বিদ্যুৎ কেন্দ্র করা যাবে কিন্তু বন রক্ষা করে

রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র করা যাবে কিন্তু সুন্দরবন বিপর্যয় রোধ করে করতে হবে। তবে এখন পর্যন্ত রামপাল করতে সুন্দরবনকে অবহেলা করা হচ্ছে।
বৃহষ্পতিবার বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগের আমন্ত্রণে কয়েকজন বিশেষজ্ঞ রামপাল ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও সুন্দরবনের করমজল এলাকা পরিদর্শন করেন। এ সময় তারা একথা বলেন। এ সময় প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদও উপস্থিত ছিলেন। বৃহস্পতিবার সকালে হেলিকপ্টার যোগে ঢাকা থেকে রামপাল আসেন প্রতিমন্ত্রী, বিশেষজ্ঞসহ অন্যরা।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই কেন্দ্রের কারণে যে নগরায়ন হবে তা দীর্ঘমেয়াদে সুন্দরবনের ওপর হুমকি হবে। কেন্দ্র করতে যে পরিবেশ পর্যালোচনা করা হয়েছে তাতে যথেষ্ট গরমিল আছে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে হবে কিন্তু পরিবেশের বিপর্যয় রোধ করে। তারা বলেন, সরকারের সহযোগী হিসেবে কাজ করতে চাই। উন্নয়ন কাজে কোনো বিরোধীতা নয়। তবে ভ’ল হলে ধরিয়ে দিতে হবে। সরকারের আমন্ত্রণে এখানে এসেছি ভুল সংশোধন করতে। তারমানে এই নয় যে, এখন পর্যন্ত এই কেন্দ্র পরিবেশবান্ধবভাবেই হচ্ছে। এর যে গরমিল আছে তা সংশোধন করতে হবে। তা না করা পর্যন্ত এই কেন্দ্রের কাজ বন্ধ রাখা উচিত।

rampal power
তবে প্রতিমন্ত্রী বলেন সকল নিয়ম মেনেই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি করা হচ্ছে। এতে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না। সুন্দরবন রক্ষায় সকল ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, সকলের মতামত নিয়েই বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে অন্য কোন কাজের জন্য প্রয়োজন হলে সকলকে নিয়েই তা করা হবে। পরিবেশের ক্ষতি করে কোন কিছুই করা হবে না। তিনি বলেন, বিশেষজ্ঞরা সকলেই উন্নয়নের পক্ষে। উন্নয়ন বন্ধ করে দিতে হবে একথা কেউ বলেনি। ইউনেস্কোর চাহিদা মত পরিবেশের বিষয় পর্যালোচনা করেই রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে।
পরিদর্শনের পর প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যামিকেল বিভাগের অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, কয়লা পোড়ালে দুষণ হবেই। তবে কতটা নিয়ন্ত্রণ করা হবে তা দেখার বিষয়। এখানে বেশি উদ্বেগের বিষয় নগরায়ন। বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে নগরায়ন হবেই। সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ি এই এলাকায় উন্নয়নের বাজার হবে। উন্নয়নের বাজার মানেই সুন্দরবনের জন্য হুমকি। তিনি বলেন, রামপাল এলাকায় এখন বাতাসে সালফার আছে প্রতি ঘনমিটারে নয় মাইক্রোগ্রাম। এই কেন্দ্র স্থাপন হলে সেটি বেড়ে হবে প্রতি ঘনমিটারে ১৪ মাইক্রোগ্রাম। তবে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ২০ থেকে ২৫ কিলোমিটার দূওে কোনো প্রভাব পড়বে না।

rampal-nosrul

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের নির্বাহি পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকারের আমন্ত্রণে সুন্দরবন পরিদর্শন করতে এসেছি। কিন্তু সেটা দেখতে আসার অর্থ এই প্রকল্পকে সমর্থন দেয়া নয়। এই প্রকল্প স্থাপনে পরিবেশ অধিদপ্তর ৫৯টি শর্ত দিয়েছিল। তারমধ্যে ৫০টি কর্তৃপক্ষ বাস্তবায়ন করেছে বলে জানিয়েছে। এই শর্ত পুরণ হয়েছে কিনা তাই দেখছি। আনুষ্ঠানিকভাবে টিআইবির বক্তব্য পরে জানানো হবে বলে তিনি জানান।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক ডা. মো. আব্দুল মতিন বলেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন কাজ এখনই বন্ধ করে দেয়া উচিত। নতুনভাবে পরিবেশ পর্যালোচনা করেই করা উচিত। তিনি বলেন, এটি খুবই দুঃখজনক বিষয় যে, এখানে যে প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়েছে তাতে নতুন কিছু নেই। আগের তথ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। তথ্য ঘাটতি, ভুল তথ্য আর ব্যাখ্য্ওা ভুল দেয়া হয়েছে। যা কাম্য নয়। তিনি বলেন, সরকার বলছে বাফার জোন থেকে চার কিলোমিটার দূরে এই প্রকল্প। কিন্তু বাফার এলাকা মানেই বন। সব মিলিয়ে সুন্দরবনের প্রতি অবহেলা করা হচ্ছে। এমনিতেই গাছ মারা যাচ্ছে। এরমধ্যে আবার নতুন করে বন ধ্বংসের পরিকল্পনা করা উচিত হবে না। তিনি বলেন, রামপালের জন্য যে পরিবেশ পর্যালোচনা (ইআইএ রিপোর্ট) করা হয়েছে তার মধ্যে সততা নেই। ইআইএ চূড়ান্ত না করে কোনো কাজই করা যায় না। এখানে তার আগেই কাজ শুরু হয়েছে।
ক্যাবের উপদেষ্টা ড. এম. শামসুল আলম বলেন, দুঃখের বিষয় হচ্ছে, একদিকে সরকার আমন্ত্রণ জানাচ্ছে, অন্যদিকে দেশের স্বার্থবিরোধী বলে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া হচ্ছে। সরকারকে সহযোগিতা করতে চাই। উন্নয়ন কাজ করতে হবে। তবে সুন্দরবনকে ধ্বংস করে নয়। সুন্দরবন রক্ষায় সকল ব্যবস্থা নিয়েই এই কেন্দ্র করতে হবে।

rampal
পেট্রোবাংলার সাবেক পরিচালক মকবুল ই এলাহী বলেন, রামপালের মূল বিষয় হচ্ছে, পরিবেশ দুষণ। এই দুষণ যদি নিয়ন্ত্রণ করা যায় তাহলে এটা নিয়ে কথা বলার আর কিছু থাকবে না। অন্যদিকে এ ধরণের প্রকল্প স্থাপনের পর পরিবেশের বিষয়গুলো ঠিকভাবে পালন করা হচ্ছে কিনা তা নিয়ন্ত্রন করতে সর্বস্তরের মানুষকে নিয়ে একটি সেল করতে হবে।
সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য শরীফ জামিল বলেন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সুন্দরবনের দিকে বাতাস যাবে কিনা তা নিয়ে সমীক্ষা করা হয়েছে। সেই সমীক্ষা করা হয়েছে প্রকল্প এলাকা থেকে আট কিলোমিটার দূরের একটি স্থান থেকে। যেটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আর বছরের চার মাস নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কেন্দ্র থেকে সুন্দরবনের দিকে বাতাস যাবে।
পরিদর্শনের সময় অন্যদের মধ্যে সংসদ সদস্য তালুকদার আব্দুল খালেক, বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. আহমেদ কায়কাউস, বাংলাদেশ-ভারত ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইউ কে ভট্টাচার্য, পিডিবির চেয়ারম্যান কে এম হাসানসহ মংলা ও বাগেরহাটের সরকারি উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী কেন্দ্র এলাকায় একটি পানি শুদ্ধকরণ প্ল্যান্টের উদ্বোধন এবং কৃতি শিক্ষার্থীদের দুই হাজার টাকা মূল্যমানের পুরষ্কার বিতরণ করেন।