বিবিয়ানার একক নির্ভরতায় ঝুঁকিতে জ্বালানিখাত

রফিকুল বাসার:
বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রের উপর একক নির্ভরতা বাংলাদেশের জ্বালানি খাতকে ঝুঁকির মধ্যে রেখেছে। একক নির্ভরতা কারিগরি ও ব্যবস্থাপনা দুদিক দিয়েই ঝুঁকি তৈরি করছে। বেশি চাপে গ্যাস তুললে সব গ্যাস তোলার আগেই বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি আছে। আর তাতে হঠাৎ যে সংকট তৈরি হবে তা মেটানোর উপায় থাকবে না।
কারিগরি ঝুঁকি ইতিমধ্যে দেখা দিয়েছে। গ্যাস কূপ দিয়ে বালি ওঠা মানে বড় ঝুঁকির লক্ষণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আর ব্যবস্থাপনার বা বিকল্প না থাকার ঝুঁকি দেশের সংকট দেখলেই বোঝা যাচ্ছে।
দেশে মোট সরবরাহ করা গ্যাসের প্রায় ৪৪ ভাগই আসে বিবিয়ানা থেকে। কোন কারণে দেশের সবচেয়ে বড় এই গ্যাসক্ষেত্র হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেলে বাংলাদেশ জ্বালানির বড় ঝুঁকিতে পড়বে। বাংলাদেশে মোট গ্যাস উত্তোলন করা হয় গড়ে দৈনিক ২৭০ কোটি ঘনফুট। এরমধ্যে ১২০ কোটিই বিবিয়ানার উপর নির্ভর।
কদিন আগে বিবিয়ানার মোট উৎপাদন ক্ষমতার তিনভাগের একভাগ, অর্থাৎ ১২০ কোটি ঘনফুটের মধ্যে ৪০ কোটি ঘনফুট বন্ধ হওয়ায় দেশজুড়ে তীব্র গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে। আর তা এখনও চলছে। কোন কারণে বিবিয়ানায় যদি অর্ধেক উৎপাদন কমে বা তারও বেশি উৎপাদন কমে তবে অবস্থা কী হবে তা এখনই অনুমেয়। এজন্য বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রের উপর একক নির্ভরতা সবসময় ঝুঁকিতে রাখবে।
অতীতে মেরামতের জন্য যতদিন বিবিয়ানা বন্ধ করা হয়েছে, ততদিনই প্রকট গ্যাস সংকট নিয়ে চলতে হয়েছে। এখনও তার বিকল্প তৈরি হয়নি।
বিবিয়ানার বিকল্প কিছু এখনও পর্যন্ত নেই। বিকল্প নেই তা নয়, তৈরি করা হয়নি। একাধিক স্থান আছে যেখান থেকে অল্প বিনিয়োগ করেই উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব, কিন্তু তা করা হয় না। তাই বিবিয়ানার উপর নির্ভরতা দিন দিন বাড়ছেই। জরুরিভিত্তিতে বিবিয়ানার উপর একক নির্বরতা কমানো উচিৎ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
সম্প্রতি এই গ্যাসক্ষেত্রের উৎপাদন আরও বাড়ানো হয়েছে। এতে এর উপর নির্ভরতা আরও বেড়েছে। বিবিয়ানা থেকে গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য বিনিয়োগ ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। দেশের চাহিদা মেটাতে বেশি উৎপাদনের জন্য এই বিনিয়োগ। বিবিয়ানা থেকে কয়েক মাস আগেও গড়ে প্রতিদিন ১১৯ কোটি থেকে ১২০ কোটি ঘনফুট গ্যাস তোলা হত। পরে উৎপাদন ক্ষমতা বাড়িয়ে ১২৭ কোটি ৫০ লাখ ঘনফুট পর্যন্ত তোলা হয়েছে। অথচ এই ক্ষেত্রের উৎপাদন ক্ষমতা দৈনিক ১২০ কোটি ঘনফুট। আগে ৪০ ভাগ গ্যাস আসলেও এখন প্রায় ৪৪ ভাগ গ্যাস আসছে বিবিয়ানা থেকে। এই বেশি উৎপাদন শুরুর মাত্র দুই সপ্তাহের মাথায় দুটো গ্যাস কূপ দিয়ে বালি ওঠা শুরু হল। দুর্ঘটনা ঘটল। এতে ছটি কূপ থেকে উৎপাদন বন্ধ করে দিতে হয়। পরে পর্যায়ক্রমে কূপগুলো থেকে গ্যাস তোলা শুরু হয়েছে। তবে বালি ওঠা কূপ এখনও অনিশ্চয়তায়।
এরআগে বাখরাবাদ গ্যাসক্ষেত্রের এক কূপ থেকে বেশি গ্যাস তোলার কারণে বালি উঠেছিল। সেই কূপ স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায়। একই কারণে সমুদ্রের একমাত্র গ্যাস ক্ষেত্র সাঙ্গুও ২০১৩ সালে বন্ধ হয়ে যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাস কূপ দিয়ে বালি ওঠা মানে বিপদজনক পরিস্থিতি। বালি উঠা কূপ কবে নাগাদ ঠিক হবে তা অনিশ্চিত। কূপ দিয়ে বালি ওঠা মানে গ্যাস উঠার সম্ভাবনা কম।
২০০৭ সালে বিবিয়ানা ক্ষেত্র থেকে গ্যাস তোলা শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি শেভরন। এখানে ১ হাজার ২২৬ দশমিক ৭০ বিসিএফ গ্যাস মজুদ ছিল।
অতীতের যতদিন রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিবিয়ানা বন্ধ রাখা হয়েছে ততদিনই পুরো দেশে গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে। বিকল্প কিছু না থাকায় গ্যাস-সংকট মেনে নিয়েই চলতে হয়েছে দেশবাসীকে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. ম তামিম এনার্জি বাংলাকে বলেন, যে কোন একটি গ্যাসক্ষেত্রর উপর নির্ভরতা অবশ্যই ঝুঁকির। বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রের উপর নির্ভরতা সবসময় ঝুঁকিতে রাখছে। এর বিকল্প খুব জরুরি। যে কোন সময় বড় ধরণের বিপর্যয় আসতে পারে। এই ঝুঁকি নিয়ে চলা উচিৎ নয়। দেশীয় ক্ষেত্রগুলোতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। অনুসন্ধান বাড়াতে হবে। অনুসন্ধান বাড়িয়ে নতুন নতুন গ্যাস আবিস্কার করতে হবে। তাহলে এই নির্ভরতা কমবে। এখনই দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র গুলোকে থেকে উত্তোলন বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক বদরূল ইমাম এনার্জি বাংলাকে বলেন, বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ বিশেষ গ্যাস অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত। অথচ সেই অনুযায়ি এখানে অনুসন্ধান হয়নি। গত ২০ বছরে মাত্র ২৬টি কূপ অনুসন্ধান করা হয়েছে। যা খুবই অপ্রতুল। বাংলাদেশের তিনভাগের এক ভাগ এলাকাতে এখনও অনুসন্ধান হয়নি। তাই একক নির্ভরতা বেড়েছে। এই নির্ভরতা কমিয়ে আনা উচিৎ।
গত বছর থেকে এলএনজি আমদানি শুরু হয়েছে। কিন্তু এলএনজি এখনই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিচারে দেশীয় গ্যাসের বিকল্প নয়। কারণ বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রের দামের অন্তত ২৫ গুণ দাম দিতে হচ্ছে এলএনজির। তাই এখন বিবিয়ানার বিকল্প এলএনজি ভাবা টাও ঝুঁকির, মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিবিয়ানার বিকল্প কোন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান এনার্জি বাংলাকে বলেন, দেশীয় ক্ষেত্রগুলো থেকে উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অনেককূপের মেরামতের কাজ চলছে। চলমান কাজ শেষ হলে গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতি ভাল হবে। উল্লেখযোগ্য পরিমান গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে।