বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি ন্যায্য ও যৌক্তিক হয়নি

transmission line

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরী কমিশন ২৭শে ফেব্রুয়ারি বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির আদেশ দেয়। ১লা মার্চ থেকে তা কার্যকর হয়েছে। এই আদেশে ২০২০ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে ৩১শে ডিসেম্বর এই এক বছরের জন্য বিদ্যুতের ঘাটতি ছয় হাজার ৬৬৪ কোটি টাকার মধ্যে তিন হাজার ৬০০ কোটি টাকা সরকারি ভর্তুকি এবং তিন হাজার ৮৪ কোটি টাকা ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি দ্বারা সমন্বয় করা হয়েছে। ভোক্তার পক্ষ থেকে চিহ্নিত অযৌক্তিক ব্যয় এবং সরকারের নীতিজনিত ব্যয় রাজস্ব চাহিদায় অন্তর্ভুক্ত না করে বিদ্যুতের মূল্যহার পরিবর্তনের প্রস্তাব করা হয়। আদেশে সে প্রস্তাব বিবেচিত হয়নি। ফলে আদেশ ন্যায্য ও যৌক্তিক হয়নি।
আবার বিতরণে ২৭৫ কোটি টাকা রাজস্ব উদ্বৃত্ত থাকা সত্ত্বেও আদেশে ভোক্তা প্রতি ডিমান্ড চার্জ ২০ থেকে ১০০ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়। অর্থাৎ বিতরণে রাজস্ব উদ্বৃত্ত থাকা সত্ত্বেও ডিমান্ড চার্জ বৃদ্ধিতে একদিকে ভোক্তার বিদ্যুতের মূল্য অন্যদিকে ভর্তুকি বৃদ্ধি পায়। ফলে ডিমান্ড চার্জবৃদ্ধি দ্বারা বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি ন্যায্য ও যৌক্তিক হয়নি। এ আদেশ ভোক্তারা গ্রহণ করেননি। বিতরণের উদ্বৃত্ত রাজস্বে সঞ্চালন ঘাটতি সমন্বয়ের পরও রাজস্ব উদ্বৃত্ত থাকে। তাই সঞ্চালন চার্জ বৃদ্ধিতে দ্বারা বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিও ন্যায্য ও যৌক্তিক হয়নি।
ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণ ব্যয় চুক্তির প্রথম মেয়াদে প্রদত্ত ক্যাপাসিটি চার্জেই পরিশোধ হয়। সুতরাং পরবর্তীকালে সেই নির্মাণ ব্যয় উঁসুলের অজুহাতে আর কোন ক্যাপাসিটি চার্জ আদায়ের সুযোগ থাকেনি। অর্থাৎ এই চার্জ কেবল প্রথম মেয়াদের জন্যই প্রযোজ্য। ফলে পাইকারি বিদ্যুতের রাজস্ব চাহিদায় অন্তর্ভুক্ত ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ দুই হাজার ১২৬ কোটি টাকা রাজস্ব চাহিদা হতে বাদ দেয়ার প্রস্তাব করা হয়। তাতে অযৌক্তিক রাজস্ব ঘাটতি দুই হাজার ১২৬ কোটি টাকা কমায় বিদ্যুতের মূল্য দুই হাজার ১২৬ কোটি টাকা কমে।
আবার বিদ্যুতের মূল্য কমানোর লক্ষ্যে ভোক্তাদের নিজস্ব অর্থায়নে সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কমিশন বিদ্যুৎ রক্ষণাবেক্ষন ও উন্নয়ন তহবিল গঠিত করে। এ তহবিলের নির্দেশনা মতে এ তহবিলের অর্থ অনুদান হিসেবে বাংরাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)’র বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিনিয়োগ হতো। ফলে ভোক্তা কম দামে বিদ্যুৎ প্রাপ্তির সুযোগ পায়। কিন্তু পরবর্তিকালে নির্দেশনা ২০১৯ করা হয়। তাতে উক্ত তহবিলের অর্থ সুদে পিডিবিসহ অন্যান্য কোম্পানিতেও বিনিয়োগ হচ্ছে। ফলে এ তহবিলের অর্থ বিনিয়োগে বিদ্যুতের দাম কমার পরিবর্তে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে ভোক্তা প্রতারিত হচ্ছেন। এ অবস্থায় বিদ্যুৎ উন্নয়ন তহবিল বিলুপ্ত অথবা নির্দেশনা ২০১৯ বাতিল করে বিদ্যুৎ সরবরাহে এই অযৌক্তিক ব্যয় বছরে প্রায় এক হাজার ২০০ কোটি টাকা বৃদ্ধি রহিত করার প্রস্তাব করা হয়। এ প্রস্তাবও আদেশে বিবেচিত হয়নি। অযৌক্তিক ব্যয় কমানোর সকল প্রস্তাব উপেক্ষা করে শুধু উপরোল্লিখিত দু’টি প্রস্তাব গৃহীত হলে বিদ্যুতে রাজস্ব ঘাটতি কমপক্ষে তিন হাজার ৩০০ কোটি টাকা কম হতো। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির আদেশে তা বিবেচিত হলে ঘাটতি সমন্বয় হতো এবং ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুতের তিন হাজার ৮৪ কোটি টাকা মূল্যবৃদ্ধির দরকার হতো না।
সরকারের নীতিজনিত কারণে পাইকারি বিদ্যুতের কমপক্ষে ৭০ শতাংশ ভোক্তা পর্যায়ে লোকসানে বিক্রি করা হয়। ফলে চলতি বছরে লোকসানের পরিমাণ হবে পাঁচ হাজার ১৫১ কোটি টাকা। এ লোকসানের দুই হাজার ৯০ কোটি টাকা সমন্বয় হয় ভোক্তাদের অর্থে। অর্থাৎ দ্বৈতভর্তুকিতে। ফলে ঘাটতি অবশিষ্ট থাকে তিন হাজার ৬১ কোটি টাকা। অথচ সরকার ভর্তুকি দিয়েছে তিন হাজার ৬০০ কোটি টাকা।
তাছাড়া সবার জন্য বিদ্যুৎ কর্মসূচী বাস্তবায়নে বিতরণ অবকাঠামো যথাযথ অর্থনৈতিক বিবেচনায় সম্প্রসারণ হচ্ছে না। তাতেও চলতি বছরে কমবেশি দুই হাজার কোটি টাকা ঘাটতি বৃদ্ধি পায়। এ বৃদ্ধি বিতরণ চার্জেই সমন্বয় হয় এবং বিতরণে রাজস্ব উদ্বৃত্ত্ব থাকে ২৭৫ কোটি টাকা।
অতএব উৎপাদন, সঞ্চালন কিংবা বিতরণ ব্যয়বৃদ্ধির কারণে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কোন সুযোগ ছিল না। অতএব বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির আদেশ ন্যায্য ও যৌক্তিক নয়।