান্ত বৈঠকে বসেন। এরপর দুই দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বসেন। দুই দেশের সরকার প্রধানের উপস্থিতিতে বাণিজ্যে অশুল্ক বাধা দূর, তথ্য-যোগাযোগ সহায়তা ও দুর্যোগ মোকাবিলাসহ পাঁচটি সমঝোতা স্মারক সই হয়।
সমঝোতা স্মারকগুলো হলো:
- দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, অভিযোজন ও প্রশমনের ক্ষেত্রে সহযোগিতা
- বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর (বিএনসিসি) এবং ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর অব ইন্ডিয়ার (আইএনসিসি) মধ্যে সহযোগিতা
- বাণিজ্য বিকাশে অশুল্ক বাধা দূর করতে একটি সহযোগিতা ফ্রেমওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করা
- বাংলাদেশ-ভারত ডিজিটাল সার্ভিস অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিং (বিজিএসটি) সেন্টারের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি সরঞ্জাম, কোর্সওয়্যার ও রেফারেন্স বই সরবরাহ এবং প্রশিক্ষণ সহযোগিতা
- রাজশাহী কলেজ মাঠের উন্নয়নে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন
সমঝোতা স্মারক সই ছাড়াও দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে ভার্চুয়ালি বেশ কয়েকটি প্রকল্পের উদ্বোধন করা হয়। যার মধ্যে রয়েছে, ঢাকা ও নিউ জলপাইগুড়ির মধ্যে যাত্রীবাহী ট্রেন সার্ভিস, বাংলাদেশ-ভারত স্বাধীনতা সড়ক। মুক্তিযুদ্ধে যেসব ভারতীয় সৈন্য আত্মাহুতি দিয়েছেন তাদের স্মরণে আশুগঞ্জে একটি সমাধিসৌধ উদ্বোধন করা হয়। এছাড়াও কুষ্টিয়ার শিলাইদহে কুটিবাড়িতে ভারতের অর্থায়নে যে সংস্কার কাজ হয়েছে তারও উদ্বোধন করা হয়।
বৈঠকে বাংলাদেশের কাছে ভারতের ১০৯টি অ্যাম্বুলেন্স হস্তান্তর করেন মোদি। এছাড়া দুটি সীমান্ত হাট এবং স্মারক ডাকটিকিটের মোড়ক উন্মোচন করা হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর আয়োজনে যোগ দিতে শুক্রবার মোদি ঢাকায় আসেন। রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষে শনিবার তিনি যান সাতক্ষীরা ও গোপালগঞ্জে।
গতকাল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মানবসম্পদ ও ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, সন্ত্রাসবাদ অবসান ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রগতিশীল নেতৃত্বে বাংলাদেশের অর্জিত সাফল্যের প্রশংসা করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বাংলাদেশ-ভারত কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উৎসব যৌথভাবে উদযাপনের বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়েও আলোচনা হয়। এ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ২০২২ সালে ভারত সফরের আমন্ত্রণ জানান নরেন্দ্র মোদি। ঐতিহাসিক মুজিবনগর-নদীয়া সড়কটিকে ‘স্বাধীনতা সড়ক’ নামকরণে বাংলাদেশের প্রস্তাবকে স্বাগত জানায় ভারত। তবে পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট ব্যস্ততা ও সময়স্বল্পতার কারণে এখনই সড়কটি উদ্বোধন করা না গেলেও, ভারতীয় পক্ষের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্নের পর যৌথ উদযাপনের অংশ হিসেবে অচিরেই এটি উদ্বোধন করা হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়।
বৈঠকে ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক ভারসাম্য বাংলাদেশের অনুকূলে আনা এবং বাণিজ্য সহযোগিতার ফ্রেমওয়ার্ক স্থাপন নিয়ে আলোচনা হয়। উভয় পক্ষ শুল্ক ও অশুল্ক বাধা অপসারণের ওপর গুরুত্ব দেয়। বাংলাদেশ থেকে পাটজাত পণ্য রফতানির ওপর ২০১৭ সাল থেকে ভারত সরকার আরোপিত অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্ক প্রত্যাহারের অনুরোধ জানানো হয়েছে। স্থলবন্দরগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সুযোগ-সুবিধা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে একযোগে কাজ করার ওপরও দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী জোর দেন।
বাণিজ্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যে আঞ্চলিক কানেক্টিভিটির প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন দুই নেতা। সড়ক, রেল ও নৌপথে মাল্টিমোডাল কানেক্টিভিটির মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির লক্ষ্যে শেখ হাসিনার দূরদর্শী উদ্যোগগুলোর প্রশংসা করেন নরেন্দ্র মোদি। ‘ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড ট্রাইলেটারাল হাইওয়ে প্রকল্পে যুক্ত হতে বাংলাদেশের আগ্রহের কথা ভারতকে জানানো হয়েছে। ‘বিবিআইএন মোটর ভেহিকল এগ্রিমেন্ট’ বাস্তবায়নে বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালের মধ্যে ‘ত্রিদেশীয় এনাবিলিং এমওইউ’ দ্রুত স্বাক্ষরের প্রয়োজনীয়তার ওপর দুই নেতা বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন। ভারতীয় ভূখণ্ড ব্যবহার করে নেপাল ও ভুটানে বৃহত্তর পরিসরে প্রবেশাধিকার চায় বাংলাদেশ। এজন্য বাংলাদেশ নতুন কিছু রুট অনুমোদনের জন্য ভারতকে অনুরোধ জানিয়েছে। এ উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ থেকে নেপালে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে দূরত্ব, সময় ও ব্যয় বহুলাংশে কমবে এবং বাংলাদেশের রফতানি সক্ষমতা বাড়বে। সম্প্রতি উদ্বোধন হওয়া ‘চিলাহাটি-হলদিবাড়ী রেল রুট’ ব্যবহার করে ভুটানের সঙ্গে রেল কানেক্টিভিটি স্থাপনের বিষয়ে বাংলাদেশের আগ্রহের কথাও ভারতকে জানানো হয়েছে। ফেনী নদীর ওপর সম্প্রতি উদ্বোধন হওয়া ‘মৈত্রী সেতু’র কথা উল্লেখ করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে পরিবহন সংযোগ স্থাপনের বিষয়ে বাংলাদেশের উদার সহায়তার জন্য নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান। বৈঠকে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী ‘নিউ জলপাইগুঁড়ি-ঢাকা রুটে’ যাত্রীবাহী ট্রেন সার্ভিস চালুর ঘোষণা দিয়েছেন। মহামারী পরিস্থিতির উন্নয়ন সাপেক্ষে যত দ্রুত সম্ভব বিমান, বাস ও ট্রেনযোগে এবং স্থলবন্দরগুলোর মধ্য দিয়ে ভ্রমণ সুবিধা উন্মুক্ত করে দেয়ার লক্ষ্যে একযোগে কাজ করে যাবে দুই দেশ। কোভিশিল্ড ভ্যাকসিনের দুই মিলিয়ন ডোজ উপহারের জন্য এবং পাঁচ মিলিয়ন ডোজের প্রথম ব্যাচের দ্রুত ডেলিভারির জন্য বাংলাদেশ ভারতকে ধন্যবাদ জানায়। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে কেনা অবশিষ্ট ভ্যাকসিন নিয়মিত সরবরাহের অনুরোধ জানায় বাংলাদেশ।
বৈঠকে যৌথ নদীর পানির ন্যায্য হিস্যার ওপর বাংলাদেশের অলঙ্ঘনীয় অধিকারের বিষয়টি উত্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি তিস্তার পানিবণ্টনের ‘অন্তর্বর্তী চুক্তি’ দ্রুত সম্পাদনের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী মোদি জানান, চুক্তিটি দ্রুত স্বাক্ষরে ভারত আন্তরিকভাবে অঙ্গীকারাবদ্ধ এবং এ বিষয়ে প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। মনু, মুহুরী, খোয়াই, গোমতী, ধরলা ও দুধকুমার—এ ছয়টি ট্রান্স-বাউন্ডারি নদীর পানিবণ্টনের অন্তর্বর্তী চুক্তির ফ্রেমওয়ার্ক চূড়ান্তে কাজ দ্রুত এগিয়ে নিতে দুই দেশের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ‘আপার সুরমা-কুশিয়ারা সেচ প্রকল্পে’ কুশিয়ারা নদীর পানি ব্যবহারের উদ্দেশ্যে রহিমপুর খালের অবশিষ্টাংশ খননের আবশ্যকতার ওপর গুরুত্বারোপ করে ‘কুশিয়ারা নদীর পানি প্রত্যাহারের জন্য প্রস্তাবিত এমওইউ’ স্বাক্ষরে ভারতের দ্রুত সম্মতি কামনা করেছে বাংলাদেশ। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ক্ষেত্রে দু’দেশের মধ্যে বিদ্যমান সহযোগিতা, বিশেষত—নেপাল ও ভুটানকে সঙ্গে নিয়ে উপআঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে।
নিরাপত্তা ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতার বিষয়ে উভয় নেতা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তা বিধানে বাংলাদেশের অকুণ্ঠ সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছে ভারত। সীমান্তে একজন বাংলাদেশীও যেন কোনো কারণেই বিএসএফ কর্তৃক নিহত না হন, সেটি নিশ্চিত করার বিষয়টি উত্থাপন করেন শেখ হাসিনা। সীমান্তে শান্তি, সম্প্রীতি ও স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে ‘কমপ্রেহেন্সিভ বর্ডার ম্যানেজমেন্ট প্লান’-এর আওতায় বিজিবি ও বিএসএফকে ঘনিষ্ঠ সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করা নির্দেশনা দেন দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী।
দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে প্রথাগত এজেন্ডার বাইরে নতুন কিছু ক্ষেত্রে সহযোগিতা সম্প্রসারণের ব্যাপারেও দুই প্রধানমন্ত্রী আলোচনা করেন। এগুলো হলো ডিজিটাল টেকনোলজি এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কাটিং এজ এরিয়া, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, নিউক্লিয়ার প্রযুক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার, উন্নত প্রযুক্তির স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাত এবং বায়ো-সিকিউরিটি হ্যাজার্ড। মহাকাশ ও স্যাটেলাইট গবেষণায় দুই দেশ একযোগে কাজ করে যেতে সম্মত হয়েছে। বাংলাদেশী ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য এক হাজার স্কলারশিপের ঘোষণা দিয়েছে ভারত। এছাড়া রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত বাংলাদেশের অবস্থানকে সমর্থন জানিয়েছে।