বাংলা বাঘের থাবায় ইংলিশ সিংহ বধ

পরাজয়ের ধাক্কা সামাল দিতে হয় বুঝি এভাবেই। তীরে এসে তরী ডোবার হতাশা মুছে দিতে হয় সৈকতে সাফল্যের নোঙর ফেলে! প্রথম ম্যাচে হাতের মুঠো থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল জয়। ভেঙে না পড়ে বাংলাদেশ ফিরল আরও দোর্দণ্ড প্রতাপে। দ্বিতীয় ওয়ানডেতে দারুণ জয়ে জিইয়ে রাখল টানা সপ্তম সিরিজ জয়ের সম্ভাবনা।

দক্ষ নাবিকের মতোই দলকে দিশা দেখিয়েছেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। ব্যাটিংয়ে ধুঁকতে থাকা বাংলাদেশের ইনিংসে প্রাণ ফিরিয়েছেন শেষের ঝড়ে। বল হাতে অসাধারণ এক প্রথম স্পেলে মুড়িয়ে দিয়েছেন ইংলিশ ব্যাটিংয়ের মাথা। শেষে ভাঙলেন বাধা হয়ে দাঁড়ানো শেষ উইকেট জুটিও। অধিনায়কের অলরাউন্ড নৈপুণ্যে বাংলাদেশ জিতল ৩৪ রানে।

রোববার মিরপুর শের-ই-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে টস হেরে ব্যাট করতে নেমে ৮ উইকেটে ২৩৮ রান করে বাংলাদেশ। জবাবে ৪৪ ওভার ৪ বলে ২০৪ রানে অলআউট ইংল্যান্ড।

লক্ষ্য তাড়ায় শুরুতেই দিক হারায় ইংল্যান্ড। বাংলাদেশ শুরু থেকেই ফিল্ডিংয়ে ছিল আক্রমণাত্মক। এক দিক থেকে স্পিনে চাপে রাখেন সাকিব আল হাসান। অন্য দিকে দারুণ লাইন-লেংথে বল করে ইংল্যান্ডের ব্যাটসম্যানদের সামর্থ্যের পরীক্ষা নেন মাশরাফি।

মাশরাফির ফুল লেংথ বল ড্রাইভ করতে গিয়ে ব্যাকওয়ার্থ পয়েন্টে মোসাদ্দেকের ক্যাচে পরিণত হন জেমস ভিন্স। ঝড় তোলার আগেই এলবিডব্লিউ হয়ে বিদায় নেন জেসন রয়। আগের ম্যাচে ক্যারিয়ারের প্রথম শতক পাওয়া স্টোকস এবার ফিরেন শূন্য রানে। মাশরাফির প্রথম স্পেল ৬-০-২১-৩।

শুরু থেকে সাকিবকে দিয়ে টানা সাত ওভার বোলিং করান অধিনায়ক। বিশ্বের অন্যতম সেরা স্পিনার বেধে রাখেন অতিথি ব্যাটসম্যানদের। প্রথম স্পেলে ২৮ রান দিয়ে এক উইকেট নেন সাকিব। তার বলে ব্যাট-প্যাডের ফাঁক গলে শূন্য রানে বোল্ড হন আগের ম্যাচে অভিষেকে অর্ধশতক করা ডাকেট।

২৬ রানে ৪ উইকেট হারানো ইংল্যান্ড প্রতিরোধ গড়ে জনি বেয়ারস্টো ও জস বাটলারের ব্যাটে। বাংলাদেশের দারুণ বোলিংয়ের সামনে দাঁড়াতে পেরেছেন কেবল তারাই। পাল্টা আক্রমণে দ্রুত রান সংগ্রহ করা ৭৯ রানের জুটি ভাঙার কৃতিত্ব তাসকিনের।

প্রান্ত বদল করে নিজের দ্বিতীয় স্পেলে চার ওভারের মধ্যে ৩ উইকেট নিয়ে ইংল্যান্ডের আশা গুঁড়িয়ে দেন এই ডানহাতি পেসার, যার শুরু বেয়ারস্টোকে ফিরিয়ে। অফ স্টাম্পের বাইরের বল তাড়া করে মুশফিকুর রহিমের গ্লাভসবন্দি হন তিনি।

দলে ফেরা নাসির হোসেনের বলে কাভার থেকে দৌড়ে মাথার ওপর দিয়ে আসা দুর্দান্ত এক ক্যাচ নিয়ে মইন আলির বিদায়ে বড় অবদান রাখেন সাকিব।

ইংল্যান্ডের আশা বাঁচিয়ে রাখা বাটলারকে ফিরিয়ে অতিথিদের ম্যাচ থেকে ছিটকে ফেলেন তাসকিন। তার একটু ভেতরে ঢোকা বলে এলবিডব্লিউ দেননি আম্পায়ার। রিভিউ নিতে দেরি করে স্বাগতিকরা। তাতে আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত পাল্টায়, ৫৭ বলে ৭টি চারে ৫৭ রান করে ফিরে যান ইংল্যান্ডের অধিনায়ক।

তাসকিনের পরের ওভারে অফ স্টাম্পের বাইরের বল তাড়া করতে গিয়ে মুশফিককে সহজ ক্যাচ দিয়ে ফিরেন ক্রিস ওকস।

নিজের প্রথম দুই ওয়ানডের মতো এবার প্রথম ওভারেই উইকেট পান মোসাদ্দেক হোসেন। এলবিডব্লিউ করে ফেরান ডেভিড উইলিকে।

১৫৯ রানে নবম উইকেট হারানো ইংল্যান্ড দৃঢ়তা দেখায় দশম উইকেটে। ৬.১ ওভার স্থায়ী ৪৫ রানের জুটিতে দলের সংগ্রহ দুইশ’ রানে নিয়ে যান আদিল রশিদ-জেইক বল। বলকে ফিরিয়ে দলের জয় নিশ্চিত করেন বিধ্বংসী শুরু করা সেই মাশরাফি।

ঝড়ো ইনিংসের পর ২৯ রানে ৪ উইকেট নিয়ে মাশরাফিই ম্যাচ সেরা। তাসকিন ৩ উইকেট নেন ৪৭ রানে।

এর আগে ইংল্যান্ডের শুরুর আঁটসাঁট বোলিংয়ে রানের জন্য লড়াই করতে হয় ইমরুল কায়েস ও তামিম ইকবালকে। প্রথম পাঁচ ওভারে দুই জন খেলেন ২১টি ডট বল।

দুই উদ্বোধনী ব্যাটসম্যানই ফিরেন ওকসের শর্ট বলে। সপ্তম ওভারে লেগ স্টাম্পের বলে হুক করতে গিয়ে ডিপ স্কয়ার লেগে ক্যাচ দেন ইমরুল। পুল করে মিডউইকেটে ধরা পড়েন তামিম।

প্রথম ওভারেই সাফল্য পান গত ম্যাচের সেরা খেলোয়াড় জেইক বল। বাউন্স ঠিকমতো খেলতে না পেরে ব্যাটের নীচের কানায় লেগে বোল্ড হন রানের জন্য সংগ্রাম করতে থাকা সাব্বির রহমান।

৩৯ রানে প্রথম তিন ব্যাটসম্যানকে হারানো বাংলাদেশ প্রতিরোধ গড়ে মাহমুদউল্লাহ ও মুশফিকের ব্যাটে। প্রথম দুই বলেই চার হাঁকানো মুশফিক এই ম্যাচেই বাংলাদেশের তৃতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে পৌঁছান চার হাজার রানে।

হঠাৎ ছন্দ হারিয়ে ফেলা মুশফিক খেলছিলেন দারুণ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে। বলের বলে পুলে গড়বড় করে শেষ হয় তার ২১ রানের ইনিংস। উইকেট ধরে রাখার সঙ্গে রানের গতি বাড়ানো ৫০ রানের এই জুটি ভাঙার পর আবার দিক হারায় স্বাগতিকদের ইনিংস।

আগের ম্যাচে দারুণ এক ইনিংস খেলা সাকিব স্টোকসের লেগ স্টাম্পের বাইরের বলে উইকেটকিপারকে ক্যাচ দিয়ে বিদায় নেন।

তরুণ মোসাদ্দেককে নিয়ে ৪৮ রানের আরেকটি জুটিতে প্রতিরোধ গড়েন মাহমুদউল্লাহ। নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারানো স্বাগতিকরা শেষের ঝড়ের দিকে তাকিয়ে ছিল তার দিকেই। দলকে বিপদে ফেলে ফিরে যান তিনিও।

আদিল রশিদের বলে সুইপ করতে গিয়ে বলে ব্যাট ছোঁয়াতে পারেননি মাহমুদউল্লাহ। আম্পায়ার আউট দেওয়ার পর রিভিউ নিয়েছিলেন; কিন্তু তাতে সিদ্ধান্ত পাল্টায়নি। ৮৮ বলে ছয়টি চারে ৭৫ রান করেন মাহমুদউল্লাহ। দলীয় ১৬১ রানে ষষ্ঠ ব্যাটসম্যান হিসেবে তিনি ফিরে যাওয়ার পরও ক্রিজে ছিল বিশেষজ্ঞ ব্যাটসম্যানদের জুটি।

আগের ম্যাচে শেষটায় তালগোল পাকিয়ে হারা বাংলাদেশ এই ম্যাচে ব্যাটিংয়ে শক্তি বাড়াতে দলে ফেরায় নাসিরকে।  ‘দ্য ফিনিশার’ নামে পরিচিত এই ব্যাটসম্যানকে খুব একটা সঙ্গ দিতে পারেননি মোসাদ্দেক। রশিদের শর্ট বলে বাজে এক শটে ফিরেন এই তরুণ।

১৬৯ রানে প্রথম ৭ ব্যাটসম্যানকে হারানো বাংলাদেশের সামনে দুইশই তখন অনেক দূরের পথ। গত কিছু দিন ধরেই শেষের ব্যাটিংটা মাশরাফি বিন মুর্তজার দুর্ভাবনার ব্যাপার।  সেখান থেকে দলকে বের করে আনতে সামনে থেকেই নেতৃত্ব দিয়েছেন অধিনায়ক। অষ্টম উইকেটে নাসিরের সঙ্গে ৮.১ ওভারে গড়েছেন ৬৯ রানের দারুণ এক জুটি।

মইনের বলে দারুণ দুই ছক্কায় মাশরাফির শুরুটা ছিল ঝড়ো। উইলির এক ওভারে একটি ছক্কা-চারে নেন ১৫ রান। সে সময়ে শান্তই ছিলেন নাসির, অধিনায়ককে যত বেশি সম্ভব স্ট্রাইক দেওয়াতেই ছিল তার মনোযোগ। সেখানে সফলও তিনি।

শেষ ওভারে রান আউট হয়ে শেষ হয় মাশরাফির ৪৪ রানের ইনিংস। ২৯ বলের ইনিংসে দুটি চার ও তিনটি ছক্কা হাঁকান বাংলাদেশের অধিনায়ক। ২৭ বলে দুটি চারে ২৭ রানে অপরাজিত থাকেন নাসির। শেষে এই ঘুরে দাঁড়ানোর পর ম্যাচে আর রোখা যায়নি স্বাগতিকদের।

সংক্ষিপ্ত স্কোর:

বাংলাদেশ: ৫০ ওভারে ২৩৮/৮ (তামিম ১৪, ইমরুল ১১, সাব্বির ৩, মাহমুদউল্লাহ ৭৫, মুশফিক ২১, সাকিব ৩, মোসাদ্দেক ২৯, নাসির ২৭*, মাশরাফি ৪৪, শফিউল ০*; ওকস ২/৪০, বল ২/৪৪, রশিদ ২/৫৩, স্টোকস ১/২২)

ইংল্যান্ড: ৪৪.৩ ওভারে ২০৪ (রয় ১৩, ভিন্স ৫, ডাকেট ০, বেয়ারস্টো ৩৫, স্টোকস ০, বাটলার ৫৭, মইন ৪, ওকস ৭, রশিদ ৩৩*, উইলি ৯, বল ২৮; মাশরাফি ৪/২৯, তাসকিন ৩/৪৭, মোসাদ্দেক ১/৫, নাসির ১/২৯, সাকিব ১/৫০)

ফল: বাংলাদেশ ৩৪ রানে জয়ী

ম্যান অব দ্য ম্যাচ: মাশরাফি বিন মুর্তজা