বাজেট সময়োপযোগী নয়

বাজেট ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিদ্যুৎ জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। এনার্জি বাংলাকে তারা বলেছেন, বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাস সৃষ্ট দুর্যোগে জনজীবন স্থবির। এ পরিস্থিতিতে যে ধরনের বাজেট প্রত্যাশিত ছিল সেটি হয়নি। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য বিদ্যুৎ, জ্বালানির সরবরাহ মূল্য কমানো সময়ের দাবি হলেও বাজেটে এর প্রতিফলন নেই। বর্তমানে বিদ্যুতের চাহিদা কম। একটি ব্যতিক্রমী সময় পার হচ্ছে। তবু বাজেট গতানুগতিক হয়েছে। স্বাভাবিক সময়ে যেমন হয়। ব্যতিক্রমী সময় মোকাবেলার কোনো দিকনির্দেশনা বাজেটে স্পষ্টভাবে নেই।

budget 2020 energy bangla

ম তামিম
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও উপ-উপাচার্য ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
এ বাজেট দেখে মনে হয়নি যে কভিড-১৯ কে কেন্দ্র করে দেয়া হয়েছে। এর আগে গতানুগতিক যে বাজেট ছিল ঠিক সেটা ধরেই করা হয়েছে। ফলে বিদ্যুৎ জ্বালানির বরাদ্দেও খুব বেশি হেরফের হয়নি। বিদ্যুৎ খাতের ৭০ ভাগ অর্থ ব্যয় হবে বিতরণ ও সঞ্চালন। উৎপাদনে ব্যয় হবে ৩০ ভাগ। তবে দেশের গ্যাসকূপের উৎপাদন যেহেতু শেষ হয়ে আসছে, সেহেতু জ্বালানি খাতে ব্যয়ের প্রস্তাব যৌক্তিক।
আমদানি করা ফার্নেস অয়েলে কর আরোপ করা সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত হয়েছে। আমরা বড় বড় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করছি। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ কমবে। এখন কোনোভাবেই তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রয়োজন নেই। দরকার হবে না। উচিত হবে না। সরকারের উচিত কম খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা। সেই চেষ্টাও চলছে। আর এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে হলে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে যেতে হবে। এখন এই দুর্যোগের মধ্যে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো নিয়মিত চলছে না। চালানোর প্রয়োজন হচ্ছে না। ভবিষ্যতেও স্বাভাবিক সময়ে তার প্রয়োজন নেই বা প্রয়োজন হবে না। এজন্য বেশি খরচের তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আর সেজন্য তেলের উপর শুল্ক আরোপ যথাযথ সিদ্ধান্ত হয়েছে।
সঞ্চালন ও বিতরণ খাতে বেশি বরাদ্দ দেওয়াটা ঠিক আছে। সঞ্চালন খাতের ন্যাশনাল লোড ডেসপ্যাস সেন্টার (এনএলডিসি) যেখান থেকে বিদ্যুতের চাহিদা নির্ধারণ করে সরবরাহ করা হয় তার অটোমেশন করতে হবে, দরকার স্মার্ট গ্রিড। এ ছাড়া গ্যাসক্ষেত্রের উৎপাদন কমে গেছে। সারা বিশ্বেই কমে যাওয়া গ্যাসক্ষেত্রের উৎপাদন ঠিক রাখতে কমপ্রেসর স্থাপন করা হয়। সেদিকে নজর দিতে হবে।

ড. ইজাজ হোসেন
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
ভেবেছিলাম এবার বাজেট কনসারভেটিভ হবে। কিন্তু তা হয়নি স্বাভাবিক অন্য বারের মতনই হয়েছে । স্বপ্নের জগতে বাস করছে মনে হচ্ছে। সবকিছু বড় করে দেখানো হয়েছে। টাকা কোথা থেকে পাবে তার কোন কিছু বলা হয়নি। বিদ্যুৎ-জ্বালানি অনেক কিছুই স্থগিত করা উচিত ছিল। এখনতো বিদ্যুতের চাহিদা কম। তাহলে বেশি বিদ্যুৎ দিয়ে কি লাভ। উল্টো বেশি বিদ্যুতে ক্যাপাসিটি খরচ বেশি হচ্ছে। এভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়িয়ে এই মুহূর্তে সেখানে খরচ করে কোন লাভ নেই। তাছাড়া এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র করার অর্থই বা আসবে কোথা থেকে? ঋণ কি এখন পাওয়া যাবে? ঋণ পাওয়া গেল সে অর্থ কি আমরা শোধ করতে সক্ষম? এসব বিষয়গুলো বাজেটের কোথাও দেখা যায়নি।
করনা ভাইরাসের কারণে যে সবকিছু বিশ্বব্যাপী স্থবির অবস্থা হয়েছে, তার সাথে মিল রেখে কোন কিছুই দেখা যায়নি।
এখন গ্যাস অনুসন্ধান বেশি দরকার। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য গ্যাস দরকার। যদিও গ্যাসের দাম এখন কম তারপরও দেশীয় নিজস্ব গ্যাস দরকার আছে। এজন্য অনুসন্ধান জরুরী। সেসব দিকে মনোযোগ এই বাজেটে দেখা যাচ্ছে না। দুটো বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া দরকার । প্রথমত টেকসই বিদ্যুৎ সরবরাহ। আর দ্বিতীয়তঃ গ্যাস অনুসন্ধান বাড়ানো। কিন্তু এই দুটোর কোনোটাতেই বাজেটের প্রতিফলন হয়নি।

ইমরান করীম
সভাপতি, বাংলাদেশ ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার অ্যাসোসিয়েশন (বিপপা)
বাজেট স্বাভাবিক সময়ের মতো মনে হয়েছে। এখন যে বিশ্বের সাথে বাংলাদেশেও প্রতিকূল অবস্থার সাথে চলছে তার কোন কিছুই বাজেটে দেখা যায়নি।
বাজেট নিয়ে মন্তব্য করা যাবে আরও তিন মাস পরে। পরিস্থিতি সামনে যেহেতু সম্পূর্ণ অজানা তাই এখনি কোন মন্তব্য নয়।
তবে বিদ্যুতের একটা বিষয় নজরে আনা খুবই দরকার। আমদানি করা ফার্নেস অয়েল এর উপরে কর বসানো হয়েছে। এটি অযৌক্তিক। এটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর লাভ বা ক্ষতি কিছুই হবে না। কিন্তু লোকসানে পড়বে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। কারণ যে তেল ব্যবহার হয় তার দাম পুরোটাই দিয়ে দেয় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড।বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কোম্পানির এক্ষেত্রে কোনো লাভ ক্ষতির বিষয় নেই। বর্তমান আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কম। তারপরও
এই কর বাড়ানোর কারণে এই বছর আরও তিন হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে। এমনিতেই পিডিবি লোকসান দিচ্ছে। তার উপর আবার এই চাপ। এতে পিডিবিকে সমস্যায় পড়তে হবে ।সরকারকে ভর্তুকি দিয়ে পিডিপিকে চালাতে হবে।
দুটো বিষয় হতে পারে, ভর্তুকি দিয়ে পিডিবিকে চালাতে হবে। নয়তো গ্রাহকের কাছে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে এই টাকা আয় করতে হবে। দুটোর কোনটাই যৌক্তিক নয়। পিডিবি’র রাজস্ব আহরণ বাড়াতে হবে। ক্যাশ ফ্লো বাড়াতে হবে। কিন্তু এতে দুটোই বিড়ম্বনায় পড়বে। এখনই সুযোগ, বিবেচনা করা উচিত ছিল এসব বিষয়গুলো। কিন্তু তা করা হয়নি। দেশের বেশিরভাগ মানুষই করের আওতামুক্ত। তারা কর দেয় না। সক্ষম কিন্তু করের আওতায় নেই এমন মানুষদের কিভাবে করের আওতায় আনা যায়, সেদিকে বাজেটের নজর দেওয়া উচিত ছিল। সে বিষয়ে কোনো দিকনির্দেশনা নেই। ফার্নেস অয়েলে কর বসানোর কারণে এনবিআর সহজে অর্থ আদায় করবে। এনবিআর’র আদায় বাড়বে। কিন্তু সরকারকে বেশি করে ভর্তুকি দিতে হবে। এ বিষয়টা যেহেতু সুযোগ আছে তাই এখনই বিবেচনা করা উচিত। বাজেট চূড়ান্ত অনুমোদনের আগে ফার্নেস অয়েল থেকে কর আরোপের বিষয়টি তুলে নেওয়া উচিত।