বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থাই বিপন্ন

সিরাজগঞ্জ শহরের ব্যাংকপাড়ায় নড়বড়ে কাঠের খুঁটির সঙ্গে বিদ্যুতের লাইন। শহরটির কোনো কোনো এলাকায় এখনো এভাবে কাঠের খুঁটিতে ঝুঁকিপূর্ণভাবে টানানো আছে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন। গতকাল তোলা ছবি l সিরাজগঞ্জ শহরে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে, চাহিদা অনুসারে বেড়েছে লোড। কিন্তু সঞ্চালন লাইনের উন্নয়ন হয়নি দীর্ঘদিনেও। ফলে শহরের বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থাই হয়ে পড়েছে বিপন্ন। কম ক্ষমতার ট্রান্সফরমারগুলো প্রায়ই বিকল হচ্ছে বা ফিউজ কেটে যাচ্ছে। এতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হয়ে ভোগান্তিতে পড়ছে মানুষ।
অভিযোগ রয়েছে, বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার মেরামত এবং তা নামানো-ওঠানোর খরচ বাবদ টাকা নেওয়া হয় সংশ্লিষ্ট গ্রাহকদের কাছ থেকেই।
সরেজমিেন দেখা গেছে, শহরের বাহিরগোলা ও রায়পুরে পিডিবির দুটি ৩৩/১১ কেভি উপকেন্দ্র রয়েছে। প্রতিটিতে উচ্চক্ষমতার দুটি করে ট্রান্সফরমার রয়েছে। এগুলোর সরবরাহের ক্ষমতা ৪০ মেগাওয়াট। এই দুটি উপকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৮২ সালে। শহরের শিয়ালকোলের ১৩২/৩৩ কেভি জাতীয় গ্রিড কেন্দ্র থেকে এই দুই উপকেন্দ্রে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়।
পিডিবির সূত্র বলেছে, বর্তমানে শহরে গ্রীষ্মকালে চাহিদা দৈনিক ২৮ থেকে ৩০ মেগাওয়াট, শীতে তা প্রায় ২০ মেগাওয়াটে নেমে আসে। দুই উপকেন্দ্রের মধ্যে বাহিরগোলার আটটি ফিডার ও রায়পুরের সাতটি ফিডারের মাধ্যমে পুরো শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। কিন্তু উপকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে কখনোই ওই চারটি ট্রান্সফরমারের সংস্কার করা হয়নি। ট্রান্সফরমারগুলোর ভেতরের তেল (ইনসলিশন অয়েল) না বদলানোয় এগুলোর কার্যক্ষমতা কমতে কমতে এখন অর্ধেকেরও নিচে নেমে এসেছে। চারটি ট্রান্সফরমারের ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহের কথা। জাতীয় গ্রিডে পর্যাপ্ত বিদ্যুতের জোগান থাকলেও এই দুই উপকেন্দ্র থেকে গ্রাহকদের ২০ মেগাওয়াটের বেশি সরবরাহ করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় শীতকালে তেমন সমস্যা না হলেও বছরের বাদবাকি সময় সিরাজগঞ্জ শহরে লোডশেডিং করা হচ্ছে। তবে এবারের গ্রীষ্মে পিক আওয়ারে লোডশেডিংয়ের পরিমাণ ছিল বেশি।
পিডিবির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন, উপকেন্দ্র দুটিতে প্রতিষ্ঠার সময় যে ব্রেকারগুলো (সুইচ) লাগানো হয়েছিল, সেগুলোরও পরিবর্তন বা উন্নয়ন হয়নি। ফলে বেশির ভাগই ত্রুটিপূর্ণ হয়ে পড়ায় চলছে জোড়াতালি দিয়ে। ত্রুটিপূর্ণ ব্রেকারের কারণেও সরবরাহে বিঘ্ন ঘটছে।
শহরের বিতরণ ব্যবস্থাও বেহাল। পিডিবির নির্বাহী প্রকৌশলী আবু হেনা মোস্তফা কামাল বলেন, শহর ও শহরতলিতে সঞ্চালন লাইনে ২৭৬টি ট্রান্সফরমার রয়েছে। এগুলোর অধিকাংশই অনেক পুরোনো। শহরে বর্তমানে বিদ্যুতের গ্রাহকসংখ্যা ৪৩ হাজার। গ্রাহক যেভাবে বাড়ছে তাতে আরও অনেক ট্রান্সফরমার বসানো প্রয়োজন। কিন্তু তাঁর কাছে ১০টি ট্রান্সফরমার রিজার্ভ আছে। জরুরি প্রয়োজনে এগুলো ব্যবহার করা হয়।
পিডিবি সূত্র বলেছে, সঞ্চালন লাইনের পুরোনো ট্রান্সফরমারগুলো মাঝেমধ্যেই নষ্ট হয়। মেরামতের জন্য সেগুলো খুঁটি থেকে নামিয়ে গাজীপুরের কারখানায় পাঠাতে হয়। অভিযোগ আছে, খুঁটি থেকে বিকল ট্রান্সফরমার নামানো, মেরামতের জন্য গাজীপুরে পাঠানো, ফেরত আনা এবং আবার তা খুঁটিতে স্থাপন বাবদ সংশ্লিষ্ট এলাকার গ্রাহকদের মোটা অঙ্কের টাকা দিতে হয়। গত বছর সদরের বাঐতারা এলাকায় পুরোনো ট্রান্সফরমার নষ্ট হলে নতুন ট্রান্সফরমার বসানো হয়। ওই এলাকার বাসিন্দা আবদুল কাদের সরকার বলেন, এ জন্য এলাকার শিল্প ও আবাসিক গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা নেওয়া হয়েছে। ক্ষুদ্রশিল্প ব্যবসায়ী হাজি আবদুল বাতেন, আমিরুল ইসলাম, নূর নবী, নূরুল আমিনসহ আরও কয়েকজন গ্রাহক ট্রান্সফরমার বাবদ টাকা দেওয়ার কথা জানান। তাঁদের মতে, তাঁরা নিরুপায়। টাকা না দিলে ট্রান্সফরমার বসবে না। তাঁরা অভিযোগ করেন, শিল্পপ্রতিষ্ঠানে নতুন সংযোগ নিতে প্রতি কিলোওয়াটের জন্য অতিরিক্ত নূন্যতম পাঁচ হাজার টাকা করে দিতে হয়। ছোট একটি শিল্পে সাধারণত দৈনিক ৮-১০ কিলোওয়াটের বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়।
তবে জানতে চাইলে এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে দাবি করেন পিডিবির নির্বাহী প্রকৌশলী।
একদিকে ট্রান্সফরমারের সংখ্যা কম, অন্যদিকে দিনে দিনে বিদ্যুতের চাহিদা অনুসারে লোড বেশি হওয়ায় প্রায়ই ট্রান্সফরমারের ফিউজ কেটে যায়। গড়ে প্রতিদিন অন্তত ১০টির ফিউজ কাটে। এ সময় বন্ধ হয়ে যায় বিদ্যুতের সরবরাহ। তবে পিডিবিতে ফোন করলে লোক এসে ঠিক করে দেন। এ জন্য অবশ্য গ্রাহকদের টাকা গুণতে হয় না।
শহরের সঞ্চালন লাইনগুলো লোড পরিবহনের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। উপকেন্দ্র থেকে শহরের ভেতরে আসা ১১ কেভি সঞ্চালন লাইনের তারগুলো অনেক পুরোনো। এই পুরোনো তারগুলোরই অধিক হারে লোড পরিবহন করতে হচ্ছে। বিশেষ করে বাহিরগোলা উপকেন্দ্র থেকে ইলিয়াট সেতু পর্যন্ত তারের মান খুব খারাপ। প্রায়ই এই সঞ্চালন লাইনের তার ছিঁড়ে যায়।
নতুন বিদ্যুৎসংযোগ নেওয়ার ক্ষেত্রে নির্ধারিত টাকার চেয়ে বাড়তি নেওয়া, পিডিবি কার্যালয়ে দালালদের দৌরাত্ম্যসহ দালাল না ধরলে নতুন সংযোগ না পাওয়ার অভিযোগ শোনা গেল অনেক কাছ থেকেই।
পিডিবির নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, ‘শীতের সময় এখন লোডশেডিং হচ্ছে না। আমরা জাতীয় গ্রিড থেকে ৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাই। তবে উপকেন্দ্রের ট্রান্সফরমার পুরাতন বলে পুরোটা আমরা নিতে পারি না। তবে চাহিদা অনুসারে বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে।’ তিনি বলেন, উপকেন্দ্র দুটির ট্রান্সফরমারের তেল পরিশোধনের জন্য যন্ত্র আনা হয়েছে। পরিশোধনে দীর্ঘ সময় লাগে বলে গ্রীষ্মে করা যায়নি। এই শীত মৌসুমে তেল শোধনসহ অন্যান্য সংস্কারকাজের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, রাজশাহী বিভাগের বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়নে ৯০০ কোটি টাকারও বেশি একটি বড় প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। ওই প্রকল্পের আওতায় সিরাজগঞ্জের সঞ্চালন লাইনসহ অন্যান্য বিষয়েরও আধুনিকায়ন করা হবে। তিনি নতুন সংযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে বাড়তি অর্থ নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, পিডিবি অফিসে কোনো দালাল নেই।
সৌজন্যে: প্রথম আলো