বাংলা-ভারত অভিন্ন পরিবেশ সমস্যা দূর করুন

বাংলাদেশ ও ভারতের অভিন্ন পরিবেশ সমস্যার সমাধান করার আবেদন করেছে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও বাংলাদেশ পরিবেশ নেটওয়ার্ক (বেন)। এক স্মারকলিপিতে বাপা ও বেন বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে এই আবেদন করে। ২৫শে জুন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বাংলাদেশে আসবেন। এই সফরকে কেন্দ্র করে এই স্মারকলিপি দেয়া হয়েছে। স্মারক লিপিতে আন্তঃসীমান্ত নদী সমস্যা সমাধান যেমন, গঙ্গার উপর ফারাক্কা ব্যারেজ, তিস্তা নদীর উপর ভারতীয় ব্যারেজ, বরাক নদীর উপর টিপাইমুখ বাঁধ, ব্রহ্মপুত্র নদীতে হস্তক্ষেপ, ভারতীয় আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প (আইআরএলপি), আন্তঃসীমান্ত বন্যা প্রবাহ, আন্তঃসীমান্ত দূষণ, নদীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তনের আহবান করা হয়েছে। এছাড়া বন ও সুন্দরবন, সমুদ্র সীমা ও সামুদ্রিক সম্পদরাজি, জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত কৌশল, রেলপথ ও রেল পরিবহনে সহযোগিতা নিশ্চিতকরণ, মুক্ত নদী প্রবাহের শর্তে ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট, তথ্য বিনিময় এবং সার্ক পরিবেশ পরিকল্পনা প্রণয়ন ও শক্তিশালী করার বিষয়ে তাগিদ দেয়া হয়েছে।

স্মারকলিপি
মুখবন্ধ:
ভারত ও বাংলাদেশের রয়েছে এক অভিন্ন নৃ-তাত্ত্বিক অতীত ও সামাজিক-রাজনৈতিক ঐতিহ্য। ১৯৭১ সনের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দুটি দেশের সম্পর্ক আরো শক্তিশালী হয়েছে। আন্তঃসরকার সম্পর্ক ছাড়াও দুই দেশের মানুষের মধ্যেও ব্যাপক ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। উভয় দেশের জাতীয় উন্নয়নের স্বার্থে অধিকতর পারস্পরিক সম্পর্ক একটি অপরিহার্য প্রয়োজনীয় বিষয়।

দূর্ভাগ্যজনকভাবে দুই দেশের মধ্যে বেশকিছু আন্তঃসীমান্ত নদী ও অন্যান্য প্রতিবেশ বিষয়ক সমস্যাদি রয়েছে যার আশু সমাধান প্রয়োজন। বিশেষ করে দুই দেশের মধ্যকার কিছু অভিন্ন নদী বিষয়ে ভারতের গৃহিত কিছু পদক্ষেপই এসবের মূল কারণ। বাংলাদেশ নিম্ন অববাহিকায় অবস্থিত অধিক জনঘনত্বপূর্ণ ব-দ্বীপ ভূমিতলসম্পন্ন একটি দেশ। এ দেশ ইতোমধ্যেই জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি জনিত সংকটের মূখে নিপতিত হয়েছে, আর নদী সমস্যা এ সংকটকে আরো ঘনিভূত করেছে। যদি কোনসময় বাংলাদেশের প্রতিবেশ ও অর্থনীতি জলবায়ু ও পরিবেশ সংকটের ভারে বিপর্যস্ত হয় তবে নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে ভারতও যে ক্ষতিগ্রস্থ হবে তাতে কোনই সন্দেহ নেই। অতএব ভারত ও বাংলাদেশ উভয়ের স্বার্থেই বাংলাদেশের জলবায়ু ও পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে যুথবদ্ধ পদক্ষেপ গ্রহন করা প্রয়োজন।
অতএব আমরা, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও বাংলাদেশ পরিবেশ নেটওয়ার্ক (বেন) এর পক্ষ থেকে এতদ্বারা নিম্নবর্ণিত তালিকাভুক্ত বিষয়াদি বাংলাদেশ ও ভারতের মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীদ্বয় সমীপে পেশ করছি যাতে তারা এসব তাদের মধ্যকার আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করেন ও এসবের পরিবেশ-বান্ধব ও উভয় দেশের জন্যই মঙ্গলজনক সমাধান নিশ্চিত করতে পারেনঃ
অভিন্ন পরিবেশ সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহ:
০১. আন্তঃসীমান্ত নদীসমূহ: বাংলাদেশে আগত ৫৭টি আন্তঃসীমান্ত নদীর মধ্যে ৫৪টির উৎসই ভারতে। এগুলো হিমালয় পর্বতের হিমবাহ ও উজানের এলাকার পাহাড়ী ও সমতলভূমির বৃষ্টিপাতের বিশাল জলরাশি বহন করে চলেছে। এসব নদীর ভারতীয় উজান অংশে বাঁধ, ব্যারেজ, ও অন্যান্য অবরোধমূলক অবকাঠামো এখন বাংলাদেশের নদীসমূহের প্রধান সমস্যা। গঙ্গা নদীর উপর ফারাক্কা আর তিস্তার উপর গাজলডোবা ব্যারেজ দুটিই এসকল নদী-বিভক্তিমূলক অবকাঠামোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ। তবে এর বাইরেও আরো অনেক নদীর উপর ভারতীয় অবকাঠামো রয়েছে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে: দুধকুমারী, খোয়াই, সুমেশ্বরী, মণু, গোমতি, মুহুরি ও ধরলা নদী। তা ছাড়াও উজান এলাকায় বন উজার, খনিজ অনুসন্ধান ইত্যাদির ফলে অজস্র পাথরের টুকরা, মাটি, বালু, কয়লার কাদা প্রভৃতি বাংলাদেশমুখী নদীগুলোর পানিতে এসে মিশ্রিত হয়ে নদীর প্রবাহে বিঘœ ও দূষণ ঘটাচ্ছে। শেষ বিষয়টি হচ্ছে: উজানের শিল্প-দূষণ, আবাসন বর্জ্য ও গবাদিপশুর বিষ্ঠার মিশ্রণ নদীসমূহের প্রভূত দূষণ সৃষ্টি করছে। এসকল সাধারণ অনুষঙ্গের প্রেক্ষাপটে, আমরা নি¤œবর্ণিত সুনির্দ্দিষ্ট বিষয়াদির প্রতি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষন করছিঃ
(ক). গঙ্গার উপর ফারাক্কা ব্যারেজ: বাংলাদেশের দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলের নদী, খাল ও জলাশয়সমূহের উপর ফারাক্কা বাঁধের ধ্বংসাত্মক প্রভাব পড়েছে। বর্তমানে দেশের মৃতপ্রায় ২৫টি নদীর মধ্যে অধিকাংশই এ এলাকার। ফারাক্কা ব্যারেজের ফলে সৃষ্ট পদ্মার স্বল্প পানিপ্রবাহ উল্লেখিত নদীগুলোর পূনঃসঞ্জীবন পরিকল্পনা সফল না হওয়ার প্রধান কারণ। পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, ফারাক্কা ব্যারেজ স্থাপনের পক্ষে ভারতের পক্ষ থেকে কলকাতা সমুদ্রবন্দরের নাব্যতা বৃদ্ধির যে যুক্তি দেয়া হয়েছিল তা শেষ পর্যন্ত যথার্থ বলে প্রমানিত হয়নি। বরং তার পরিবর্তে ফারাক্কা এখন পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের কতিপয় এলাকায় নিয়মিত বন্যার সৃষ্টি করছে। গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায় যে, সেখানকার ক্ষতিগ্রস্থ জনগন হাতে হাতুরি নিয়ে ফারাক্কা ব্যারেজ অবিলম্বে ভেঙ্গে দেয়ার দাবীতে প্রায়ই মিছিল করে থাকেন। গঙ্গার পানিবন্টন বিষয়ে ১৯৯৬ সনে স্বাক্ষরিত ভারত-বাংলাদেশ চুক্তি, ফারাক্কার ব্যারেজের ফলে বাংলাদেশের যে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে তার কোন মৌলিক সমাধান দিতে পারেনি। আসলে বাংলাদেশের দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলের নদী ও প্রতিবেশ বাঁচিয়ে তোলার ক্ষেত্রে পদ্মা নদীর শীতকালীন ক্ষীণ প্রবাহ অত্যন্ত অপ্রতুল, অকার্যকর এক জলধারা।
(খ). তিস্তা নদীর উপর ভারতীয় ব্যারেজ: ভারত তিস্তা নদীর পানি সরিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে তার সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গীয় অংশে এই নদীর উপর বেশ কয়েকটি ব্যারেজ স্থাপন করেছে। এসকল ব্যারেজ তিস্তানদীর পানির পরিমান এতটাই হ্রাস করেছে যে, বিশেষতঃ শীতকালে স্বল্পপ্রবাহের সময় বাংলাদেশের জন্য আদতে কোন পানিই থাকেনা। বিশেষ করে এবছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে তিস্তা নদী পানি শুন্য হয়ে পড়ে, যার কারণ হিসেবে তিস্তার পানি পশ্চিমবঙ্গের মহানন্দা ও বিহারের মেচি নদীতে প্রেরণের অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, যা আসলে একটি আন্ত:অববাহিকা-পানি অপসারণ প্রক্রিয়া এবং তা ভারতীয় আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্পের একটি অংশ মাত্র। আমরা জানি ২০১১ সালে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের সময় তিস্তা নদীর পানি বন্টন নিয়ে দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তি চুড়ান্ত পর্যায়েই প্রস্তুত রাখা হয়েছিল, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আপত্তির মুখে সেই চুক্তিটি তখন স্বাক্ষরিত হয়নি। তবে গঙ্গার পানি নিয়ে ভারত-বাংলাদেশের চুক্তির অভিজ্ঞতায় বলা যায়, তিস্তার উপর নির্মিত সকল ভারতীয় ব্যারেজ অপসারণ করে তিস্তা নদীর প্রবাহ পুনরুদ্ধার না করা পর্যন্ত উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় বাংলাদেশের নদী ও পরিবেশের কোন প্রকার উন্নতি সাধিত হবেনা।
(গ). বরাক নদীর উপর টিপাইমুখ বাঁধ: সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, ভারত বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে বরাক নদীর উপর টিপাইমুখ বাঁধ নির্মানের কাজে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে অনেকের মতে এই বাঁধটিও টিপাইমূখের একটু ভাটিতে তাদের সম্ভাব্য নদী বিভক্তিমূলক ফুলেরতল ব্যারেজে পরিকল্পনারই একটি অংশ হবে। অতএব টিপাইমুখ বাংলাদেশের মানুষের জন্য এক বড় দুঃশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারণ তা বাংলাদেশের দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নদী সুরমা ও কুশিয়ারার প্রবাহে মারাত্মক বিঘœ ঘটাবে। সুরমা ও কুশিয়ারা নদী আবার এক হয়ে বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম নদী মেঘনার সৃষ্টি করেছে। টিপাইমুখ বাঁধ, বৃহদাকার ও পরিবেশের জন্য স্পর্শকাতর জলাশয়- হাওর সহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বাংলাদেশের প্রতিবেশ ও অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্থ করবে। অতএব, যখন টিপাইমুখ বাঁধকে অনেকেই বাংলাদেশের জন্য ‘উত্তরাঞ্চলের ফারাক্কা’ বলে অভিহিত করেন তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই এবং এ বিষয়ে বাংলাদেশের জনমানুষের সচেতন অনুভূতি ও আবেগ বেশ তুঙ্গে। সুতরাং অনতিবিলম্বে টিপাইমুখ বাঁধ পরিকল্পনা ভারতের বাতিল করা উচিৎ।
(ঘ). ব্রহ্মপুত্র নদীতে হস্তক্ষেপঃ ফারাক্কার কারণে পদ্মার পানি হ্রাস পাওয়াতে ব্রহ্মপুত্রই বাংলাদেশের পানির প্রধান উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। বস্তুতঃ বাংলাদেশের ভূ-উপরিস্থিত জলরাশির সত্তর শতাংশই ব্রহ্মপুত্রের সূত্রে প্রাপ্ত। অতএব বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সেচের পানির জন্য উত্তর-পূর্ব ভারতের অরুণাচল, আসাম, মেঘালয় ও মণিপুরে ব্রহ্মপুত্র নদী, তার বিভিন্ন উপনদী ও শাখানদীর উপর ভারত সরকারের কথিত ১৪৮টি বাঁধ ও ব্যারেজ নির্মানের কথা সর্বজনবিদিত। ব্রহ্মপুত্র আববাহিকায় এধরণের ব্যাপক হস্তক্ষেপ বাংলাদেশের উপর শুধুমাত্র একটি মহাদূর্যোগই নিশ্চিত করবে। উত্তর-পূর্ব ভারতের এতসব বাঁধ নির্মানের পরিকল্পনা বিশেষ করে অত্র এলাকার ভূ-তাত্বিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে অতি গুরুত্বপূর্ণ, অন্ততঃ বৃহৎ ভূ-কম্পনের ফলে বাঁধের ভাঙ্গন ও তার ফলশ্রুতিতে সর্বনাশা বিপর্যয়তো এক অবধারিত সম্ভাবনা। পত্রিকান্তরে প্রকাশ যে, চীনের কেন্দ্রীয় ও উত্তরাঞ্চলে দিকে পানি সরিয়ে নেয়ার মানসে দেশটি তার এলাকাভুক্ত ব্রহ্মপুত্রের উপরিভাগে (যেখানে তা সাঙপু নদী নামে পরিচিত) বাঁধ নির্মানের পরিকল্পনা করছে। এই নদী-বিভাজক চৈনিক পরিকল্পনাটি বাস্তবায়িত হলে ভারত ও বাংলাদেশ উভয়েরই ব্রহ্মপুত্র থেকে প্রাপ্য পানির পরিমান হ্রাস পাবে। ভারত ও চীন উভয়েরই আন্তর্জাতিক নদীসমূহের উপর সকল প্রকার পানিপ্রবাহ বিভাজক পরিকল্পনা পরিত্যাগ করা উচিৎ।
(ঙ). ভারতীয় আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প (আইআরএলপি)ঃ বাংলাদেশের মানুষ, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি দক্ষিন ও পশ্চিম ভারতের দিকে প্রেরণের উদ্দেশ্যে প্রণীত ভারতীয় আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বা আইআরএলপি নামক এক বিশাল নদী অবরোধমূলক প্রকল্পের খবরেও আশঙ্কাগ্রস্থ হয়ে আছে। এমনকি অনেক ভারতীয় পানি বিশেষজ্ঞ বলেছেন যে, এধরণের প্রকল্প অত্র উপমহাদেশের বিদ্যমান ভৌত ভূমি-চরিত্রের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ, যার ফলে অত্র এলাকায় পরিবেশ দূর্যোগ নেমে আসবে এবং তা হবে বেশ সম্পদহানিকর। নিঃসন্দেহে এই প্রকল্প, বাংলাদেশের সকল প্রধান নদীর পানি সরিয়ে নেয়ার মাধ্যমে দেশটির সম্পূর্ণ টুঁটি চেপে ধরার কাজটি সম্পন্ন করবে। ভারতের উচিৎ আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প ধারণাটি সম্পূর্ণ বাতিল করা।
(চ). আন্তঃসীমান্ত বন্যা প্রবাহঃ নদী বিভাজন ছাড়াও আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোর আরো কিছু সমস্যা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে: ভারতের উত্তর-পূর্বঞ্চলীয় এলাকা থেকে আগত আকস্মিক বন্যা যার পানিতে রয়েছে বিশাল পরিমানের বালু, পাথরের টুকরো, কয়লার কালো পানি, গুড়ামাটি ইত্যাদি এবং সেগুলো দ্বারা পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশী এলাকাকে প্লাবিত করছে। বৃহত্তর সিলেট এবং বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও কুমিল্লার কিছু স্থানের জন্য এটি বেশ বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই আকস্মিক বন্যার তোড়ে বয়ে আনা রাবিশ ময়লা যাদুকাটাসহ বেশ কটি নদী ভরাট করে দিচ্ছে। এসব ময়লা ও বালুর চাপে সেখানকার বিশাল এলাকার কৃষি জমি চাষাবাদের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। এই ক্ষতিকর প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হলে বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা ভারতীয় রাজ্যসমূহের নদীর পাড় ও তাদের প্রবাহ-এলাকায় অপরিকল্পিত কয়লা উত্তোলন, বন উজাড় ও পাহাড় ন্যাড়াকরণ এবং অন্যান্য পরিবেশ বিধ্বংসী কার্যকলাপ বন্ধ করতে হবে।
(ছ).আন্তঃসীমান্ত দূষণঃ সীমান্ত অতিক্রান্ত নদী দিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে আগত আন্তঃসীমান্ত দূষণ এখন মারাত্মক সমস্যার রূপ ধারণ করেছে। আবাসন বর্জ্যরে সাথে পশুর মৃতদেহ ইত্যাদির সমন্বয়ে চিরাচরিত ময়লার সাথে বর্তমানে যুক্ত হচ্ছে শিল্পবর্জ্য। নদীপথে বয়ে আসা দূষণ প্রক্রিয়া এখন আর গঙ্গার মত কিছু বৃহৎ নদীতে সীমাবদ্ধ নেই বরং এটি এখন সকল নদীতেই বিস্তৃত হচ্ছে। যেমন: আগরতলার ময়লা সালদা নদীতে, রামগড়ের ময়লা ফেনী নদীতে এসে যুক্ত হচ্ছে। যাদুকাটা নদী ঘেঁষা মেঘালয় থেকে আসা বর্জ্যের মত কোন কোন ময়লার সাথে ক্ষতিকর ত্যাজষ্ক্রিয় উপাদানও থাকছে। ভারতের পক্ষ থেকে এসকল আন্তঃসীমান্ত দূষণ বন্ধ করা অতি জরুরী করণীয় বিষয়।
(জ). নদীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গীঃ উপরোল্লে­খিত বাঁধ, ব্যারেজ ও প্রকল্প সবগুলোই নদীর প্রতি ‘বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গী’ থেকে সৃষ্ট আচার আচরণ। এই দৃষ্টিভঙ্গীর মূলকথা হচ্ছে যেকোন সমুদ্রগামী নদীর পানিই হচ্ছে ‘অপচয়’ অতএব নদীর সমন্ত পানিই ব্যবহার করতে হবে। এই দৃষ্টিভঙ্গীটি দীর্ঘদিন যাবৎ একটি জনপ্রিয় ধারণা হিসেবেই বিদ্যমান ছিল, কারণ এটি ছিল আধুনিকতার সমার্থক। তবে সময়ের ব্যবধান ও অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, নদীর প্রতি এ ধারণাটি ছিল একটি ভুল এবং দীর্ঘ মেয়াদ ও বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে তা প্রতিবেশ, অর্থনীতি ও জনমানুষের জন্য আসলে ক্ষতিকর। এই ধারণাটি অভিন্ন নদী ব্যবহারকারী বিভিন্ন জাতি ও এলাকার মধ্যে সংঘাতের প্রধান কারণ। তাই ভারতের এই নীতিভিত্তিক নির্মিত বা পরিকল্পিত ফারাক্কা, গাজলডোবা, টিপাইমূখ ইত্যাদি অবকাঠামো বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্থ করেছে ও তার উন্নয়নের পথে বড় বাধা হিসেবে কাজ করেছে। একইভাবে সাঙপু নদীতে চীনের বাঁধ নির্মান ও তার উত্তরাঞ্চলে পানি সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা চীন, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়ণের অতিরিক্ত কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অতএব বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গী পরিত্যাগ ও তার পরিবর্তে নদীর প্রতি ‘প্রাকৃতিক দৃষ্টিভঙ্গী’ অনুসরণ করা অত্যন্ত জরুরী। ‘প্রাকৃতিক দৃষ্টিভঙ্গী’র ধারণাটিতে নদী প্রবাহের গতিপথ ও পানির পরিমান সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে উৎসাহিত করা হয়, আর নদীর মধ্যে কোন প্রকার অবকাঠামো নির্মানকাজকে নিরুৎসাহিত করা হয়। এটিতে স্বল্প পানি প্রবাহের সময় নদীর জন্য ‘ন্যূনতম পরিমান’, নিরবিচ্ছিন্ন স্রোতধারা ও নদীর মধ্যকার প্রাকৃতিক মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী তথা জীব-বৈচিত্রের জন্য প্রয়োজনীয় জলাধারকে নিশ্চিত রাখার কথা বলা হয়। সামুদ্রিক পরিবেশ রক্ষার লক্ষ্যে সমুদ্রগামী নদীর পানিপ্রবাহকে অক্ষুন্ন ও নিরবিচ্ছিন্ন রাখা জন্যও নদীর প্রতি প্রাকৃতিক দৃষ্ঠিভঙ্গী অত্যন্ত জরুরী। এই নীতিটি সীমান্ত অতিক্রান্ত নদীসমূহকে নদী অববাহিকার সকল জাতি ও এলাকার মধ্যেকার সংঘাতের কারণ থেকে সরিয়ে নিয়ে বরং বন্ধুত্বের উৎসে পরিণত করে। উপমহাদেশের বৃহত্তম দেশ হিসেবে অত্র অঞ্চলের সকল দেশে বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গী পরিত্যাগ করে নদীর প্রতি প্রাকৃতিক দৃষ্টিভঙ্গী অনুসরণের নীতি গ্রহনের ক্ষেত্রে ভারতেরই নেতৃত্ব প্রদান করা উচিৎ। অত্র অঞ্চলের নদী রক্ষা কর্মীগন ঐক্যবদ্ধভাবে নদীর প্রতি বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গী পরিত্যাগ ও প্র্রাকৃতিক দৃষ্টিভঙ্গীর নীতিকে গ্রহন করেছেন। এখন সময় এসেছে অত্র এলাকার সরকারী নেতৃবৃন্দকে নদীরক্ষা বিষয়ক এই জনদাবীর যৌক্তিকতাকে নির্মোহভাবে অনুধাবন, এটিকে গ্রহন ও নিজ নিজ দেশে তার বাস্তবায়নে উদ্যোগী হওয়া। আসন্ন ভারত-বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকটি এই লক্ষ্যে একটি বৃহৎ পদক্ষেপ হিসেবে কাজ করতে পারে। “নৌ-চলাচল বহির্ভূত আন্তর্জাতিক নদীর পানি প্রবাহ ব্যবহার বিষয়ক জাতিসঙ্ঘ কনভেনশন ১৯৯৭” ইতিমধ্যেই নূন্যতম ৩৫-টি সদস্য রাষ্ট্রের অনু-সমর্থনের পর সকলের জন্য আগামী আগস্ট ২০১৪ থেকে বাধ্যতামুলক আইন হিসেবে পরিনত হতে যাচ্ছে। এই কনভেনশন (আইন)টি নদীর প্রতি প্রাকৃতিক দৃষ্টিভঙ্গীর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিধায় ভারত ও বাংলাদেশ এটিতে অবিলম্বে অনু-সমর্থন ও তা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহন এবং অন্যান্য দেশকেও এটি গ্রহনে উৎসাহিত করা উচিৎ।
০২. বন ও সুন্দরবনঃ
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে শুধু অভিন্ন নদীই রয়েছে তা নয়। এই দুটি দেশের মধ্যে আরো কিছূু গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সম্পদ রয়েছে, যেমন সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বন, বাংলাদেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তের পাহাড়ী বন। এ সকল বন বেশ জীব-বৈচিত্র সমৃদ্ধ ও এতে অনেক জাতিগত সংখ্যালঘু বসবাস করেন। এসকল প্রতিবেশগত সম্পদ সংরক্ষণ ও প্রতিপালন করা এবং এখানে ঐতিহ্যগতভাবে বসবাসকারী সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর অধিকার সংরক্ষণ ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ দায়িত্ব। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে যে, বর্তমানে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে এতদবিষয়ে উল্লেখযোগ্য কোন সহযোগিতামূলক কার্যক্রম পরিলক্ষিত হচ্ছেনা। অথচ সম্ভাব্য জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতার প্রেক্ষাপটে বর্তমান সময়ের জন্য এধরনের সহযোগিতামূলক প্রয়াস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আগামীকাল অনুষ্ঠেয় বাংলাদেশ-ভারত পররাষ্ট্র মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক আমাদের অভিন্ন ম্যানগ্রোভ বন ও পাহাড়ী বন সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় সহযোগিতামূলক প্রক্রিয়ায় অর্থবহ অগ্রগতি সাধন করা যেতে পারে। বাংলাদেশ ও ভারত তাদের প্রাকৃতিক বনে বিদেশী প্রজাতি প্রবেশ বা সাযুজ্যবিহীন গাছের প্রবেশ প্রতিরোধে যৌথ পরিকল্পনা গ্রহন করতে পারে। এতদবিষয়ে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগে খুলনার রামপালে ১৩২০ মেগা ওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম কয়লা ভিত্তিক তাপবিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনায়ও বাপা ও বেন এখন শংকা অনুভব করছে। এই বিদ্যুত কেন্দ্র থেকে উদ্গারিত বিভিন্ন প্রকার গ্যাসীয় ও অন্যান্য বর্জ্য প্রস্তাবিত স্থান থেকে মাত্র সাত মাইল দূরে অবস্থিত সুন্দরবনের সমূহ ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। অতএব বাপা ও বেন বাংলাদেশ সরকারের এই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বর্তমান স্থানটির বদলে অধিকতর নিরাপদ অন্য একটি স্থানে সরিয়ে নেয়ার অনুরোধ জানাচ্ছে। বাপা ও বেন আশা করছে যে, ভারতও এই স্থান বদলের যৌক্তিকতাকে অনুধাবন করবে।
০৩. সমুদ্র সীমা ও সামুদ্রিক সম্পদরাজিঃ
প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কিছু সীমান্ত সংক্রান্ত সমস্যা রয়েছে এবং তা সমুদ্র সীমার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাই বঙ্গোপসাগরে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আন্তর্জাতিক সমুদ্র সীমানা বিষয়ে কিছু ভিন্নমতও রয়েছে। সুতরাং নিজস্ব আইনী সীমানার মধ্যে জ্বালানী, মৎস, ও অন্যান্য সম্পদ আহরণের স্বার্থে বাংলাদেশ ও ভারত উভয়েই তাদের সমুদ্র সীমানার বিরোধ বিদ্যমান আন্তর্জাতিক রীতিনীতি, ঘোষনা, প্রস্তাব ও আইনাবলী এবং পারস্পরিক সম্মানের ভিত্তিতে মিটিয়ে ফেলতে পারে। জাতিসঙ্ঘ নির্ধারিত এসংক্রান্ত ‘ইউএন ক্লজ-০৩’ নীতিমালার ভিত্তিতেই এই সমুদ্র সীমান্ত বিরোধ মিমাংসিত হওয়া উচিৎ – যাতে বলা হয়েছে যে, যে কোন সমুদ্রের তলার মালিক হবে সেই পার্শ্ববর্তী দেশ যার মধ্য দিয়ে বয়ে আসা পলিমাটি দিয়েই এই সমুদ্রতলের সৃষ্টি হয়েছে।
০৪. জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত কৌশলঃ
বাংলাদেশ ও ভারতসহ সমগ্র বিশ্বসম্প্রদায়ের জন্যই জলবায়ু পরিবর্তন একটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দীর্ঘমেয়াদী চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের ভূমির স্বল্প উচ্চতা, জনঘনত্ব, ঘূর্ণিঝড় প্রবন এলাকায় অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকটের অন্যতম প্রধান দেশ বলে পরিগণিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে ভারত জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী গ্রীণহাউজ গ্যাস এর অন্যতম ‘সর্বাধিক উৎপাদক’ দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সুতরাং জলবায়ু পরিবর্তন জনিত বিপদ মোকাবিলায় বাংলাদেশের জন্য ভারতীয় সহায়তা প্রয়োজন। প্রথমতঃ জলবায়ু পরিবর্তন বৃদ্ধি ঠেকানোর জন্য ভারত আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গ্রীণহাউজ গ্যাস উৎপাদন হ্রাসে শক্তিশালী নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করতে পারে। দ্বিতীয়তঃ ভারত প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন জনিত সমস্যা ন্যূনতম পর্যায়ে রেখে তার সাথে টিকে থাকায় বাংলাদেশকে সাহায্য করতে পারে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পন্থা যার মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশকে সাহায্য করতে পারে, তা হচ্ছে: অভিন্ন নদীসমূহের উপর তাদের নির্মিত সকল বাঁধ ও ব্যারেজ খোলে দেয়া, যাতে নদীগুলোর মুক্ত পানি প্রবাহ পূনঃস্থাপিত হয়। নদীর পূর্ণ প্রবাহ ও তার সাথে বয়ে আনা পলিমাটি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমুদ্র স্ফীতি ও জমির লবনাক্ততা রোধে সহায়ক হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট সাংবৎসরিক নদী প্রবাহে ভারসাম্যহীনতা নিয়ন্ত্রণে, মুক্ত নদীগুলো সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। সুন্দরবন রক্ষায় দুই দেশের সহযোগীতা, জলবায়ূ পরিবর্তনজনিত চরম আবহাওয়ার মাত্রা ও সংখ্যা হ্রাসে সহায়ক হবে। ভারত ও বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমণ ও প্রতিরোধে এরকম আরো অনেক কিছুই করণীয় বিষয় রয়েছে। তারা বাংলাদেশে একটি ‘জাতিসংঘ জলবায়ু কেন্দ্র’ স্থাপনের দাবী জানাতে পারে। আগামীকালের বাংলাদেশ ও ভারত পররাষ্ট্র মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকেই জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় যৌথ ও সহযোগিতামূলক কর্মসূচি গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে।
০৫. রেলপথ ও রেল পরিবহনে সহযোগিতা নিশ্চিতকরণঃ
আগামীকাল ভারত-বাংলাদেশ আলোচনা দুই দেশের অভ্যন্তরে ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় রেল যোগাযোগ উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহন করতে পারে। বিশেষ করে বাংলাদেশ পৃথিবীর বৃহত্তম রেলপদ্ধতির কাছ থেকে দক্ষ রেল চলাচল, ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন-অভিজ্ঞতায় অনেকভাবে উপকৃত হতে পারে। বাংলাদেশের গণমূখী ও পরিবেশবান্ধব উন্নয়নকর্মে অতীতে তার রেলপথ নিয়ামক ভূমিকা পালন করলেও, বিগত কয়েক দশকে তার রেল যোগাযোগকে যথেষ্ঠই অবহেলার শিকার হতে হয়েছে। আমরা আশা করি যে, এবারের বৈঠকেই বাংলাদেশ তার রেলপথ ও পরিবহনে একটি পূনঃজাগরণ ও উন্নতি সাধনে ভারতীয় সহযোগিতা লাভের প্রচেষ্টা গ্রহন করবে।
০৬. মুক্ত নদী প্রাবহের শর্তে ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট ঃ
পরস্পরের জন্য সুবিধাজনক প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ ও ভারত তাদের মধ্যকার ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট বিষয়সমূহের সমাধান করে নেয়া উচিৎ। বিশেষ করে, যথাযথ আর্থিক ফি ও প্রাপ্যতা এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার অতিরিক্ত হিসেবে বাংলাদেশ সঙ্গতভাবেই ‘বিনিময় ভিত্তিক প্রত্যর্পন’ নীতিতে ভারতকে ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা প্রদানের শর্ত হিসেবে অভিন্ন নদীসমূহের উপর নির্মিত, পানি প্রবাহ বিভাজনকারী ভারতীয় অবকাঠামোসমূহের অপসারণ দাবী করতে পারে। বাংলাদেশের মানুষ এরকম একটি সমাধান প্রক্রিয়াকে অত্যন্ত ইতিবাচক হিসেবে গ্রহন করবে এবং ভারতকে এসব সুবিধা প্রদানের ফলে দেশের মধ্যে সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াও প্রশমিত থাকবে। তবে বাংলাদেশকে তার নিজস্ব প্রয়োজনে একটি বিস্তৃত ‘ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা’ প্রণয়ন ও তার প্রেক্ষাপটে ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্টকে বিবেচনা করতে হবে।
০৭. তথ্য বিনিময়ঃ
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ভুল বোঝাবোঝি প্রশমণ ও সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি কার্যকর পদ্ধতি হচ্ছে তথ্য বিষয়ে খোলামেলা অবস্থান। দূর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, ভারত অভিন্ন অনেক নদীর উপর তার স্থাপিত বা পরিকল্পিত অবকাঠামো বিষয়ে তথ্য প্রদানে যথেষ্ট অনাগ্রহী। অতি সাম্প্রতিক উদাহরণ হচ্ছে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প ও টিপাইমুখ বাঁধ। এসব বিষয়ে তথ্যপ্রাপ্তি বাংলাদেশের মানুষের জন্য বেশ কষ্টকর বিষয়। সু-ভবিষ্যৎ ও সর্ব-উপযোগী পরিবেশের স্বার্থে উভয় দেশই অভিন্ন পরিবেশ সংক্রান্ত সকল তথ্যের ভাগাভাগির নীতি গ্রহন করতে পারে। বিশেষ করে বাংলাদেশ এবং ভারত বন্যা ও নদী প্রবাহ, ঘূর্ণিঝড়, দুই দেশের মধ্যকার অভিন্ন বনের উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতির আন্তঃসীমান্ত আদান-প্রদান প্রভৃতি বিষয়ে যথা সময়ে যথোপযুক্ত তথ্য ভাগাভাগি হতে পারে। এ দুটি দেশ পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একটি অভিন্ন পরিবেশগত লক্ষ্যও নির্ধারণ করতে পারে।
০৮. সার্ক পরিবেশ পরিকল্পনা প্রণয়ন ও শক্তিশালীকরণঃ
বাংলাদেশ ও ভারত, অত্র এলাকার জলবায়ু পরিবর্তন ও অন্যান্য অভিন্ন পরিবেশ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে একটি আঞ্চলিক সার্ক পরিকল্পনা প্রণয়নে যৌথ প্রয়াস গ্রহন করতে পারে।
উপসংহারঃ
দুই প্রতিবেশী দেশের পরিবেশ ও মানুষ রক্ষার জন্য আসন্ন পররাষ্ট্র মন্ত্রী পর্যায়ের সভাকে উপরোল্লেখিত বিষয়সমূহ অর্জন বা বাস্তবায়নে বাপা ও বেন বাংলাদেশ ও ভারতের মাননীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রীদ্বয়কে অনুরোধ জানাচ্ছে। বিশেষতঃ বাপা ও বেন আশাবাদী যে, উচ্চ পর্যায়ের এই বৈঠকটি বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গী ত্যাগ করে নদীর প্রতি প্রাকৃতিক দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহন, গাজলডোবা, ফারাক্কা ও অন্যান্য অবকাঠামো অপসারণের মাধ্যমে সকল সীমান্ত অতিক্রান্ত নদী প্রবাহের পূনরুজ্জীবন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করবে। বাংলাদেশকে অবশ্যই যথোপযুক্ত ফি ও নিরাপত্তাসহ ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট এর পরিবর্তে ভারতের নিকট সকল সীমান্ত অতিক্রান্ত নদীর পূর্ণ পানি প্রবাহ দাবী করতে হবে। সর্বোপরি বাপা ও বেন আশা করছে যে, এ বৈঠকের মধ্য দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের সংকট মোকাবিলায় একটি সহযোগিতামূলক প্রক্রিয়ার সূত্রপাত হবে।

(বাংলাদেশ ও ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রী সমীপে বাপা ও বেন কর্তৃক পেশকৃত দুই দেশের মধ্যকার অভিন্ন পরিবেশগত সমস্যাদি বিষয়ক ইংরেজী স্মারকলিপি, ২৪ জুন ২০১৪ এর মূল অংশের বঙ্গানুবাদ)