বিদ্যুৎ খাতে বিপ্লব

সবুজ ইউনুস:
‘সারাদেশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং। দিনের পর দিন অন্ধকার। বিদ্যুতের অভাবে গরমে অতিষ্ঠ হয়ে উপকেন্দ্রে হামলা। হরতালসহ বড় আন্দোলন বিদ্যুতের দাবিতে।’ Ñ সে পরিস্থিতি এখন আর নেই। দেশ এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। সক্ষমতা চাহিদার দ্বিগুণ। ৯৯ শতাংশ মানুষ বর্তমানে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায়। মাথাপ্রতি বিদ্যুৎ ব্যবহারের ক্ষমতা ৫১২ কিলোওয়াট ঘণ্টা। তবে বিদ্যুৎ বিতরণে এখনও কমবেশি সমস্যা রয়েছে। ফলে কোনো কোনো স্থান থেকে এখনও বিদ্যুৎ বিভ্রাটের খবর আসে।
৫০ বছর আগের কথা: বিদ্যুৎ বিভাগ জানায়, ১৯৭০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ছিল মাত্র ৪৭৫ মেগাওয়াট। ১৯৭২ সালে দেশে স্থাপিত বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৫০০ মেগাওয়াট। তবে এই ক্ষমতার অর্ধেক বিদ্যুৎ-ও উৎপাদন করা যেত না।
এই সামান্য বিদ্যুৎ নিয়েই বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের যাত্রা শুরু। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে এখন উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ২৫ হাজার মেগাওয়াট।
২০০৮ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচনে বিশাল জয় নিয়ে ক্ষমতায় আসে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার। ২০০৯ সালের শুরুতে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। প্রকৃত সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল যদিও ৩ হাজার ২৬৮ মেগাওয়াট (৬ই জানুয়ারি, ২০০৯)। এর পরই বিদ্যুৎ খাতে এক প্রকার বিপ্লব সূচিত হয় এ সরকারের আমলেই।
বিদ্যুৎ খাতে বিপ্লব: স্বাধীনতার পর গত ৩৮ বছরে যা হয়েছে; গত ১২ বছরে বিদ্যুৎ খাতে তার চেয়ে অনেক গুণ উন্নতি হয়েছে। গত ১২ বছরে এ খাতে যুগান্তকারী উন্নয়ন হয়েছে। সে ধারা এখনও চলমান। এই ১২ বছরকে বিদ্যুৎ খাতের সোনালি অধ্যায় হিসেবে বর্ণনা করা হচ্ছে। ২০০৯ সালের শুরুতে দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্র ছিল মাত্র ২৭টি। বর্তমানে ১৪৪টি। ১২ বছরে বেড়েছে ১১৭টি। বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। বর্তমানে উৎপাদন ক্ষমতা ২৪ হাজার ৯৮২ মেগাওয়াট। বেড়েছে ২০ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। সঞ্চালন লাইন ছিল ৮ হাজার সার্কিট কিলোমিটার; বর্তমানে ১২ হাজার ৬৯২ কিলোমিটার। বেড়েছে ৪ হাজার ৬৯২ কিলোমিটার। গ্রিড উপকেন্দ্র ছিল ১৫ হাজার ৮৭০টি। বর্তমানে ৪৯ হাজার ৩৮৪টি। বেড়েছে ৩৩ হাজার ৫১৪টি। বিতরণ লাইন ছিল ২ লাখ ৬০ হাজার কিলোমিটার। বর্তমানে ৬ লাখ ৩ হাজার কিলোমিটার। বেড়েছে ৩ লাখ ৪৩ হাজার কিলোমিটার। বিদ্যুৎ গ্রাহক ছিল ১ কোটি ৮ লাখ। বর্তমানে ৩ কোটি ৯৬ লাখ। বেড়েছে ২ কোটি ৮৮ লাখ। সিস্টেম লস ছিল ১৪ দশমিক ৩৩ শতাংশ। বর্তমানে ৮ দশমিক ৭৩ শতাংশ। কমেছে ৫ দশমিক ৬০ শতাংশ।
উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ: বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ২৫ হাজার মেগাওয়াট হলেও এ অবধি সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছে ১২ হাজার ৮৯৩ মেগাওয়াট। ব্যাখ্যা হলো- বিদ্যুৎ এমনই একটা পণ্য, এটা মজুদ করা যায় না। যখন যতটুকু উৎপাদন হয়, তখন ততটুকুই বিতরণ হয়ে যায়। সারাদেশে বর্তমানে যে সংযোগ আছে (আবাসিক, বাণিজ্য, শিল্প মিলিয়ে), সেখানে সংযোগ চাহিদা ওই ১২ হাজার ৮৯৩ মেগাওয়াট। অর্থাৎ বিদ্যুৎ সরবরাহ কাঠামো সর্বোচ্চ ওই পরিমাণ বিদ্যুৎ কোনো একদিন সরবরাহ করতে সক্ষম হয়েছে। যদিও বর্তমানে এর দ্বিগুণ পরিমাণ উৎপাদন করার সুযোগ আছে। বর্তমানে চাহিদা বাড়লেও তা পূরণ করা কোনো সমস্যা হবে না। কারণ ২৫ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদনের সক্ষমতা আছে।
বিশ্নেষকরা জানান, উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে উৎপাদন ক্ষমতা সব সময় কিছুটা উদ্বৃত্ত রাখা হয়। কারণ যে কোনো সময় বিদ্যুৎকেন্দ্র একটি অচল হয়ে পড়তে পারে। তবে আমাদের দেশে চাহিদার চেয়ে অতিরিক্ত উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ। হাজার হাজার কোটি টাকার এই বিনিয়োগ অলস বসে থাকলে তার জন্য আর্থিক ক্ষতি হয়। চাহিদার সঙ্গে সমন্বয় করে উৎপাদন সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন নির্মাণ হয়নি বলেই এ অবস্থা হয়েছে বলে বিশ্নেষকরা মনে করেন।
জ্বালানির বহুমুখীকরণ: বিদ্যুৎ উৎপাদনে এখন বহুমুখী জ্বালানির ব্যবহার নিশ্চিত করা হচ্ছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও এ নীতি অনুসরণ করা হয়। কারণ বিশ্ববাজারে বিভিন্ন রকম জ্বালানির মূল্য ওঠানামা করে। আমাদের দেশে এক সময় অধিকাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি ছিল প্রাকৃতিক গ্যাস। এখন গ্যাসের পাশাপাশি কয়লা, ফার্নেস অয়েল, পারমাণবিক শক্তি, ডিজেল, পানি, সৌরশক্তি, বায়ু ইত্যাদির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ভবিষ্যতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে পরিবেশবান্ধব জ্বালানির কথা বিশেষ বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এ জন্য সোলার বা সৌর, বায়ু, পানির ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
মহাপরিকল্পনা: বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনায় ভিশন-২০৩০ তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, দেশের অভ্যন্তরীণ মুখ্য জ্বালানির উৎস তৈরি করতে হবে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ৫০ শতাংশ জ্বালানির চাহিদা মেটাতে হবে, যার ২৫ শতাংশ হবে কয়লা, ২০ শতাংশ হবে প্রাকৃতিক গ্যাস ও বাকি ৫ শতাংশ হাইড্রো ও নবায়নযোগ্য শক্তি।
বর্তমানে অর্থাৎ ২০২১ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহার ৫২ শতাংশ, ফার্নেস অয়েল ২৭ শতাংশ, ডিজেল ৬ শতাংশ, কয়লা ৮ শতাংশ, জল ১ দশমিক ১ শতাংশ, গ্রিড সোলার শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ, বিদ্যুৎ আমদানি ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। পরবর্তী সময়ে ভিশন ২০৩০-এ পরিবর্তন আনা হয়েছে। পরিবেশ দূষণ ও এসডিজির দিকে লক্ষ্য রেখে সরকার মহাপরিকল্পনায় কয়লার ব্যবহার কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিদ্যুতের এই বিপ্লবে দেশের অর্থনীতিতে গতি এসেছে। এই ধারা অব্যাহত থাকবে আশা করি।

লেখক: সাংবাদিক