বিদ্যুতের দাম ২৩ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব পিডিবির

ঘাটতি পুষিয়ে নিতে পাইকারিতে ইউনিট প্রতি বিদ্যুতের দাম ২৩ দশমিক ২৭ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)।

বৃহস্পতিবার কারওয়ানবাজারে টিসিবি মিলনায়তনে বিদ্যুতের পাইকারি মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) গণশুনানিতে এ প্রস্তাব দেয়া হয়।

তবে প্রস্তাব পর্যালোচনা করে বিইআরসি বলছে, সরবরাহ ব্যয় সমন্বয় করতে ইউনিট প্রতি ১৯ দশমিক ৫০ শতাংশ দাম বাড়ানো যেতে পারে।

শুনানিতে পিডিবির মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক কার্যক্রম) কাউসার আমীর আলী বলেন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পাইকারিতে বিদ্যুতের সরবরাহ ব্যয় ছিল ৫ টাকা ৮৩ পয়সা। এখন বিদ্যুতের পাইকারি মূল্য ৪ টাকা ৭৭ পয়সা। এর ফলে গত অর্থবছরে ৬ হাজার ৮৬২ কোটি ৩০ লাখ টাকা লোকসান গুণতে হয়েছে।

“২০২০ পঞ্জিকা বছরে গড় সরবরাহ ব্যয় হবে ৫ টাকা ৮৮ পয়সা হবে। কিন্তু বর্তমান মূল্য বজায় থাকলে এ বছর ঘাটতি হবে ৮ হাজার ৫৬০ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এ ঘাটতি পোষাতে ইউনিট প্রতি বিদ্যুতের পাইকারি মূল্য এক টাকা ১১ পয়সা বাড়ানো প্রয়োজন।”

দাম বাড়ানোর কারণ হিসাবে বৈদেশি মুদ্রার বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন, গ্যাসের মূল্য ৪১ শতাংশ বৃদ্ধি, কয়লার ওপর নতুন করে ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ, বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় বৃদ্ধি ও কোনো কোনো বিতরণ সংস্থা কর্তৃক সময়মতো টাকা পরিশোধ না করার কথা বলা হয়েছে।

প্রস্তাব মূল্যায়ন কমিটির পক্ষে বিইআরসির উপপরিচালক (ট্যারিফ) মো. কামরুজ্জামান বলেন, তাদের পর্যালোচনায় পাইকারি মূল্য ৯৩ পয়সা বা ১৯ দশমিক ৫০ শতাংশ বাড়ানো যেতে পারে।

বিইআরসির চেয়ারম্যান মনোয়ার ইসলাম, সদস্য মিজানুর রহমান, আব্দুল আজিজ, রহমান মুরশেদ ও মাহমুদউল হক ভূইয়া শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন।

অপর দিকে ক্যাবের উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম, মোবাইল গ্রাহক সমিতির সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ, বিএনপি নেতা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, বিজিএমইএর প্রতিনিধি আনোয়ার হোসেন চৌধুরী, বিকেএমইএর সজিব হোসেন, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, সিপিবি নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্সসহ আরও কয়েকজন ভোক্তা প্রতিনিধি দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বক্তব্য দেন।

বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা চাহিদার চেয়ে দ্বিগুণ হলেও সঙ্কটকালীন সময়ের জন্য বিশেষ আইনের অধীনে চালু হওয়া কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো এখনও সচল আছে। সময়িকভাবে চালু করা এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র কেন বন্ধ করে ব্যয় কমানো হচ্ছে না, শুনানিতে অংশ নিয়ে সেই প্রশ্ন তোলেন কয়েকজন।

ক্যাবের উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, “কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর প্রয়োজন না থাকলেও সেগুলোকে বসিয়ে বসিয়ে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ অর্থ দেওয়া হচ্ছে। এই কারণেই পিডিবির ঘাটতি বাড়ছে। এ ধরনের কাজের দায়ভার চাপানো হচ্ছে জনগণের ওপর।”

চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র সচল রাখার জন্য নতুন করে চুক্তি নবায়ন করা হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে চলামান শুদ্ধি অভিযান বিদ্যুৎ খাতেও চালানোর আহ্বান জানান অধ্যাপক শামসুল।

তিনি বলেন, “সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বিপিসির দেওয়া তেলে চলতে পারলেও বেসরকারি কেন্দ্রগুলো নিজেরা পৃথকভাবে তেল আমদানি করে। ফলে সেখানে অনেক বেশি বাড়তি খরচ হয়। এসব খরচ বিদ্যুতের উৎপাদনের খরচ বাড়িয়ে দেয়। এছাড়া নিজেরা তেল আমদানির নামে বহু রকমের দুর্নীতি হয়। বিপিসির তেলের মান নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকলে সেটার সমাধান করা উচিত। বেসরকারিভাবে তেল আমদানির এই ফাঁদ দুর্নীতির একটি উৎস। এই উৎস বন্ধ করতে হবে। স্বচ্ছতার সঙ্গে ঘাটতির প্রকৃত পরিমাণ হিসাব না করে, সেই হিসাব বিবেচনায় নিয়ে যদি ব্যয় বাড়ানো হয় সেটা জনগণের সঙ্গে অন্যায় করা হবে।”

শুনানিতে পিডিবির কর্মকর্তারা জানান, ইতোমধ্যে ৫টি কুইকরেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বাকি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোও ধীরে ধীরে বন্ধ করার পরিকল্পনা রয়েছে।

তবে সব কুইকরেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হতে কত সময় লাগবে সে বিষয়ে শুনানিতে কোনো দিনক্ষণ বলতে পারেননি পিডিবি কর্মকর্তারা।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট উৎপাদনের ১১ শতাংশ কুইক রেন্টাল থেকে আসলেও ২০২০ পঞ্জিকাবর্ষে এই হার কমে ৯ শতাংশ নেমে আসবে বলেও শুনানিতে জানায় পিডিবি।

আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর দুর্বিষহ বিদ্যুৎ সংকট বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়। দ্রুত বন্দোবস্তের জন্য ২০টি ভাড়াভিত্তিক বা কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য চুক্তি করে সরকার।
২০০৯ সালে সাড়ে তিন হাজার মেগওয়াটের জায়গায় এখন বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২২ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়েছে। বিদ্যুতের ব্যাপক ঘাটতির সময়ে কুইক রেন্টালগুলোও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

১০ বছর আগে এই কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে তখনকার বিরোধী দল বিএনপি বেশ সরব হলেও এ দিনের শুনানিতে এই উদ্যোগকে যৌক্তিক বলেই মেনে নিলেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল।

তবে ২৪ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষমতা অর্জন করার পরও বার বার এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ বৃদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি।

আলাল বলেন, “গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হওয়ার পর তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো বছরের অধিকাংশ সময় বসে আছে। তারপরেও এগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ বছরে ১৫ হাজার কোটি টাকা গুণতে হচ্ছে, যা আগামী বছর ২০ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছাবে।”

বর্তমানে ৬২টি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৫ হাজার মেগাওয়াট উপাদন সক্ষমতা রয়েছে বলে শুনানিতে জানায় পিডিবি।

বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবের বিরোধিতা করে মোবাইল গ্রাহক সমিতির নেতা মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, “গত মার্চ মাসের শুনানিতে বলা হয়েছিল, গ্যাসের দাম বাড়লে বিদ্যুতের দাম বাড়বে না। এখন ছয় মাসের মাথায় এসে ৮ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি দেখানো হচ্ছে। আবার তিন বছরের মাথায় এই ঘাটতি তিনগুণ বাড়বে বলে শোনা যাচ্ছে।”

বিজিএমইএর প্রতিনিধি আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বলেন, “ব্যয়ভার বহন করতে না পেরে এবং প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পেরে চলতি বছর ৬৯টি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এতে বেকার হয়েছে অন্তত ৩০ হাজার শ্রমিক। এখন নতুন করে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে প্রধান রপ্তানি খাতে স্থবিরতা নেমে আসবে।”
দাম বাড়ানোর পরিবর্তে সততা ও জবাবদিহির সঙ্গে কাজ করে ‘অযৌক্তিক ব্যয়’ কমানোর আহ্বান জানান আনোয়ার।

সিপিবি নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, “বিদ্যুতের সামগ্রিক উৎপাদনের ৫০ শতাংশ আসে বেসরকারি খাত থেকে। বিদ্যুতের মতো একটি সেবা খাতে এ রকম বেসরকারি খাতনির্ভরতা গভীর উদ্বেগের। বেসরকারি খাতের আধিপত্য কমাতে না পারলে ব্যয় বৃদ্ধি কমানো যাবে না।”

পিজিসিবির প্রস্তাবের ওপর শুনানি

২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরের প্রক্কলিত খরচের ভিত্তিতে ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে বিদ্যুতের সঞ্চালন চার্জ গড়ে প্রতি ইউনিট শূন্য দশমিক ৪২০২ পয়সা করার প্রস্তাব দিয়েছে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি বাংলাদেশ-পিজিসিবি।

পিজিসিবির ৭৬ দশমিক ২৫ শতাংশ শেয়ারের মালিক বিপিডিবি, আর বাকি ২৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ শেয়ারের মালিক জনগণ।

বর্তমানে সঞ্চালন চার্জ ২৩০ কেভি পর্যায়ে প্রতি ইউনিট শূন্য দশমিক ২৭৪৪ টাকা, ১৩২ কেভি পর্যায়ে প্রতি ইউনিট সঞ্চালন চার্জ শূন্য দশমিক ২৭৬৮ টাকা, ৩৩ কেভিতে প্রতি ইউনিট সঞ্চালন চার্জ শূন্য দশমিক ২৭৯১ টাকা রয়েছে।

নতুন করে আগামী জানুয়ারি থেকে সঞ্চালন চার্জ ২৩০ কেভি পর্যায়ে প্রতি ইউনিট শূন্য দশমিক ৪১৬৬ টাকা, ১৩২ কেভিতে প্রতি ইউনিট সঞ্চালন চার্জ শূন্য দশমিক ৪২০২ টাকা, ৩৩ কেভিতে প্রতি ইউনিট সঞ্চালন চার্জ শূন্য দশমিক ৪২৩৭ টাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

তবে বিইআরসির পর্যালোচনায় বলা হয়, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরে নিট রাজস্ব চাহিদা রয়েছে প্রতি ইউনিট ০.২৯৮০ পয়সা। বর্তমান সঞ্চালন মূল্যহার প্রতি ইউনিট ০.২৭৮৭ বিবেচনায় সঞ্চালন মূল্যহার প্রতি ইউনিটে ০.০১৯৩ পয়সা বাড়ানো যেতে পারে বা ৬ দশমিক ৯২ শতাংশ।

শুনানিতে অংশ নিয়ে ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা শামসুল আলম বলেন, “সঞ্চালন ব্যবস্থার কিছু অংশ বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার পরিকল্পনার কথা শোনা যাচ্ছে। এমনটি করা হলে কুইক রেন্টালের মতো একটা পরিস্থিতি দাড়াবে।”

তবে এ বিষয়ে হ্যাঁ অথবা না কোনোটাই বলতে পারেননি পিজিসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম কিবরিয়া।