বিনিয়োগ-পরিকল্পনার অভাবে বাড়েনি রশিদপুর গ্যাসক্ষেত্রের উৎপাদন

আবু তাহের, বণিক বার্তা:

দেশে উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের মজুদ সাড়ে নয় হাজার বিলিয়ন ঘনফুটের (বিসিএফ) কিছু বেশি। এর মধ্যে সিলেটের হবিগঞ্জে আবিষ্কৃত রশিদপুর গ্যাসফিল্ডে রয়েছে ২ হাজার ৪৩৪ বিসিএফ, যা মজুদকৃত গ্যাসের ২৫ শতাংশ (এপ্রিল, ২০২৩ তথ্য অনুসারে)। বড় মজুদ থাকা সত্ত্বেও ক্ষেত্রটি থেকে গ্যাস উত্তোলন যৎসামান্য, দৈনিক ৪৬ মিলিয়ন ঘনফুট (এমসিএফ)। অথচ প্রায় একই মজুদের তিতাস গ্যাসফিল্ড থেকে দৈনিক ৩৮৪ এমসিএফ গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে। পর্যাপ্ত বিনিয়োগ ও যথাযথ পরিকল্পনার অভাবেই মূলত রশিদপুরে কাঙ্ক্ষিত গ্যাস উত্তোলন সম্ভব হচ্ছে না বলে মনে করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।

স্বাধীনতার পর পাঁচটি গ্যাসফিল্ড কিনে জাতীয়করণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ওই পাঁচ গ্যাসফিল্ডের একটি রশিদপুর। এখনো গ্যাস মজুদের বড় ভরসা রশিদপুর গ্যাসফিল্ডটি। বর্তমানে এর পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠান সিলেট গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড (এসজিএফসিএল)। বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন, দেশের অন্যান্য গ্যাসক্ষেত্রে বিনিয়োগ করে কূপ খনন ও কূপের ওয়ার্কওভার করে উৎপাদন বাড়ানো হয়েছে। অথচ রশিদপুরে তেমন কোনো উদ্যোগই নেয়া হয়নি। আর সে কারণেই বেশি গ্যাস মজুদ থাকার পরও দেশের পুরনো এ ক্ষেত্রটিতে উৎপাদন যৎসামান্য। নতুন কূপ খনন ও পুরনো কূপগুলো সংস্কার করা গেলে সেখান থেকে পর্যাপ্ত গ্যাস পাওয়া সম্ভব।

হাইড্রোকার্বন ইউনিটের তথ্য অনুসারে, রশিদপুর গ্যাসফিল্ডে ২ হাজার ৪৩৪ বিসিএফ গ্যাসের মজুদ রয়েছে। যদিও পরিচালনাধীন কোম্পানি এসজিএফসিএল বলছে, বর্তমানে এ গ্যাসফিল্ডে গ্যাস মজুদ রয়েছে ১ হাজার ৭০০ বিসিএফের মতো। পাঁচটি কূপের মাধ্যমে জাতীয় গ্রিডে দৈনিক ৪৬ গ্যাস যুক্ত হচ্ছে।

জ্বালানি খাতসংশ্লিষ্টরা যদিও বলছেন, রশিদপুরের মতো প্রায় সমান মজুদ (২ হাজার ২৮০ বিসিএফ) নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস গ্যাসফিল্ড আট গুণের বেশি সক্ষমতায় গ্যাস উত্তোলন করছে। এটি করতে পারছে কারণ গ্যাসফিল্ডটিতে প্রয়োজন অনুসারে বিনিয়োগ করা হয়েছে। খনন করা হয়েছে ২৬টি কূপ। সেগুলোয় আবার কম্প্রেসার বসিয়ে উৎপাদন ঠিক রাখা হয়েছে। সে কারণেই গ্যাসক্ষেত্রটি থেকে দৈনিক ৩৮৪ এমসিএফ গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরূল ইমাম  বলেন, ‘গ্যাসক্ষেত্রগুলো দীর্ঘসময় উৎপাদনে থাকলে তার সংস্কার প্রয়োজন। রশিদপুর প্রায় তিন দশক ধরে উৎপাদনে রয়েছে। এসব কূপে এক সময় গ্যাসের উৎপাদন কমে যাবে এটাই স্বাভাবিক। উৎপাদন বাড়াতে নতুন কূপ খননের প্রয়োজন। বিনিয়োগ প্রয়োজন। কিন্তু সেটা করা যায়নি। গ্যাসক্ষেত্রটি নিয়ে অনেকটা অবহেলা হয়েছে।’

রশিদপুরের উৎপাদন নিয়ে অবশ্য দ্বিমত পোষণ করেছেন গ্যাসফিল্ডে দীর্ঘ সময় কাজ করা এক বিশেষজ্ঞ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি জানান, ২০১০ ও ২০১২ সালের দিকে রশিদপুরে দুটি কূপ খনন করা হলেও তা শুকিয়ে যায়। তখনকার ওই কূপের তথ্য-উপাত্ত রিভিউ করার কথা ছিল। তবে নতুন কূপ খননে এক ধরনের অনীহা ছিল বলে জানান এ বিশেষজ্ঞ। এ অবস্থা যে শুধু রশিদপুরে এমনটি নয়, এসজিএফসিএলের আওতাধীন আরেক গ্যাসফিল্ড কৈলাসটিলা গ্যাসক্ষেত্রে দুই হাজার বিসিএফের বেশি গ্যাস মজুদ থাকলেও দৈনিক উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ২৫ এমসিএফ। তিনটি কূপ থেকে এ উৎপাদন আসছে।

জানা গেছে, কম মজুদ নিয়েও উৎপাদনের শীর্ষ অবস্থান ধরে রেখেছে দেশের অভ্যন্তরে কাজ করা বহুজাতিক তেল গ্যাস কোম্পানি (আইওসি)। মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি শেভরনের পরিচালনাধীন বিবিয়ানা গ্যাসফিল্ডের মজুদ রয়েছে ২২২ বিসিএফ (এপ্রিল, ২০২৩ পর্যন্ত)। বর্তমানে সেখান থেকে দৈনিক ১ হাজার ৮২ এমসিএফ (২০ সেপ্টেম্বরের তথ্য অনুযায়ী) গ্যাস উত্তোলন হচ্ছে।

এসজিএফসিএলের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রশিদপুর গ্যাসফিল্ডের কূপ উন্নয়নেও এসজিএফসিএল বড় পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এর অংশ হিসেবে গ্যাসফিল্ডে নতুন কূপ খননের পাশাপাশি পুরনো কয়েকটি কূপের ওয়ার্কওভারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৬ সালের পুরনো একটি কূপের জন্য রশিদপুরে পাইপলাইন বসানো হচ্ছে। বর্তমানে পাইপলাইনটির আর মাত্র পাঁচ-ছয় কিলোমিটারের কাজ বাকি। এ কাজ শেষ করতে আগামী নভেম্বর নাগাদ লেগে যেতে পারে বলে জানান এসজিএফসিএলের কর্মকর্তারা। এরপর চলতি বছরের ডিসেম্বর নাগাদ ওই কূপ থেকে জাতীয় গ্রিডে দৈনিক ১০ এমসিএফ হারে গ্যাস যুক্ত করা যাবে বলে জানিয়েছেন তারা।

এসজিএফসিএল সূত্র জানিয়েছে, রশিদপুর গ্যাসফিল্ডে ১১ ও ১৩ নম্বর নতুন দুটি কূপ খননের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে বিশেষ আইনের আওতায় গত সোমবার এ বিষয়ে জ্বালানি বিভাগের অনুমোদন পেয়েছে সংস্থাটি। এ দুটি কূপ থেকে দৈনিক ৩০ এমসিএফ যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া গ্যাসফিল্ডের ৩ ও ৭ নম্বর কূপে ওয়ার্কওভারের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এ দুই কূপের ওয়ার্কওভার শেষে জাতীয় গ্রিডে সেখান থেকে আরো ১০ এমসিএফ গ্যাস যুক্ত হবে। এছাড়া ২ ও ৫ নম্বর কূপের ওয়ার্কওভারের মাধ্যমে আরো ১৫-২০ এমসিএফ গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর লক্ষ্য।

পরিকল্পনা মতে, রশিদপুর গ্যাসফিল্ডের বিদ্যমান ৪৬ এমসিএফের পাশাপাশি ২০২৫ সালের মধ্যে আরো ৭০ মিলিয়ন যুক্ত করে দৈনিক উৎপাদন ১১৫-১২০ এমসিএফে উন্নীত করা। এ বিষয়ে এসজিএফসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মিজানুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রশিদপুর গ্যাসফিল্ডের উৎপাদন বাড়াতে বড় পরিসরে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। নতুন কূপ খনন, পুরনো কূপের ওয়ার্কওভার এবং বিশেষ গুরুত্বের কূপ খননও রয়েছে। বর্তমানে রশিদপুর গ্যাসফিল্ড থেকে দৈনিক ৪৬ এমসিএফ গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। আগামী ২০২৫ সাল নাগাদ গ্যাসফিল্ডের মোট দৈনিক উৎপাদন ১১৫ এমসিএফে উন্নীত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। সেই লক্ষ্যেই কাজ চলছে। এরই মধ্যে এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অনেকটাই এগিয়ে গেছে।’

দেশে এখন পর্যন্ত উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের মজুদ আবিষ্কার হয়েছে ২৮ হাজার ৬২০ বিসিএফ। সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, এখন অবশিষ্ট আছে সাড়ে ৯ হাজার বিসিএফের কিছু বেশি। যদিও সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মজুদ থাকা এ গ্যাসের মধ্যে প্রায় ৬০০ বিসিএফ এরই মধ্যে উত্তোলন করা হয়েছে। সেই হিসাব বিবেচনায় নিলেও বর্তমানে দেশে গ্যাস মজুদের পরিমাণ নয় হাজার বিসিএফের কম নয়।