বিদ্যুতের দাম : সমন্বয়ের শেষ কোথায়
গত ১০ বছরে ৮ বার বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করা হয়েছে। এই সমন্বয়ের প্রক্রিয়ায় প্রতিবারই দাম বেড়েছে। ক্রেতা বা ভোক্তা প্রতিবারই বাড়তি দাম দিতে হয়েছে। তাই সরকারি ভাষায় একে সমন্বয় বলা হলেও কাছে তা দাম বৃদ্ধির নামান্তর। তাঁরা বলেও থাকেন দাম বৃদ্ধি। সমন্বয় শব্দটি তাঁদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
কিন্তু সরকারের পক্ষে সমন্বয় ছাড়া অন্য কিছু বলা সম্ভব নয়। কেননা, সরকারি হিসাবে বিদ্যুতের উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যয় গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দামের চেয়ে বেশি। তাই সমন্বয় করে দামের এই ব্যবধান ঘুচানোর প্রক্রিয়া চালানো হচ্ছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে-বিদ্যুতের দাম সমন্বয়ের এই প্রক্রিয়ার শেষ কোথায়? চলতি মার্চ মাস থেকে অস্টম বারের মত দাম সমন্বয়ের আদেশে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন বলেছে, এবার যে সমন্বয় করা হল তারপরও সরকারকে বছরে ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দিতে হবে। এর অর্থ হল-দামের ব্যবধানের পুরোটা এবারও সমন্বয় করা হয়নি। ক্রেতা-ভোক্তাদের ওপর আর্থিক চাপ কমানোর জন্য ক্রমান্বয়ে সমন্বয় করা হচ্ছে। তাই ধরে নেওয়া যায়, ভবিষ্যতে আরও সমন্বয় করা হবে। অর্থাৎ সমন্বয়ের প্রক্রিয়া চলবে।
এখন আরেকটি প্রশ্ন তোলা যায়। এবার যদি দামের সম্পূর্ণ ব্যবধানই সমন্বয় করা হত তাহলে কি আর ভবিষ্যতে সমন্বয়ের প্রয়োজন হত? জবাব হচ্ছে-হ্যাঁ, প্রয়োজন হত। বিদ্যুতের উৎপাদন, সঞ্চালনও বিতরণ ব্যবস্থা যত বেশি সম্প্রসারিত হবে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত জ্বালানির দামে যত দিন ওঠা-নামা থাকবে ততদিন দাম সমন্বয়েরও প্রয়োজন থাকবে।
তবে কখনো কখনো সরকার ভর্তুকি দিয়ে যদি দামের ব্যবধান ঘুচাতে চায় এবং সক্ষম হয়, তাহলে সমন্বয়ের খাড়া ক্রেতা-ভোক্তার ঘাড়ে পড়বে না। অবশ্য সরকারের নীতি হচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত থেকে ক্রমান্বয়ে ভর্তুকি প্রত্যাহার করা। আবার যদি কোনো কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যয় কমে আসে, তখন সমন্বয় করে দাম কমানোও হতে পারে। অবশ্য তার সম্ভাবনা খুবই কম। তাহলে ধরে নেওয়া যায় যে, বিদ্যুতের দাম সমন্বয় একটি অনিশে:ষ প্রক্রিয়া।
যেসব পন্যের উৎপাদন ব্যয় (বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ক্ষেত্রে সঞ্চালন ও বিতরণসহ) পরিবর্তনশীল তার দাম নিশ্চয়ই সমন্বয়যোগ্য। বাজার অর্থনীতিতে নিত্য প্রয়োজনীয় সব বাজারি পন্যের দাম স্বয়ংক্রিয়ভাবে সমন্বয় হয় চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে। তবে অনৈতিকভাবে বাজার প্রভাবিত করার ঘটনাও অনেক ক্ষেত্রেই থাকে।
এখন প্রশ্ন হল-বিদ্যুৎ নিত্য প্রয়োজনীয় হলেও তা কি চাল-ডাল-তেল-নুনের মত আর দশটা বাজারি পণ্যের মত? না, তা নয়। বিদ্যুৎকে বলা হয় কৌশলগত পণ্য বা স্ট্রাটেজিক কমোডিটি (জ্বালানিও তাই)। এটি এমন এক পণ্য যা সমগ্র উৎপাদন প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। তাই বিদ্যুতের (এবং জ্বালানিরও) দাম অর্থনীতি এবং জনজীবনযাত্রার সব ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। এই কারণে এই পণ্যের দাম নির্ধারণে অনেক গভীর চিন্তা ও কৌশলী পদক্ষেপ নিতে হয়।
আবাসিক খাতে বিদ্যুতের দাম বাড়লে প্রতিটি পরিবারের ব্যয় কিছুটা বাড়ে। সেটা যত কমই হোক, নিশ্চয়ই তা প্রতিটি পরিবারের আয়-ব্যয়ে কিছুটা প্রভাব ফেলে। তবে যখন কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যে ব্যবহৃত বিদ্যুতের দাম বাড়ে তখন তার প্রভাব পড়ে সব পণ্যের দামে যা আবার ঘুরে-ফিরে প্রতিটি পরিবার বা মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ে যুক্ত হয়।
এর চেয়েও বড় কথা হল কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যে ব্যবহৃত বিদ্যুতের দাম বাড়লে দেশের রপ্তানি খাতকে বিশ্ববাজারে অসম প্রতিযোগিতায় পড়ার আশংকা তৈরি হয়। প্রতিবারই বিদ্যুতের দাম সমন্বয়ের সময় এ প্রসঙ্গটি বহুভাবে আলোচিত হয়। এবার তা আরো একুট বেশি হয়েছে। কারণ করোনো ভাইরাসের কারণে বিশ্ব বাণিজ্যে ইতিমধ্যেই বেশ একটা স্থবিরতা বা মন্দাভাব দেখা দিয়েছে। এই ধারা আরো প্রলম্বিত হওয়ার আশংকাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
এ সময়ের এই বিশেষ পরিস্থিতি ছাড়াও, যে কোনো সময়ে বিদ্যুতের দাম সমন্বয়ের প্রশ্ন উঠলে দেশের ব্যবসায়ী-শিল্পপতি মহল থেকে বিশ্ববাজারে অসম প্রতিযোগিতার কথা বেশ জোরেশোরেই তোলা হয়। কিন্তু দাম সমন্বয়ের ক্ষেত্রে তা বিবেচনা করা হয় না বলে তাঁদের অভিযোগে আছে। এ ক্ষেত্রে সরকার এবং ব্যবসায়ী-শিল্পপতি উভয় পক্ষ থেকেই বিশ্ববাজার পরস্থিতি পর্যালোচনা করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। আমাদের ব্যবসায়ী-শিল্পপতি মহলকে তাঁদের পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে অন্য কোন কোন দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হয়, সে সব দেশে বিদ্যুৎ-জ্বালানির দামসহ উৎপাদন ব্যয় কেমন, এ সব বিষয় পর্যালোচনা করে দেখা কঠিন কোনো বিষয় নয়।
এ ছাড়া, দাম সমন্বয়ের ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ খাতের অব্যবস্থাপনা ও অপব্যয়গুলো খতিয়ে দেখা খুব দরকার। অনেক অব্যবস্থাপনা ও অপব্যয়ের নজির আছে। অভিযোগ আছে আরো বেশি। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর পক্ষ থেকে প্রতিবারই এসব বিষয় বিইআরসির গণশুনানীতে তোলা হয়। এবারও হয়েছে। ক্যাব হিসাব করে দেখিয়েছে যে, বিদ্যুৎ খাতে বছরে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা অপব্যয় হচ্ছে যা সাশ্রয় করে দাম সমন্বয়ের খাড়া থেকে জনগণকে রেহাই দেওয়া যায়। কিন্তু ক্যাবের এই হিসাব নিকাশ বা অভিযোগের বিষয়ে সরকার কিংবা সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলো অথবা বিইআরসি কখনোই কিছু বলে না। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ক্ষেত্রে সাশ্রয় বিশ্বব্যাপী একটি বড় উপাদান হয়ে উঠেছে। সাশ্রয় একদিকে যেমন সতন্ত্রভাবে প্রতিটি গ্রাহকের ব্যয় নিয়ন্ত্রণের সহয়ক তেমনি জাতীয় সম্পদ সংরক্ষণেরও একটি বড় উপায়। তাই আবাসিক, বাণিজ্যিক, কৃষি, শিল্প নির্বিশেষে সব গ্রাহকের উচিৎ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ে মনযোগী হওয়া। সরকারেরও উচিৎ এ বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে দৃশ্যমান কাজ করা।