বিদ্যুৎ নিয়ে মশকরা
চিররঞ্জন সরকার:
হতাশা, ফেসবুক, মশা, লোডশেডিং, তামাশা আর পরনিন্দা-পরচর্চায় ভরা আমাদের মধ্যবিত্ত জীবন। মাঝে কয়েক বছর বিদ্যুৎ উৎপাদন ভালো ছিল। তখন মনে হয়েছে, আমাদের জীবন থেকে লোডশেডিং বুঝি ছুটি নিল। কিন্তু করোনা মহামারী শুরু হওয়ার পর সব কিছু ল-ভ- হয়ে যায়। মানুষ ঘরবন্দী জীবন কাটাতে বাধ্য হয়। অনেকের আয়-উন্নতি বন্ধ হয়ে যায়। উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। জ্বালানির দাম বাড়তে থাকে। জ্বালানি সংকটের কারণে আবার বিদ্যুৎ উৎপাদন কমতে থাকে। ইউক্রেইন-রাশিয়া যুদ্ধ সংকটকে আরও বাড়িয়ে দেয়। সুসময়ে টেকসই সমাধানের কথা ভাবা হয়নি। বরং ইচ্ছেমতো টাকা ছিটিয়ে, অপিরণামদর্শী চুক্তির মাধ্যমে নিজের লোকদের টুপাইস কামানোর সুযোগ দিয়ে, কেবল উৎপাদন ‘বাড়িয়ে দেখানোর’ একটা প্রবণতা লক্ষ করা যায়। যে ভুলের মাশুল এখন গুনতে হচ্ছে। আমাদের জীবনে ফিরে এসেছে সেই ছোটবেলার লোডশেডিং।
এক সময় আমাদের দেশে, বিশেষত গ্রামে লোডশেডিং ছিল নিয়মিত ঘটনা। তখন বিদ্যুৎ প্রায় থাকত না বললেই চলে। হঠাৎ হঠাৎ আসত। তখন সারাদিনে কয়েকবার বিদ্যুৎ চলে যাওয়া এবং আসাটা নিয়ম ছিল। আর সেই আসা-যাওয়ার গল্পের ‘এক কথায় প্রকাশ করো’-র নাম ছিল ‘লোডশেডিং’। তখন এমনও সময় গেছে যখন টানা দুই-তিন দিন বিদ্যুৎ থাকেনি। কারণ তখন বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল কম। আমরা সেই সময় হারিকেন, কুপি দিয়ে আলো জ্বালাতাম। হাতপাখা দিয়ে নিজে নিজেকে বাতাস করতাম। তখন অন্ধকারে পথ চলার জন্য কেউ কেউ টর্চলাইট ব্যবহার করতেন। জিরো ফিগার মডেলদের মতো এভারেডি টর্চের কথা এখনও মনে পড়ে! এখন হারিকেন, কুপি বা টর্চের ব্যবহার প্রায় নেই বললেই চলে। হারিকেন-কুপির প্রয়োজন মেটায় চার্জ লাইট। আর টর্চের প্রয়োজন মেটায় মোবাইল ফোন।
গত দেড় দশকে ‘উন্নতির মহাসড়ক’ ধরে আমরা দ্রুতগতিতে দৌড়েছি। অত্যাধুনিক যন্ত্রপ্রযুক্তি আমাদের জীবনকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। পুরো দেশ বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে। প্রায় ৬৮ হাজার গ্রামে ‘বিদ্যুতায়ন’ ঘটেছে। এখানে একটুখানি ব্যাকরণের কচকচানি করা যেতে পারে। ‘বিদ্যুতায়ন’ শব্দটি নাকি ব্যাকরণসিদ্ধ নয়। বিদ্যুৎ+আয়ন= বিদ্যুদায়ন। সংস্কৃত ব্যাকরণে বর্ণিতবিধি অনুসারে ‘বিদ্যুৎ’ শব্দের সঙ্গে ‘আয়ন’ যোগে গঠিত হয়েছে ‘বিদ্যুদায়ন’। সেই অনুসারে ‘বিদ্যুদায়ন’ শব্দটিই ব্যাকরণগতভাবে শুদ্ধ। বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানমতে, বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত সংস্কৃত ‘বিদ্যুদায়ন (বিদ্যুৎ+আয়ন)’ শব্দের অর্থ বৈদ্যুতীকরণ। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় বষবপঃৎরভরপধঃরড়হ। ‘বিদ্যুদায়ন’ শব্দের সমার্থক হিসেবে অধুনা ‘বিদ্যুতায়ন’ শব্দটির বহুল ব্যবহার লক্ষণীয়। সংস্কৃতমতে, এর জন্মে গ-গোল রয়েছে। তাই ‘বিদ্যুতায়ন’ নাকি শুদ্ধ শব্দ নয়, রীতিমতো অবৈধ।
সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়মানুসারে ‘বিদ্যুৎ+আয়ন = বিদ্যুদায়ন’। কাজেই ‘বিদ্যুৎ+আয়ন = বিদ্যুতায়ন’ হতে পারে না। তারপরও প্রথম পদের (বিদ্যুৎ) শেষ বর্ণ ‘খ–ৎ’-কে ‘আস্ত-ত’ ধরে নিয়ে তার সঙ্গে ‘আ-কার’ দিয়ে ব্যাকরণিক সব নিয়মনীতি ভঙ্গ করে অবৈধভাবে ‘বিদ্যুতায়ন’ শব্দটির জন্ম দেওয়া হয়েছে। তাই বৈয়াকরণদের অভিমত, ‘বিদ্যুতায়ন’ শব্দটি ব্যাকরণগতভাবে অশুদ্ধ এবং অবৈধ।
বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানমতে, বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত সংস্কৃত ‘বিদ্যুতায়ন (বিদ্যুৎ + আয়ন)’ শব্দটি ‘বিদ্যুদায়ন (বিদ্যুৎ+ আয়ন)’ শব্দের অশুদ্ধ প্রচলিত রূপ। অশুদ্ধ বা অবৈধ যাই হোক, ‘বিদুত্যায়ন’ শব্দটি ইতোমধ্যে বিশাল গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে বৈধ ‘বিদ্যুদায়নকে’ প্রায়োগিক জগৎ থেকে বিতাড়নই করেই দিয়েছে প্রায়। শুদ্ধ হয়েও সংস্কৃত ‘বিদুদ্যায়ন’ এখন কোণঠাসা। অশুদ্ধ ‘বিদ্যুতায়ন’ এত বহুল প্রচলিত যে, এটাকে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়।
যাহোক, বিদ্যুৎ এবং লোডশেডিং নিয়ে মানুষের ক্ষোভের কোনো শেষ নেই। কিন্তু ক্ষুব্ধ হয়ে আর কী হবে? বিদ্যুৎ সমস্যার দ্রুত সমাধান হবে, এই ভরসা নেই। অগত্যা শুরু হয়েছে বিদ্যুৎ নিয়ে নানা ধরনের ঠাট্টামশকরা।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ ধরনের ঠাট্টা-মশকরার তুফান বয়ে যাচ্ছে। এই তীব্র গরমে লোডশেডিং-ক্লিষ্ট জীবনে ক্ষোভ-রোষ না দেখিয়ে বরং কিছু ঠাট্টা-মশকরার ব্যাপারে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা যাক। একজন রসিক ব্যক্তি সম্প্রতি লিখেছেন, “গরমে মাথা গরম। ডাব খেতে গেলাম। একটা ডাবের দাম চাইল ১৫০ টাকা। ডাবের দাম শুনে মাথা আরও গরম হয়ে গেল। দেখলাম অনেকে ডাবের দাম শুনেই চলে যাচ্ছে। ব্যাপারটা খারাপ লাগল।
বাসায় এসে দেখি বিদ্যুৎ নেই। জেনারেটরও চলছে না। দারোয়ানকে ফোন দিলাম। সে বলল, তেল নেই। মনে মনে বললাম, সরকারের কাছেই যেখানে জ্বালানি ও কয়লা কেনার টাকা নেই, সেখানে আমার বিল্ডিংয়ে তেল না থাকাই তো স্বাভাবিক!”
অপর একজনের মন্তব্য, ‘‘বিদ্যুৎ নেই জেনেও ফোন চার্জে দেওয়াকে বলে ‘সরলতা।’ বিদ্যুৎ আসার পর ফোনে চার্জ হচ্ছে মনে করা হলো ‘বিশ্বাস’। তিন ঘণ্টা পর এসে দেখলাম ভুলে সুইচ দেইনি! এটা হলো ‘বোকামি’। যা হয়েছে বাদ দিয়ে আবার সুইচ দেওয়াকে বলে ‘ক্ষমা’। সুইচ দেওয়ার পর আবার বিদ্যুৎ যাওয়াকে বলে ‘মন ভাঙ্গা’। বিদ্যুৎ আবার আসতে দেরি হবে ভেবে ফোন সঙ্গে নিয়ে বাইরে যাওয়া হলো ‘কনফিডেন্স’। তিন ঘণ্টা পর বাসায় এসে শুনলেন বেরিয়ে যাওয়ার পরপরই বিদ্যুৎ এসেছে, এটা হলো ‘কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা’। আবার তড়িঘড়ি করে চার্জে লাগানোর সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ যাওয়াকে বলে ‘ছ্যাকা।’ বিদ্যুৎ আসতে পারে ভেবে তিনঘণ্টা বাসায় বসে থাকা হলো ‘অপেক্ষা’। তিনঘণ্টা অপেক্ষা করে নিজের উপর বিরক্ত হয়ে মন খারাপ করাকে বলে ‘ডিপ্রেশন’। এখন আমি ডিপ্রেশনে আছি!’’
ক্রমাগত লোডশেডিংয়ে তিতি-বিরক্ত কিন্তু রসিক মানুষ এখন ‘লোডশেডিং’ নিয়ে বিভিন্ন কৌতুক চালু করেছে। তেমন একটি কৌতুক:
মৃণাল একদিন স্কুলে হোমওয়ার্ক নিয়ে যায়নি। শিক্ষক বললেন– হোমওয়ার্ক করোনি কেন?
– স্যার লোডশেডিং ছিল।
– তা মোমবাতি জ্বালিয়ে নিতে।
– স্যার, দেশলাই ছিল না।
– দেশলাই ছিল না কেন?
– ঠাকুরঘরে রাখা ছিল স্যার।
– আচ্ছা, ঠাকুরঘর থেকে নিলে না কেন?
– স্নান করিনি, ঠাকুরঘরে ঢুকব কী করে?
– উফফফ। তা স্নান করতে কে বারণ করেছিল?
– জল ছিল না স্যার।
– জল কেন ছিল না?
– পাম্পের মোটর চলছিল না স্যার।
টিচার, এবারে ধৈর্য্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়ে, দাঁত কিড়মিড় করে বললেন– ‘আরে উল্লুক, মোটরটা কেন চলছিল না?’
– স্যার, আপনাকে তো প্রথমেই বললাম যে লোডশেডিং ছিল!
পুনশ্চ: বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে সর্বশেষ একটি পুরনো কৌতুক বলা যাক। বাংলাদেশের এক মন্ত্রীবাহাদুর মারা যাবার পর তাকে জাহান্নামে পাঠানো হলো। তিনি সেখানে গিয়ে দেখলেন, বিভিন্ন দেশের নামে জাহান্নামগুলোর নাম। তাকে যেকোনো দেশের জাহান্নামে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
মন্ত্রী বাহাদুর প্রথমেই আমেরিকার জাহান্নামে গিয়ে পাহারাদারকে জিজ্ঞেস করলেন, “এখানে শাস্তি কেমন?”
পাহারাদার বলল, “প্রতিদিন প্রথমে সকলকে ইলেক্ট্রিক চেয়ারে বসিয়ে ১ ঘণ্টা ইলেক্ট্রিক শক দেওয়া হয়। তারপর পেরেকের বিছানায় এক ঘণ্টা শোয়ানো হয়। এরপর এক দৈত্য পিঠে ৫০টা চাবুকের ঘা দেয়।”
এটা শুনে মন্ত্রী ভদ্রলোক খুব ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি ভাবলেন, রাশিয়ার জাহান্নামে গিয়ে দেখা যাক। ওরা তো এক সময় সাম্যবাদী দেশ ছিল। কিন্তু সেখানেও পাহারাদার একই কথা বলল। এরপর সে নরওয়ে, সুইডেন, জাপান, সুইজারল্যান্ড, চীনসহ বিভিন্ন উন্নত দেশের জাহান্নামে গেলেন। কিন্তু সব পাহারাদারই তাকে একই শাস্তির কথা বলল।
অগত্যা তিনি অনন্যোপায় হয়ে বাংলাদেশের জাহান্নামে গেলেন। সেখানে প্রবেশ পথে দরজায় বড় করে লেখা: আপনাকে বাংলাদেশের জাহান্নামে স্বাগতম।
দরজার বাইরে মানুষের দীর্ঘ লাইন।
এত মানুষের সমাগম দেখে মন্ত্রী সাহেব ভাবলেন, এখানে নিশ্চয়ই কম শাস্তি দেওয়া হয়, তাই এত লম্বা লাইন। পাহারাদারকে জিজ্ঞেস করলেন, “এখানে কেমন শাস্তি দেওয়া হয়?”
পাহারাদার বললেন, “স্যার, এখানে প্রতিদিন প্রথমে ইলেক্ট্রিক চেয়ারে বসিয়ে ১ ঘণ্টা ইলেক্ট্রিক শক দেওয়া হয়। তারপর পেরেকের বিছানায় এক ঘণ্টা শোয়ানো হয়। সব শেষে এক দৈত্য এসে ৫০টা চাবুকের ঘা দেয়।”
মন্ত্রী সাহেব বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “একই রকম শাস্তি তো সব দেশের জাহান্নামেই দেওয়া হয়, তাহলে এই জাহান্নামে এত ভিড় কেন?”
পাহারাদার জবাব দিল, “আপনি বাংলাদেশের মানুষ হয়েও এর কারণ জানেন না? এখানে ইলেকট্রিক চেয়ার ঠিকই আছে, কিন্তু বিদ্যুৎ নেই। পেরেকের বিছানা থেকে পেরেক চুরি হয়ে গেছে।
যে দৈত্যটি চাবুক মারে সে একজন সরকারি কর্মচারী। কোনো একসময় আসে, খাতায় সই করে বাড়ি চলে যায়। আর যে এক আধ দিন ডিউটি করে, সেদিন দু-একটা চাবুক মারে, আর রেজিস্টারে ৫০টা চাবুকের ঘা লিখে বেরিয়ে যায়।
এখানে আবেদন এত জমা পড়েছে যে কবে ডাক আসবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আর ডাক না আসলে শাস্তিও নেই!”
অগত্যা মন্ত্রী বাহাদুর সেখানেই সিরিয়ালে দাঁড়ালেন!