বিদ্যুৎ-জ্বালানিতে প্রতিমাসে ছাড় হবে ১ বিলিয়ন ডলার

লুৎফর রহমান কাকন: 

বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের পাওনা বিল, বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি, বিদেশি কোম্পানির পাওনা অর্থছাড় এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে প্রয়োজনীয় ডলার সংকট দূর করতে প্রতি সপ্তাহে ২৪০ মিলিয়ন ডলার ছাড়ের সিদ্ধান্ত হয়েছে। সে হিসাবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা এবং পাওনা টাকা পরিশোধে প্রতিমাসে প্রায় এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড় করা হবে।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ খাতের গুরুত্ব বিবেচনা করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এই অর্থ ছাড়ের নির্দেশ দেওয়ার পর এ সিদ্ধান্ত হয়েছে।

কয়েক মাস প্রয়োজনীয় অর্থ ও ডলার সংকটে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগ অস্বস্তিতে ছিল। অর্থ মন্ত্রণালয়ে দফায় দফায় চিঠি চালাচালি করেও প্রয়োজনীয় ডলার ছাড় করতে পারেনি। সম্বিপ্দ্যুর

সম্প্রতি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আগামী ছয় মাসে এ খাতে কী পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন তার চিত্র প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করা হয়। পরে প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানির নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে বকেয়া বিল শোধ করতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের বিদ্যুৎ বিল ও জ্বালানির দাম, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) ও শেভরনের বকেয়া অর্থসহ বিভিন্ন ধরনের দেনা মেটাতে সম্প্রতি ৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড় করা হয়েছে। এতে জ্বালানি খাতের জন্য ছাড় করা হয়েছে ২০ মিলিয়ন এবং বিদ্যুৎ খাতের জন্য ৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রতিমাসে ধাপে ধাপে বকেয়া বিল পরিশোধ করা হবে বলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ডলার সংকটের কারণে আমাদের অনেক টাকা বকেয়া পড়ে গিয়েছিল। বকেয়ার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর কাছে উত্থাপন করেছিলাম। প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। সে অনুযায়ী বকেয়া পরিশোধে মার্কিন ডলার ছাড় করা শুরু হয়েছে। খুব শিগগির বকেয়া পরিশোধ হয়ে যাবে।

এ বিষয়ে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ইমরান করিম বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানিতে ডলারের ছাড়ের বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তাতে দুয়েক মাসের মধ্যেই বকেয়া পরিশোধ হয়ে যাবে বলে আশা করছি।

গেল অর্থবছর (২০২২-২৩) ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের বিপরীতে বকেয়া বিলের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৭৫ দশমিক ০৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর চলতি অর্থবছর (২০২৩-২৪) এই খাতে এক হাজার ৭৫৫ মিরিয়ন মার্কিন ডলার প্রয়োজন হবে। আইপিপি (ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রোডিউসার), রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনার জন্য জ্বালানি তেল (ফার্নেস অয়েল) আমদানির বিপরীতে গেল অর্থবছরের বকেয়া রয়েছে ৮৯০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ৫৫৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। আর চলতি অর্থবছরে এই খাতে প্রয়োজন হবে ২৫৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে নির্মিত ও বড় আইপিপি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা আমদানির বিপরীতে গেল অর্থবছরের বকেয়া রয়েছে ৫৭৩ দশমিক ৪৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এরই মধ্যে বাংলাদেশ-চায়নার যৌথ মালিকানায় নির্মিত পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কয়লার বিল বাবদ ১৮০ মিলিয়ন ডলার এবং বাংলাদেশ ভারত যৌথ উদ্যোগে নির্মিত রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লার বিল বাবদ ৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। এই খাতে চলতি অর্থবছরে এক হাজার ৫১৩ দশমিক ০৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রয়োজন হবে।

এ ছাড়া ডিজেলভিত্তিক মোট এক হাজার মেগাওয়াটের আইপিপি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরের বিল পরিশোধ করতে লাগবে ১৬১ দশমিক ৮৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর চলতি অর্থবছরে এই খাতে প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩৭ দশমিক ৬৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ইসিএ (এক্সপোর্ট ক্রেডিট এজেন্সি) অর্থায়নে বাস্তবায়িত বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) প্রকল্পসমূহের রিপেমেন্ট করার জন্য গত অর্থবছরে ৭৩ দশমিক ২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বকেয়া রয়েছে। চলতি অর্থবছরে এই খাতে প্রয়োজন হবে ১৪৬ দশমিক ৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ ছাড়া পিডিবির বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রের লং-টার্ম সার্ভিসেস অ্যাগ্রিমেন্টের (এলটিএসএ) বিল পরিশোধ করতে গেল অর্থবছরের জন্য প্রয়োজন ১৪ দশমিক ০৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। চলতি অর্থবছরের জন্য প্রযোজন হবে ২৮ দশমিক ০৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিদ্যুৎ বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, গেল অর্থবছরের বকেয়া ও চলতি অর্থবছর মিলে বিদ্যুৎ খাতে প্রয়োজন পাঁচ হাজার ৯২১ দশমিক ০৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

এ ছাড়া জ্বালানি খাতে মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন বাংলাদেশ গ্যাসের বকেয়া বিল সুদসহ পরিশোধে এক মাসের সময় দিয়েছিলে। গত ১৩ জুলাই পেট্রোবাংলাকে পাঠানো এক চিঠিতে কোম্পানিটি জানায়, তাদের বকেয়ার পরিমাণ ২৮ কোটি ৭ লাখ ২৬ হাজার ৫৮৯ মার্কিন ডলার। এ ছাড়া এলএনজি সরবরাহের বিপরীতে গানভর সিঙ্গাপুরের বকেয়া বিলের ৪১ দশমিক ৫৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এরই মধ্যে পরিশোধ করা হয়েছে ১৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাকি রয়েছে ২৮ দশমিক ৫৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। একইভাবে টোটাল এনার্জিসের দুই কার্গো এলএনজির বিলও এখন বকেয়া রয়েছে। এ ছাড়া তাল্লো বাংলাদেশসহ আরও কয়েকটি কোম্পানির বিল বকেয়া রয়েছে বলে জানা গেছে।

চলতি জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের পরিকল্পনা করছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এ লক্ষ্যে চার বিলিয়ন ডলার বা ৪৩ হাজার কোটি টাকা (রেটপ্রতিডলার ১০৯ টাকা) প্রয়োজন।

দৈনিক আমাদের সময়