বিনা-২৫ ধান: পরমাণু ব্যবহারে নতুন সাফল্য
রফিকুল বাসার:
বোরো মৌসুমে উচ্চফলনশীল সম্ভাবনাময় নতুন জাতের ধান উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা। প্রথমবারের ফলনেই সন্তষ্ট কৃষক-বিজ্ঞানী সকলে। এই ধানের চাল চিকন এবং পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ। অল্প সময়ে ফলন হয়। বিরূপ পরিবেশেও বেঁচে থাকতে পারে। এর অন্যতম বৈশিষ্ট হচ্ছে, উচ্চফলনশীল হলেও এটা হাইব্রিড নয়। এর বীজ কৃষক নিজেই সংরক্ষণ করতে পারবে।
এবার বোরো মৌসুমে সারাদেশের ২২টি জেলা এবং ৩৯৬টি উপজেলায় চাষাবাদ করা হয়েছে বিনা-২৫।
অল্পসময় আর উচ্চ ফলনশীল উন্নত গুণ সম্পন্ন বিনা-২৫ জাতের ধান । অল্প সময় আর বেশি ফলন হওয়ায় খুশি কৃষক।
অন্যান্য স্থানের সাথে মাগুরায় চাষ করা হয়েছে এই ধানের। সম্প্রতি সেখানের কয়েকজন কৃষক এনার্জি বাংলাকে বলেন, অন্য ধানের চেয়ে বেশি ফলন আর সময়ও কম। তাই দামও বেশি পাওয়া যাবে তাদের আশা। আগামী বছরও এই ধানই তারা করবেন বলে জানিয়েছেন।
বাংলাদেশের যে বিজ্ঞানীরা এই ধান আবিষ্কার করেছেন তাদের প্রধান ছিলেন কৃষিবিজ্ঞানী ড. সাকিনা খানম।
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউ এর (বিনা) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. সাকিনা খানম এনার্জি বাংলাকে বলেন, এখন কিছু ব্যবসায়ী মোটা চাল মেশিনের মাধ্যমে চিকন করে বিক্রি করছে। তাতে করে চালের যে পুষ্টিগুণ তা নষ্ট হচ্ছে। কিন্তু বিনা-২৫ এতই চিকন যে, এটা আর চিকন করার প্রয়োজন নেই ফলে এর পুরো পুষ্টিগুণই থাকবে। জলবায়ু সহিষ্ণু, অতিবৃষ্টি হলেও এই ধান গাছের কোন ক্ষতি হবে না। হাইব্রিড বা উচ্চ ফলনশীল হওয়ার পরও এই বীজ কৃষক নিজেই সংরক্ষণ করতে পারবে বলে তিনি জানান। বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তায় এই ধান অগ্রণী ভূমিকা রাখবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
ভাত সাদা, ঝরঝরে ও খেতে সুস্বাদু। সাথে চিকন। ফলে বাজারমূল্য বেশি এবং রপ্তানী উপযোগী।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব রবীন্দ্রশ্রী বড়ুয়া বললেন, আগামী বছর সারা দেশে এই ধানের বীজ বিনামূল্যে বিতরণ করা হবে।
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউ এর মহাপরিচালক মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম জানান এই চালে রেডিয়েশন দেওয়া হলেও তা স্বাস্থ্যে কোন বিরূপ প্রভাব পড়বে না। আইএইএ এর নির্দেশনা অনুযায়ী রেডিয়েশন দিয়ে এই ধান উদ্ভাবন করা হয়েছে। চাল হওয়ার সাথে সাথেই এই চাল খাওয়া যাবে। বরং এই চালে অন্যান্য চালের চেয়ে পুষ্টিগুণ বেশি বলে তিনি জানান।
পরিচয়
দেশে চাহিদা অনুসারে সরু ও চিকন চাল অপ্রতুল থাকায় এবং বিদেশে রফতানির উদ্দেশ্যে উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগ, বিনা গবেষণার মাধ্যমে বিনা ধান-২৫ উদ্ভাবন করে। বিনা ধান-২৫ বিদেশে রফতানিযোগ্য যা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে ভূমিকা রাখবে এবং আমদানি নির্ভরতা কমাবে।
উদ্ভাবনের ইতিহাস
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) ২০১৩ সালে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সহায়তায় জাপানের এটমিক এনার্জি এজেন্সি থেকে ব্রি ধান-২৯ এর বীজে কার্বন আয়ন রশ্মি প্রয়োগ করে কৌলিক বৈশিষ্ট্য এর স্থায়ী পরিবর্তনের মাধ্যমে মিউট্যান্ট সারি উদ্ভাবন করে।
২০২০-২১ সালে বাংলাদেশ জাতীয় বীজ বোর্ড লাইনটিকে জাত হিসেবে ছাড় দিতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মাঠে ফলন পরীক্ষা করে। পরীক্ষায় কৌলিক সারিটি চেক জাত থেকে উচ্চফলনশীল, অতি লম্বা ও সরু গুণসম্পন্ন ও আগাম পরিপক্ক হয় বলে প্রমাণিত হয়।
এরপর ২০২২ সালে বাণিজ্যিকভাবে কৃষক পর্যায়ে লবণাক্ত এলাকা ব্যতিত সারাদেশে চাষাবাদের জন্য বিনা ধান২৫ নামে অবমুক্ত করা হয়।
গুনাগুণ
উচ্চফলনশীল, স্বল্প মেয়াদী, আলোক অসংবেদনশীল ও উন্নত গুণাগুণ সম্পন্ন বোরো ধানের জাত। ডিগ পাতা চ্যাপ্টা ও ধান পরিপক্ক হওয়ার পরও গাঢ় সবুজ থাকে ফলে শীষের গোঁড়ার ধানও পুষ্ট হয়।
গাছ লম্বা কিন্তু শক্ত ফলে হেলে পড়ে না। পূর্ণ বয়স্ক গাছের উচ্চতা ১১৬ সেন্টি মিটার।
প্রতি গাছে ১৫-২০টি কুশি থাকে। ছড়ার দৈর্ঘ্য গড়ে ২৯ সেন্টি মিটার। প্রতি শীষে পুষ্ট দানার পরিমাণ ২৮০-২৯০টি।
জীবনকাল ১৩৮-১৪৮ দিন এবং গড়ে ১৪৫ দিন।
ধান উজ্জল রংঙের, চাল লম্বা এবং চিকন (এল বি অনুপাত ৪ঃ৭৫)। এক হাজারটি পুষ্ট ধানের ওজন গড়ে ১৯ দশমিক ৭০ গ্রাম।
ধানের দানায় অ্যামাইলোজের পরিমাণ শতকরা ২৫ দশমিক ১০ ভাগ এবং প্রোটিনের পরিমাণ শতকরা ৬দশমিক৬০ ভাগ। ভাত সাদা, ঝরঝরে ও খেতে সুস্বাদু ফলে বাজারমূল্য বেশি এবং রপ্তানী উপযোগী।
উপযুক্ত পরিচর্যায় বোরো মৌসুমে গড় ফলন হেক্টর প্রতি সাত দশমিক ৬৪ টন এবং সর্বোচ্চ ফলন সাড়ে আট টন।
অন্য বৈশিষ্ট্য
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত উদ্ভাবিত ধান জাতের মধ্যে বিনা ধান-২৫ সর্বাধিক লম্বা ও সরু। ধান এবং চাল অতি লম্বা ও চিকন হওয়ায় চিকন চালের আমদানি নির্ভরতা কমাবে।
জমিতে পানি জমে থাকলে এবং বৈরী আবহাওয়ায় প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টির কবলে পড়ে গাছ সময়িক হেলে পড়লেও জমি থেকে পানি সরে গেলে এ জাতটি ২/৩ দিনের মধ্যে আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসে। স্বাভাবিক ফলন দেয়। বিনা ধান২৫ এর জীবনকাল মাতৃজাত ব্রি ধান-২৯ এর চেয়ে ১৫-২০ দিন কম এবং ব্রি ধান ৫০ এর চেয়ে ১০-১২ দিন কম। জীবনকাল কম হওয়ায় বাংলাদেশের শস্য বিন্যাসে অন্তর্ভুক্ত করে সহজেই এক জমিতে বছরে ৩/৪ টি ফসল চাষ করা যাবে।