বাইডেনের লিডার্স সামিট: উষ্ণতা কমানোর নতুন সম্ভাবনা

কাওসার রহমান:

প্যারিস চুক্তির পর জলবাযু পরিবর্তন নিয়ে বিশ্ব নেতৃত্বের মধ্যে বেশ উৎসাহ তৈরি হয়েছিল। কারণ বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় গ্রীণ হাউস গ্যাস নিঃসরণকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্রে সেই চুক্তিতে সই করেছিল। পৃথিবীর বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে সম্মত হয়েছিল বিশ^।
কিন্তু মার্কিন ক্ষমতায় পটপরিবর্তনে জলবায়ু আলোচনায় ভাটা পড়ে। ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরপরই প্যারিস চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। ফলে গত চার বছর প্যারিস চুক্তি লক্ষ্যহীনভাবে চলেছে। এতে ওই চুক্তিতে যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল তা থেকেও বিশ্ব অনেক পিছিয়ে পড়েছে।
প্যারিস চুক্তিকে আবার সঠিক পথে নিয়ে আসার জন্য একটি জোরাল রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। সেই উদ্যোগটিই নিয়েছেন নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। নির্বাচনী প্রতিশ্রæতি অনুযায়ী রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেই প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে ফিরে যান। সেইসঙ্গে ওবামা প্রশাসনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিকে তার জলবায়ু বিষয়ক বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ দেন। জন কেরি প্রেসিডেন্ট ওবামার পক্ষে প্যারিস চুক্তির বিষয়ে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চারটি সুপারিশ করেছেন।
জলবায়ু পরিবর্তন আলোচনায় বর্তমানে সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি। কারণ ইতোমধ্যে এই উষ্ণতা বৃদ্ধি প্রাক-শিল্প যুগের চেয়ে ১ দশমিক ২ ডিগ্রী সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে যখন বিশ্বের সমস্ত অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাÐ স্থবির হয়েছিল সেই ২০২০ সালেও বিশ্ববাসী তৃতীয় সর্বোচ্চ উষ্ণ বছর পার করেছে।
গত জানুয়ারি মাসে ১২ লাখ মানুষের ওপর করা জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচী (ইউএনডিপি) ও যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ডের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কিত একটি সমীক্ষায়ও বলা হয়েছে, করোনা মহামারীর চেয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি এখনও তাৎপর্যপূর্ণ। অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে এখন দ্রæত সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে এবং বরফ গলছে। সেই সঙ্গে জীবজন্তুর আবাসস্থল বদলাচ্ছে।
জো বাইডেনের লিডার্স সামিটের লক্ষ্য এই সমস্যা সমাধান করা। বাইডেন চাইচ্ছেন সমন্বিতভাবে এমন পদক্ষেপ নেয়া, যাতে ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বে কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনা যায়। এই মুহূর্তে জলবায়ু নিয়ে মূল আলোচ্যও ‘জিরো এ্যামিশন’। জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয় থেকে ধরিত্রীকে রক্ষার আর বিকল্প নেই। এ জন্য স্বল্পমেয়াদী, মধ্যমমেয়াদী এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করে আগাতে হবে। ২০২১ থেকে ২০৩০ স্বল্পমেয়াদী। ২০৩১ থেকে ২০৪০ মধ্যমমেয়াদী এবং ২০৪১ থেকে ২০৫০ হবে দীর্ঘমেয়াদী। প্রতিটি মেয়াদী কর্মসূচী শেষে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি মূল্যায়ন করে পরবর্তী মেয়াদে গ্রীণ হাউস গ্যাস তথা কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন কমানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে।
বাংলাদেশ ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। আবার নেতৃত্বেও রয়েছে। তাই বাংলাদেশের দায়িত্বও অনেক। এই দায়িত্ব অনেক বিচক্ষণতার সঙ্গে পালন করতে হবে।
বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি প্রাক-শিল্প যুগের চেয়ে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে সীমিত রাখতে হবে। প্যারিস চুক্তিতে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রী সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখার কথা বলা হয়েছে। সম্ভব হলে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসে সীমিত রাখার চেষ্টা করা। ইতোমধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ১ দশমিক ২ ডিগ্রী সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। তাতেই বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের যে প্রভাব দেখা যাচ্ছে এই অবস্থায় বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রী পর্যন্ত বাড়তে দেয়া হবে বিপজ্জনক।
এই গ্রীণ হাউস গ্যাস নিঃসরণ কমাতে জলবায়ু বিপদাপন্ন দেশগুলোর ওপর কোন ধরনের চাপ মেে নেয়া যাবে না। কারণ বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে এদেশগুলোর দায় অতি সামান্য। ৪৮টি দেশ মিলিয়ে ৫ শতাংশেরও কম গ্রীণ হাউস গ্যাস নিঃসরণ করে। এমনিতেই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিপদাপন্ন দেশগুলো প্রতি বছর ২ থেকে ৩ শতাংশ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হারাচ্ছে। তার ওপর নিঃসরণ কমানোর হার বৃদ্ধি চাপিয়ে দিলে উন্নয়ন আরও বাধাগ্রস্ত হবে। তাই প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত না করে যতটা সম্ভব গ্রীণ হাউস গ্যাস নিঃসরণ কমাবে।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার জন্য প্রধান রসদ অর্থ। কোপেনহেগেন এ্যাকর্ডে উন্নত দেশগুলো ২০২০ সাল থেকে প্রতি বছর জলবায়ু তহবিলে ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দেয়ার প্রতিশ্রæতি দিয়েছিল। এখন উন্নত দেশগুলো সেই প্রতিশ্রæতিকে পাশ কাটিয়ে নানা অজুহাত দেখাচ্ছে। বাংলাদেশের উচিত সেটাকে আবারও সামনে নিয়ে আসা। এই প্রতিশ্রæতি পূরণে নতুন করে উন্নত দেশগুলোর অঙ্গীকার দাবি করা।
অবিপদাপন্ন দেশগুলোর প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে জলবায়ু বাস্তুচ্যুতদের পুনর্বাসন। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে বক্সবাজারে বহুতল ভবন নির্মাণ করে কিছু জলবায়ু বাস্তুচ্যুত পরিবারকে পুনর্বাসন করেছে।
অতিবিপদাপন্ন দেশগুলোর জন্য অর্থায়নে প্রধান বাধা জিসিএফ-এর দীর্ঘসূত্রতা। এই দীর্ঘসূত্রতা পরিহার করে অভিযোজনের জন্য সহজ শর্তে অতিবিপদাপন্ন দেশগুলো যাতে অর্থ ও প্রযুক্তি সহায়তা পেতে পারে তার দাবি করা উচিৎ। এই অর্থ হতে হবে অবশ্যই অনুদান। ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো কোন কো-ফাইন্যান্স দিয়ে অর্থ বা ঋণ চায় না।
জো বাইডেনের লিডার্স সামিটের এই উদ্যোগ অবশ্যই আগামী জলবায়ু সম্মেলনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে আশা করি।