বিদ্যুতে সফলতা, জ্বালানি অন্ধকারে
বিদ্যুৎখাতে কয়েকটি সুখবর থাকলেও জ্বালানিখাতে কিছু নেই বললেই চলে। আর তাই প্রাথমিক জ্বালানির অনিশ্চয়তা থেকে এখনও বের হওয়া যায়নি। বছর জুড়েই তাই বিদ্যুৎ নিয়ে ছিল আলোচনা।
নতুন সংযোগ দেয়া, দাম বাড়ানো, দু’একটি চুক্তি স্বাক্ষরে কেটে গেছে বিদ্যুৎখাত। বড় বেসরকারি কোন কেন্দ্রের কাজের অগ্রগতি নেই। তবে সব মিলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা সেঞ্চুরীতে পৌছেছে। গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে তেমন কোন সুখবর নেই। তবে বাপেক্স আন্তর্জাতিক কোম্পানির সঙ্গে কাজ করার একটা সুযোগ তৈরি করেছে।
প্রশংসার দাবি রাখে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। আরইবি চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১৫ লাখ নতুন সংযোগ দিয়েছে।
ব্যতিক্রমী উদ্যোগের মধ্যে ছিল সাতক্ষীরার কৃতি ক্রিকেটার মুস্তাফিজ ও সৌম সরকার এবং কলসিন্দুরের নয় কিশোরী কৃতি ফুটবলারের বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া। অল্প সময়ে দেয়া হয়েছে ছিটমহলে বিদ্যুৎ।
বিদ্যুৎ উৎপাদন, বিতরণ ও সঞ্চালন: চলতি বছর প্রায় ১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। নতুন করে প্রায় ৩০ লাখ নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়েছে। তবে উৎপাদনের সঙ্গে পালা দিয়ে বিতরণ ও সঞ্চালন ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়নি। বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ১৩ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু বিতরণ ব্যবস্থা রয়েছে মাত্র আট হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত।
বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে এখনো রেন্টালের ওপর নির্ভরশীল রয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। বড় ও সাশ্রয়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ক্ষেরে অগ্রগতি শথ।
বিদ্যুতের দাম: চলতিবছরের আগস্ট মাসে বিদ্যুতের দাম ৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা ভাল হয়েছে এটা যেমন ঠিক তেমনি বাড়তি বিদ্যুৎ বিলের অজুহাতে বেড়েছে জীবনযাত্রার ব্যয়। বিশেষ করে যারা ভাড়াটিয়া তাদের জন্য এই বিল চরম ভোগান্তিতে ফেলেছে। বিদ্যুৎ বিল বেড়েছে এই অজুহাতে বাড়িওয়ালারা বাড়িয়ে দিয়েছে বাড়িভাড়া। শিল্পে বিদ্যুতের দাম বাড়ায় উৎপাদন খরচ বেড়েছে। বেড়েছে পণ্যের দামও।
কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র: বিদ্যুতের মহা পরিকল্পনায় মোট ২২টি কয়লভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এরমধ্যে বেসরকারিভাবে ৮টি যার মোট উৎপাদন ক্ষমতা ৩ হাজার ৫১০ মেগাওয়াট, সরকারিভাবে ৭টি যার ক্ষমতা ৭ হাজার ৯৫৫ মেগাওয়াট, যৌথভাবে আরো ৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়েছে, যার মোট উৎপাদন ক্ষমতা ৮ হাজার ২৭০ মেগাওয়াট। এরমধ্যে সরকারি উদ্যোগে স্থাপিতব্য বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু হলেও বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর কোনো খবর নেই। বিশেষ করে অরিয়নের কেন্দ্রগুলো এখনো অর্থায়নই নিশ্চিত করতে পারেনি।
চলতি বছরের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। এই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে চলতিবছর দরপত্র আহ্বান করা হয়। দরপত্রে তিনটি কোম্পানি দরপ্রস্তাব জমা দিয়েছে। এরমধ্যে ভারতের কোম্পানি ভেল সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে মনোনীত হতে পারে বলে সংশিষ্ট সূত্রগুলো জানায়। মাতারবাড়ি ও পটুয়াখালীতে স্থাপিতব্য কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর অর্থায়ন নিশ্চিত হয়েছে। কাজও সিডিউল অনুযায়ি হচ্ছে বলে সংশিষ্ট কর্মকর্তারা জানান। ২০২০ সালের দিকে এসব কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া যেতে পারে।
পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র: বছরশেষে রূপপুরে পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের চুড়ান্ত চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছে। এটি ভাল সংবাদ হলেও এই কেন্দ্রের অর্থায়ন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তিনবছর আগে এই কেন্দ্র স্থাপনের খরচ ৩ বিলিয়ন ডলার বলা হলেও শেষ পর্যন্ত এই কেন্দ্র স্থাপনের প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার খরচ হবে বলে জানানো হয়।
এর বাইরে গত মে মাসে ৪ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে ভারতের আদানি পাওয়ার ও রিলায়েন্স পাওয়ার লিমিটেডের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি সাক্ষর করেছে বাংলাদেশ।
জ্বালানি:
বিদ্যুৎখাতের পরিকল্পনার তুলনায় পিছিয়ে পড়েছে জ্বালানি খাত। বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়লেও জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় উলেখ করার মতো কোনো উদ্যোগ ছিল না চলতি বছর।
গ্যাস: চলতি বছর গ্যাসের সংকট ছিলো গতানুগতিক সমস্যা। এই সমস্যা কাটাতে নতুন করে কোনো গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়নি। কোনো অনুসন্ধান কূপ থেকে উলেখ করার মতো কোনো গ্যাসও উত্তোলন করা যায়নি। একমাত্র শেভরনের জালালাবাদের গ্যাসক্ষেত্রের থেকে নতুন করে ১৩ কোটি ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে।
বাপেক্স: চলতি বছর বাপেক্সের সফলতা আছে। এই প্রথম বাপেক্স আন্তর্জাতিক দরপত্রে অংশ নিয়ে অন্য কোম্পানিগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে কাজ পেয়েছে। কুমিলা বাঙ্গুরা গ্যাসক্ষেত্রের দুইটি কূপ খননের জন্য ক্রিশ এনার্জি বাপেক্সকে নির্বাচন করেছে।
সাগরে তেল গ্যাস অনুসন্ধান: বঙ্গোপসাগরের তেল-গ্যাসের তথ্য জানতে দ্বিমাত্রিক জরিপ (মাল্টিক্লায়েন্ট সিসমিক সার্ভে) করার উদ্যোগ নেয় সরকার। এজন্য ৫টি কোম্পানি দরপত্র জমা দিলেও শেষ পর্যন্ত তা চুড়ান্ত করা যায়নি। এছাড়া সাগরের ১২, ১৬ ও ২১ নম্বর বকে অনুসন্ধান কাজের জন্য চলতি বছর কনোকো ফিলিপস আগ্রহ দেখালেও শেষ পর্যন পিএসসি না করে চলে গেছে।
দেশীয় কয়লা: কয়লা নিয়ে সরকারের উদ্যোগ এক জায়গায়ই দাঁড়িয়ে আছে। মুখে বার বার আলোচনা হচ্ছে দেশীয় কয়লা উত্তোলন জরুরি। কিন্তু বাস্তবে কয়লানীতি চুড়ান্ত করার কোনো তাগিদই নেই সরকারের। এছাড়া বড়পুকুরিয়ার একাংশে পাইলট প্রকল্প হিসেবে উম্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার পরিকল্পনা করা হলেও এখনো তা বাস্তবায়ন হয়নি। জামালগঞ্জের কয়লাখনি থেকে মিথেন গ্যাস তুলে (কোল গ্যাসিফিকেশন) বিদ্যুৎ উৎপাদন বা অন্য কোনো শিল্পে ব্যবহার করা যাবে কিনা তা যাচাইয়ের কাজ শুরু হয়ছে। দিঘীপাড়া কয়লাখনির দায়িত্ব দেয়া হলেও তা ঝুলে গেছে।
নবায়নযোগ্য জ্বালানি: সৌর বিদ্যুতের ক্ষেত্রে সফলতা রয়েছে। সরকারের সহযোগিতায় প্রতিমাসে ইডকোল প্রায় ৪৫ হাজার সোলার প্যানেল স্থাপন করছে। অন্যদিকে চলতি বছর সিঙ্গাপুর ও ডেনমার্কের ১০০ মেগাওয়াট করে দুইটি বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি হয়েছে। এছাড়া টেকনাফে ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার সৌরপার্ক স্থাপনেরও পরিকল্পনা অনুমোদন করেছে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত কমিটি। বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ নেয়া হলেও এখনো কোনো অগ্রগতি হয়নি।
এছাড়া জ্বালানি তেল আমদানির জন্য সাগরে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং স্থাপন প্রকল্প চলতি বছর অনুমোদন পেয়েছে।
আমদানি নির্ভর জ্বালানি:
এলএনাজি: গ্যাসের ঘাটতি মেটাতে সরকার এলএনাজি আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পেট্রোবাংলা এজন্য মহেশখালিতে ভাষমান একটি টার্মিনাল নির্মাণ করছে। এজন্য চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জি লিমিটেডের সঙ্গে ফেব্রুয়ারিতে অনুসাক্ষর করেছে তারা। কিন্তু এখন পর্যন্ত চুড়ান্ত চুক্তি করতে পারেনি। এছাড়াও বিদ্যুৎ বিভাগের তরফ থেকে পাওয়ার সেল স্থলভাগে একটি আলাদা এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ করার উদ্যোগ নিয়েছে। ২০১৮ থেকে দেশে এই নতুন জ্বালানি ব্যবহার শুরু করার পরিকল্পনা করা হলেও এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই।
এলপিজি: সরকার আবাসিকে পাইপলাইনের গ্যাসের পরিবর্তে সিলিন্ডার ব্যবহার উৎসাহিত করার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু এলপিজির দাম নিয়ন্ত্রণের কোনো উদ্যোগ নেই সরকার। ইচ্ছেমতো দামে বেসরকারি কোম্পানিগুলো এলপিজি বিক্রি করে। অনেক ভুইফোঁড় কোম্পনি সিলিন্ডার তৈরি করছে। এতে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে গ্যাস ব্যবহারে যে বৈষম্য তা না কমে আরও বাড়ছে।
কয়লা: সরকারি পরিকল্পনায় ২০৩০ সাল নাগাদ প্রায় ৪০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষে নির্ধারণ করা হয়েছে, যার ৫০ শতাংশ উৎপাদিত হবে কয়লা দিয়ে। এই ২০ হাজার মেগাওয়াট কয়লা উৎপাদন করতে প্রতিবছর প্রয়োজন হবে ৬ কোটি টন কয়লা। বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য বহু কোম্পানির সঙ্গে এরই মধ্যে চুক্তিও হয়ে গেছে। কিন্তু কয়লা কোথা থেকে আমদানি করা হবে তা এখনো চুড়ান্ত করা যায়নি। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমে যাওয়ার কারণে কয়লার দামের ওপরও এর প্রভাব পড়েছে। ফলে কোনো দেশই এখন দীর্ঘমেয়াদের চুক্তিতে বাংলাদেশকে কয়লা দিতে রাজি হচ্ছে না বলে সংশিষ্টরা জানায়।
এছাড়া চলতি বছর কাফকোর সঙ্গে গ্যাস সরবরাহ বিষয়ে চুক্তি করেছে সরকার। ১০ বছর পর গ্যাসের দাম বাড়িয়ে চুক্তি করা হলো। আন্তর্জাতিক আদালতে নাইকোর বিরুদ্ধে মামলা চালাতে ল’ ফার্ম নিয়োগ দিয়েছে বাংলাদেশ।
মন্তব্য:
এক বছরের সফলতা ও ব্যর্থতার বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, আমাদের সফলতার পালা ভারী। তবে ব্যর্থতা একটা আছে। যে সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করার ইচ্ছে ছিল তা করা যায়নি। তবে শেষ পর্যন্ত কাজগুলো করতে পেরেনি। নির্ধারিত সময়ে করা যায়নি কারণ, দক্ষতার অভাব আর নতুন ধারনা সহজে গ্রহণ করতে না পারা। ব্যর্থতার মধ্যে আরো একটি হচ্ছে, সাগরে তেল গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য জরিপ করার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। সেজন্য যে দরপত্র আহ্বন করা হয়েছিল। তা শেষ পর্যন্ত আশাব্যঞ্জক সাড়া পাওয়া যায়নি।
তিনি বলেন, বিদ্যুতে প্রায় ৩০ লাখ বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়েছে। প্রায় ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে। গ্যাসের ক্ষেত্রে নতুন করে ৫টি কূপ করা হচ্ছে। আরো ১০টি কূপ করার বিষয়ে পরিকল্পনা চুড়ান্ত করা হয়েছে। এছাড়া পার্বত্যে গ্যাস অনুসন্ধানে দরপত্র মূল্যায়নের কাজ চলছে।
নসরুল হামিদ বলেন, আগামী বছর হবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে মাঠ পর্যায়ের দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ। গুড গভর্নেন্স প্রকল্প হাতে নেয়া হবে। এছাড়া এইখাতে আমরা অর্থায়নে স্বয়ং সম্পূর্ণ হতে চাই। এজন্য বিভিন্ন দেশের কাছে বাংলাদেশে বিনিয়োগের বিষয়ে প্রস্তাব দেয়া হবে।
বুয়েটের অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, চলতিবছর বিদ্যুৎখাতে কিছু অগ্রগতি হয়েছে। কিছু চুক্তি সাক্ষর হয়েছে। আগামী বছর দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখতে চাই। তিনি বলেন, বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর কাজের গতি খুব শ্লথ। নির্ধারিত সময়ে কেন্দ্রগুলো আসতে পারবে কিনা তা অনিশ্চিত। অন্যদিকে জ্বালানি খাতের উলেখ করার মতো কিছুই হয়নি। সরকার এলএনজি আমদানির কথা বলছে। কিন্তু এই এলএনজি দিয়ে তো আর সব সংকট মোকাবিলা করা যাবে না। প্রাথমিক জ্বালানির ক্ষেত্রে এটি সমাধান হতে পারে না। স্থল ও জলভাগে অনুসন্ধান কাজের কোনো গতি নেই। দেশীয় কয়লা উত্তোলনের ক্ষেত্রেও সরকারের অবস্থান হতাশাজনক।