বিদ্যুতে ক্যাপাসিটি চার্জ: দুই বছরের টাকায় পদ্মা সেতু সম্ভব!

তিনবছরে ৫৪ হাজার কোটি টাকা

হারুন উর রশীদ স্বপন:

বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ এখন দেশের অর্থনীতির গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংসদীয় কমিটির কাছে দেওয়া প্রতিবেদনে নয় মাসে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা চার্জ দেওয়ার কথা জানিয়েছে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গতবছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে মোট ৯০টি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ১৬ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হয়েছে। প্রতিমাসে গড়ে দেওয়া হয়েছে একহাজার ৬৮৫ কোটি টাকা।
বিদ্যুৎ না নিয়েও এই টাকা গুণতে হচ্ছে। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্র থাকায় অকারণে লোকসান দিতে হচ্ছে।
পদ্মা সেতুর চেয়ে খরচ বেশি
এরআগে ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৮ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৮ হাজার ১২৩ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয়েছে। প্রায় তিনবছরে মোট দেয়া হয়েছে ৫৩ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। আর পদ্মা সেতু তৈরি করতে খরচ হয়েছে ৩০ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা। গত এপ্রিলে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছিল ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। আর এখন উৎপাদন হচ্ছে কম বেশি ১৩ হাজার মেগাওয়াট। পরিকল্পিত বিদ্যুৎ উৎপাদন হলে ক্যাপাসিটি চার্জেও টাকা বাঁচিয়ে প্রতি দুইবছরে পদ্মা সেতুর মত বড় প্রকল্প করা সম্ভব। এই ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হয় ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, আমাদানি করা বিদ্যুৎ এবং বেসরকারি অন্য বিদ্যুৎ উদ্যোক্তাদের (আইপিপি)।
অলস বসিয়েই অর্থ শোধ
কেরানীগঞ্জের পানগাঁওয়ের এপিআর এনার্জি বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির ক্ষমতা ৩০০ মেগাওয়াট। ২০১৯-২০ অর্থবছরে কেন্দ্রটি থেকে মাত্র ৩৪ লাখ ৪৮ হাজার কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। যা সক্ষমতার এক শতাংশেরও কম। কেন্দ্রটিকে ৫৩২ কোটি ৯১ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয়। ফলে আইপিপি কেন্দ্রটির প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় পড়ে একহাজার ৫৭৯ টাকা ৫৭ পয়সা। যা দেশে সর্বোচ্চ রেকর্ড।
২০২০-২১ অর্থ বছরে একই বিদ্যুৎ কেন্দ্র সাত কোটি ৭২ লাখ ইউনিট উৎপাদন করায় প্রতি ইউনিটের খরচ পড়েছে ৮৯ টাকা। এই অর্থ বছরে সবচেয়ে বেশি দাম পড়েছে ২০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার সিরাজগঞ্জের প্যারামাউন্ট বিট্যাক এনার্জি লিমিটেডের উৎপাদিত বিদ্যুতের। প্রতি ইউনিটের দাম পড়েছে ১৮০ টাকা। এই উদাহরণ অন্য অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্রেরও। বাংলাদেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতার ৪০ থেকে ৪৮ ভাগ গড়ে অব্যবহৃত থাকে। কিন্তু তাদেও নির্দিষ্ট পরিমান উৎপাদনের খরচ দিয়ে দিতে হয়। ফলে ইউনিট প্রতি বিদ্যুতের অনেক দাম পড়ে যায়।
বিশ্লেষকেরাযাবলছেন
সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ২০০৯-১০ সালের বিদ্যুৎখাত এবং এষনকার বিদ্যুৎখাত এক নয়। তখন জরুরিভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ভাড়াভিত্তিক বিদুৎকেন্দ্রগুলোর সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছিল। চুক্তিগুলো ছিল তিন থেকে পাঁচবছরের। কিন্তু এরপর এগুলোর সঙ্গে একই শর্তে কেন চুক্তি নবায়ন করা হল বুঝতে পারছি না। সম্প্রতি আরও পাঁচটির সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে। এাঁ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সুবিধা দিতে করা হয়েছে। যখন দেখা গেল চাহিদার চেয়ে ৪০ থেকে ৪৮ ভাগ ক্যাপাসিটি বেশি তখনই তো সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার ছিল। দেশ এখন একটি অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এখন এইগুলোকে বসিয়ে বসিয়ে টাকা দেওয়া অর্থনীতির বড় বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে বলে তিনি মনে করেন।
তিনি বলেন, যদিও আমরা বলে থাকি প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে আমাদের গড়ে সাড়ে সাত থেকে আট টাকা যায়। কিন্তু বাস্তবে কেন্দ্রভিত্তিক হিসাবের সাথে কুইক রেন্টাল যদি যুক্ত করা হয় তাহলে কোনো কোনো কেন্দ্র থেকে সরকারকে প্রতি কিলোওয়াট আওয়ার বিদুৎ কিনতে হয় ৬০০ টাকায়। এটা বসিয়ে রেখে টাকা দেয়ার কারণে হচ্ছে। আর এর চাপ কিন্তু দেশের মানুষকে নিতে হচ্ছে। তাই সরকারকে এখন চুক্তি বাতিল করতে হবে বা নবায়ন বন্ধ রাখতে হবে বলে তিনি মনে করেন।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুতের ক্ষেত্রে ক্যাপাসিটি চার্জ একটা স্বীকৃত পদ্ধতি। কিন্তু বাংলাদেশে যা হয়েছে তা কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে লাভবান করার জন্য করা হয়েছে। প্রথমত, ক্যাপাসিটি চার্জ বেশি ধরা হয়েছে। দ্বিতীয়ত,অপ্রয়োজনে চুক্তি করা হয়েছে। বিশেষ করে কুইক রেন্টালের ক্ষেত্রে রীতিমত লুটপাট করা হয়েছে। তিনি বলেন, বিদ্যুতের চাহিদাই সঠিকভাবে নির্ধারণ করা হয়নি। ফলে চাহিদার তুলনায় অনেক চুক্তি করা হয়েছে। এগুলো বিদ্যুতের জন্য করা হয়নি। ব্যবসা দেওয়ার জন্য করা হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন না করে সরকারের টাকা নেয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য
পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে অনেকে ভুল বোঝেন। বিনিয়োগের উপর নির্ভর করে এই চার্জ নির্ধারণ করা হয়। বিনিয়োগ পাওয়ার জন্য এই সুবিধা দেয়া হয়। যেসব রেন্টাল বা কুইক রেন্টালের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে তাদের সাথে নতুন করে যে চুক্তিগুলো করা হয়েছে সেখানে ক্যাপাসিটি চার্জ নেই। তাদের কাছ থেকে বিদ্যুৎ নিলেই বা যতটুকু বিদ্যুৎ নেয়া হয় শুধু তার দামই দেয়া হয়। প্রয়োজন অনুযায়ি, অলস বসিয়ে রাখলেও তার জন্য কোন অর্থ দেয়া লাগে না। কারণ তাদের বিনিয়োগের লাভ আগেই উঠে গেছে।

লেখক, ডয়চে ভেলের বাংলাদেশ প্রতিনিধি