বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির যৌক্তিকতা কী?
ভর্তুকি অবস্থায় সরকার যে কোন সময়ই বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করতে পারে ভর্তুকি কমানোর যুক্তি দেখিয়ে। কিন্তু এই মুহূর্তে, বিশ্ব বাজারে তেলের দাম কম। এই অবস্থায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কোন যৌক্তিকতা নেই। বিশ্ব তেলের মূল্য কমে গেছে যে কারণে ভর্তুকি এমনি কমে যাবে। এই মুহূর্তে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি কেন হল, এটা আমার কাছে কিছুটা হলেও অবাক লাগছে। যদি তেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ করা যেত তবে উৎপাদন খরচ কমতো। তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করলে ক্যাপাসিটি চার্জও কমবে। তখন উৎপাদন খরচ কমবে। সরকার বিদ্যুতের যে চাহিদার পূর্বাভাস ঠিক করেছিল, বাস্তবে তা কার্যকর হয়নি। ভেবেছিল শিল্পে প্রচুর বিদ্যুৎ ব্যবহার হবে। কিন্তু বর্তমান গ্রীড বিদ্যুতের দাম বেশি, একই সাথে নিরবচ্ছিন্ন নয়। অন্যদিকে শিল্পকারখানায় নিজেদের জেনারেটর দিয়ে গ্যাসের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে খরচ অনেক কম হয়, তাহলে কেন তারা গ্রীড বিদ্যুৎ নেবে? এ অবস্থায় বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে দেয়াতে জনগণের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হবে।
২০০৮ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে যেসব ভাড়ায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রে তিন ও পাঁচ বছরের জন্য অনুমতি দেয়া হয়েছিল, সেগুলোর অধিকাংশের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আবার অনুমোদন দেয়া হয়েছে, নবায়ন করা হয়েছে। এসব কেন্দ্র এখনই বাতিল করতে হবে, বিশেষ করে অদক্ষ কেন্দ্রগুলো। পিডিবি যদি নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারে এবং দাম কমাতে পারে তবে শিল্পকারখানায় বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়বে। এতে অব্যবহৃত বিদ্যুৎ ব্যবহার বাড়বে। তখন লোকসান কমে যাবে।
তরল গ্যাস আমদানি এবং বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য ব্যাপক অর্থায়ন প্রয়োজন কিন্তু সেই অর্থ গ্রাহকদের কাছ থেকে আগাম আদায় করার নজির আমরা আগে দেখি নাই। প্রকল্প বাস্তবায়নের পরে সার্বিক খরচ বিবেচনা করে চূড়ান্ত মূল্য নির্ধারণ করাই প্রচলিত নিয়ম।
দাম না বাড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ¦ালানি তেলের দাম কমানোর সুযোগ ছিল। সেটাও করা হয়নি। এক দশক আগেও বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল মূলতঃ গ্যাসভিত্তিক, তবে ২০০৭ সাল থেকে গ্যাসের দাম বাড়ায় তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে বর্তমানে ৩০ শতাংশের বেশী বিদ্যুৎ আমদানি করা তেল দিয়ে উৎপাদন করা হয়। যার মধ্যে ৭০০ থেকে ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় ডিজেল দিয়ে। বাংলাদেশে বিশ^বাজারের চেয়ে তুলনামূলক বেশী দামে ডিজেল বিক্রি হচ্ছে। এজন্য বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়ে ডিজেলের দাম কমিয়ে সমন্বয় করার সুযোগ কাজে লাগালেই ভালো হতো। এতে নির্ধারিত আয়ের মানুষের ওপর চাপ কমতো।
বিদ্যুৎ উৎপাদন তরল জ্বালানি নির্ভর হওয়াটাই বিদ্যুতের দাম কমাতে না পারার মূল কারণ। সরকারি বা বেসরকারি মালিকানা এখানে কোনো বিষয় নয়। এখানে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দক্ষতার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। সতর্কতা ও স্বচ্ছতার মাধ্যমে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করলে অনেক কিছু সম্ভব। গত বছরগুলোতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সফলতার জন্য সরকারকে নির্ভর করতে হয়েছে আমদানি করা তরল জ¦ালানির উপর। যার খরচ বেশি। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দক্ষতার একটা ব্যাপার আছে। তারা কি ধরনের ইঞ্জিন বা টেকনোলজি ব্যবহার করছে সেগুলোও আছে। মালিকানা সরকারি বা বেসরকারি হোক সেটা কোন বিষয় না।
আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমেছে। জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করে এখনই বিদ্যুতের দাম কমানো সম্ভব। বিইআরসির কাজ শুধু দাম বাড়ানো নয়। দাম বাড়ানোর প্রস্তাব এলে তার যৌক্তিকতা বিচার করা উচিত। বিইআরসির ভূমিকা হওয়া উচিত রেফারির মতো। প্রয়োজন হলে ক্যাবের মতো প্রতিষ্ঠানের দাম কমানোর প্রস্তাবের ওপর শুনানি করা উচিত। এতে এই সংস্থার প্রতি মানুষের আস্থা বাড়বে এবং একই সাথে সরকারের ভাবমূর্তিও সমুন্নত হবে।