বিদ্যুৎ: ঘাটতি সমন্বয় ও যৌক্তিক দাম
পাইকারি ও খুচরা বিদ্যুতের মূল্যহার এবং সঞ্চালন ও বিতরণ চার্জ বৃদ্ধির প্রস্তাবসমূহের ওপর বিইআরসি সম্প্রতি গণশুনানী শেষ করেছে। বিইআরসি’র কারিগরি কমিটির হিসেবে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় ৫.৭০ টাকা। কিন্তু ৪.৯০ টাকা থেকে ক্রমাগত কমতে থাকা পাইকারি বিদ্যুতের মূল্যহার এখন ৪.৭৭ টাকা। ফলে বছরে ঘাটতি ৭,৩৫৩ কোটি টাকা। তবে সে-ঘাটতি গণশুনানীতে ন্যায্য ও যৌক্তিক বলে প্রমান হয়নি। কারণ বিদ্যুৎ সরবরাহে ব্যয় ও ব্যয়বৃদ্ধি ন্যায্য ও যৌক্তিক না হলে আর্থিক ঘাটতির দাবি ন্যায্য ও যৌক্তিক হয়না।
মূল্যহার পরিবর্তনের যৌক্তিকতা নিশ্চিতকরণে বিবেচ্য বিষয়:- ১. উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ কোম্পানীগুলির পরিশোধিত মূলধনের ওপর প্রদত্ত লভ্যাংশ ১২শতাংশ। যেহেতু সরকার ব্যাংক আমানতের ওপর সুদ কমিয়েছে, সেহেতু সে-লভ্যাংশ কমানো, ২. সরকারি সংস্থা বিধায় আরইবি ও পিডিবি’র সেবা বানিজ্যিক নয়, না-লাভ না-ক্ষতিভিত্তিক, ৩. মানসম্মত বিদ্যুৎ সরবরাহে অনিশ্চিয়তা, ৪. সম্পদ যতটুকু ব্যবহার হয়, অবচয়-ব্যয় ততটুকুর ওপর ধার্য করা, ৫. ভোক্তাদের মতে মূল্যহার নির্ধারণে গণশুনানী গুরুত্ত¡হীন, ৬. ভোক্তা অভিযোগ নিষ্পত্তিতে বিইআরসি’র নিষ্ক্রিয়তা ৭. সরকারের নীতি ও কৌশল এবং অদক্ষতা ও দূর্নীতির কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহে অযৌক্তিক ব্যয়বৃদ্ধি, ৮. বিইআরসি কর্তৃক প্রবর্তিত মূল্যহার নির্ধারণ মানদন্ড, ৯. মূল্যহার নির্ধারণে সততা/সুবিচার নিশ্চিত করা, এবং ১০. সঠিক মাপে, মানে ও দামে ভোক্তার বিদ্যুৎ প্রাপ্তির অধিকার সুরক্ষা নিশ্চিত করা।
কিন্তু মূল্যহার নির্ধারণে এ-সব বিবেচ্য বিষয় গুরুত্ত¡ পায়না। এ-সম্পর্কে গণশুনানীতে বলা হয়:- (ক) জ্বালানি তেল ও এলপিজি’র মূল্যহার নির্ধারণের একক এখতিয়ার বিইআরসি’র, নির্ধারণ করে জ্বালানী বিভাগ ও এলপিজি ব্যবসায়ী; (খ) নবায়ণযোগ্য বিদ্যুতের মূল্যহার নির্ধারণ করে বিদ্যুৎ বিভাগ, এখতিয়ার বিইআরসি’র; (গ) অব্যবহৃত স্বল্পব্যবহৃত হলেও সমূদয় উৎপাদনক্ষমতা ধরে অবচয় ব্যয় ধার্য করা হয়, (ঘ) ২০১৭ সালে বিদ্যুতের মূল্যহার বৃদ্ধির আদেশে গণশুনানীতে পেশকৃত ২৩টি সুপারিশের মধ্যে গৃহীত হয় ১টি, (ঙ) ২০১৫ সালে গণশুনানিতে প্রমানিত হয় বিদ্যুৎ সঞ্চালনে ঘাটতি ১.৫৭%, চার্জ বৃদ্ধি করা হয় ২১%, (চ) ক্যাবের পেশকৃত কোন অভিযোগ বিইআরসি নিস্পত্তি করেনা, (যেমন আরইবি ও পিডিরি’র সাথে সামিটের দু’টি সম্পূরক চুক্তি সম্পর্কিত অভিযোগ), (ছ) মূল্যহার বৃদ্ধির প্রস্তাব মূল্যায়নে তথ্য প্রাপ্তি অনিশ্চিত, (জ) ক্যাব কমিশনের তদন্তে প্রতিয়মান হয় (১) মূল্যহার নির্ধারণে বিইআরসি পক্ষপাতহীন নয় এবং (২) বিইআরসি’র আদেশে বিইআরসি আইন উপেক্ষিত (যেমন (১) তিতাসের ক্ষেত্রে সিস্টেমলস সুবিধা ২%, অন্যদের ক্ষেত্রে নয় এবং পরিশোধিত মূলধনে লভ্যাংশ ১২%, অথচ তিতাসের জন্য ১৮% এবং (২) বিদ্যুৎ রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়ন তহবিল গাইডলাইন পরিবর্তন করে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয়বৃদ্ধি), (ঝ) শুনানীতে এনভয় টেক্সটাইল মিলে গ্রীডবিদ্যুৎ মাসভিত্তিক বিঘ্ন-ঘণ্টা দেখানো তথ্যদিতে দেখা যায়, মাসে বিদ্যুৎ বিঘœ গড়ে ৫৯ ঘন্টা। এ-সবে বুঝা যায়, ভোক্তা সঠিক দামে ও মানে বিদ্যুৎ পায়না।
বিদ্যুৎ সরবরাহে অযৌক্তিক ব্যয় যৌক্তিক করার লক্ষ্যে পেশকৃত প্রস্তাবসমূহ:- ১. যেহেতু রেন্টাল বিদ্যুৎ ক্রয়ে প্রদত্ত ক্যাপাসিটি চার্জেই চুক্তির প্রথম মেয়াদে প্ল্যান্ট-কস্ট উঁসুল হয়েছে, সেহেতু মূল্যহারে উক্ত চার্জ সমন্বয় না করা, (তাতে বছরে সমš^য় হবে ২১৭৬ কোটি টাকা)। ২. বিদ্যুৎ রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়ন তহবিলে বরাদ্দহার ০.১৫ টাকা রহিত করা (সমš^য় হবে ১৩০৫ কোটি টাকা), ৩. পিজিসিবি’র মতে সঞ্চালনে সিস্টেমলস ২.৭৫%, ৩% নয়, ফলে পাইকারী মূল্যহারে সিস্টেমলস ২.৭৫% ধরা (সমন্বয় হবে ১১০ কোটি টাকা), ৪. সরকারি সেবাসংস্থা হিসেবে পিডিবি’র সেবা মুনাফা মুক্ত ধরা (সমন্বয় হবে ৫০০ কোটি টাকা),এবং ৫. সরকারি নীতির আওতায় প্রান্তিক ও সেচ গ্রাহককে স্বল্প মূল্যহারে দেয়া বিদ্যুতে আর্থিক ঘাটতি সরকারি অনুদানে সমন্বয় করা (সমন্বয় হবে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা)। অর্থাৎ বিদ্যুৎ উৎপাদনে অযৌক্তিক ব্যয় মোট ৮,৫৯১ কোটি টাকা। ঘাটতি ৭,৩৫৩ কোটি টাকা।
পরিশোধিত মূলধনের ওপর লভ্যাংশ ১২% হিসেবে বিদ্যমান সঞ্চালন চার্জ ০.২৭৮৭ টাকা। ১৫% লভ্যাংশে প্রস্তাব ০.২৯৮০ টাকা। ক্যাবের প্রস্তাব লভ্যাংশ হ্রাস। বিদ্যমান লভ্যাংশে প্রস্তাব ০.২৯৬৩ টাকা। তাতে সমš^য় হয় ১৩ কোটি টাকা। তাছাড়া পিডিবি ও আরইবি মুনাফামুক্ত। অথচ তাদের মুনাফা যথাক্রমে ০.১৫ ও ০.২২ টাকা। আবার ডেসকো’র ক্ষেত্রে পরিশোধিত মূলধনের ওপর লভ্যাংশ ১২% নয়, ১৫%। এ-সবে ক্যাবের আপত্তি রয়েছে। এ-সব ব্যয় যৌক্তিক হলে সমš^য় হবে ১০৮৮ কোটি টাকা। সরকারের সবার জন্য বিদ্যুৎ কর্মসূচি আরইবি বাস্তবায়ন করে। তাতে আরইবি আনইকনমিক্যালি সম্প্রসারণ হচ্ছে। ব্যয়হার বাড়ছে। এ-ব্যয় কারিগরি বিবেচনায় যৌক্তিক ব্যয় অপেক্ষা অধিক। তাই জনবল ও অবচয় বাবদ যৌক্তিক ব্যয়ের অধিক ব্যয় (প্রায় ৮০২ কোটি টাকা) সরকারি অনুদানে সমš^য় হবে। ইউনিট প্রতি ঘাটতি সঞ্চালনে ০.০১৭৬ টাকা এবং বিতরণে উদ্বৃত্ত ০.০৪ টাকা। কিন্তু অযৌক্তিক ব্যয় ১৯০৩ কোটি টাকা।
বিদ্যুৎ সরবরাহে অযৌক্তিক ব্যয় (রেন্টাল বিদ্যুতে ক্যপাসিটি চার্জ, বিদ্যুৎ উন্নয়ন তহবিলে বরাদ্দ, সঞ্চালনে সিস্টেমলসজনিত উৎপাদন ব্যয়বৃদ্ধি, উৎপাদনে পিডিবি’র মুনাফা, নীতিগত কারণে পাইকারী বিদ্যুতে মূল্যহার ক্ষতি, সঞ্চালন ও বিতরণে লভ্যাংশ বৃদ্ধি, বিতরণে পিডিবি-আরইবি’র মুনফা, এবং নীতিগত কারণে আরইবি’তে জনবল ও অবচয় ব্যয়বৃদ্ধি যথাক্রমে ২১৭৬, ১৩০৫, ১১০, ৫০০, ৪৫০০, ১৩, ১০৮৮, এবং ৮০২ কোটি টাকা) সর্বমোট ১০,৪৯৪ কোটি টাকা ঘাটতিতে সমন্বয়ক্রমে পাইকারী ও খুচরা বিদ্যুতের মূল্যহার এবং সঞ্চালন ও বিতরণ চার্জ পরিবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে। তাছাড়া অযৌক্তিক ব্যয়বৃদ্ধি প্রতিরোধেও কিছু প্রস্তাব গণশুনানীতে রাখা হয়েছে।
অধ্যাপক ড. শামসুল আলম