বিশ্ববাজারে কমতে শুরু করলে দেশেও জ্বালানির তেলের দাম কমানো হবে: প্রতিমন্ত্রী
বিডিনিউজ:
আগামী মাসের শেষ থেকেই লোড শেডিং আর থাকবে না বলে আশার কথা শুনিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।
আর বিশ্ববাজারে কমতে শুরু করলে বাংলাদেশেও জ্বালানির তেলের দাম কমানো হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
রোববার জ্বালানি নিরাপত্তা বিষয়ক এক সেমিনারে নতুন নির্মিত কয়লাভিত্তিক বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে উৎপাদন শুরু হলে বিদ্যুৎ সঙ্কট কেটে যাবে বলে তিনি জানান।
তিনি বলেন, “আমি আশাবাদী আগামী মাসের শেষ থেকে আমরা পুরোপুরি এই লোড শেডিং থেকে বেরিয়ে আসতে পারব। বিশ্ব পরিস্থিতি এর থেকে খারাপ না হলে আমরা ভালোর দিকে যাব বলে আশাবাদী।”
আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে অর্থনৈতিক সঙ্কট এড়াতে সাম্প্রতিক সময়ে ডলার সাশ্রয়ে বিদ্যুৎ ও তেলের খরচ কমানোসহ একগুচ্ছ সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
সঙ্কটের মধ্যে ডলার ধরে রাখতে উচ্চ মূল্যের জ্বালানি আমদানি কমিয়ে দেওয়ায় দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনও কমিয়ে ফেলা হয়।
জুলাইয়ের শুরুতে স্পট মার্কেটের এলএনজি আমদানি বন্ধ করার পর গ্যাসের অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটায় হারিয়ে যাওয়া আবার লোড শেডিং ফিরতে শুরু করে। পরে ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তের পর দৈনন্দিন সূচি তৈরি করে দেশব্যাপী লোড শেডিং করা শুরু হয়।
রোববার বাংলাদেশ ফোরাম ফর এনার্জি রিপোর্টার্স বাংলাদেশ (এফইআরবি) আয়োজিত ‘অস্থিতিশীল বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা’ শীর্ষক সেমিনারে প্রতিমন্ত্রী বলেন, “আমরা বিশ্ব পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। মূল্য সমন্বয় খুব বেশি দিন হয় নাই। আমি সকলকে বলব অন্তত এক দুইটা মাস আপনারা ধৈর্য ধরেন।
“আমরা আশাবাদী তেলের মূল্য যদি কমতে শুরু করে তাহলে একটা ভালো সমন্বয় করে নিচে নিয়ে আসতে পারব। এটা আমি আশাবাদী।”
সঙ্কটের মধ্যে সম্প্রতি জ্বালানি তেলের দাম এক ধাপে ৪২ থেকে ৫২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর পর সমালোচনায় পড়েছে সরকার।
বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমা মাত্রই বাংলাদেশে সমন্বয় করা হবে বলে রোববার জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সেমিনারে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীও দাম সমন্বয়ের কথা তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, “যদি তেলের দাম কমতে থাকে তাহলে অবশ্যই সমন্বয় করব। কে চায় এটা বৃদ্ধি করে জনজীবন অতিষ্ঠ করতে, কেউ চায় না।
“এটা জনবান্ধব শেখ হাসিনা সরকার। এটা লুটপাট করা বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার না।”
অনুষ্ঠানে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নীতির সমালোচনাও করেন প্রতিমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “বিএনপি কিছুই করেনি। কারণ তাদের মাথায় ছিল দুর্নীতি। যখন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসলো কী ভয়বহ চিত্র হয়েছিল এই বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ক্ষেত্রে। ১৬ থেকে ১৭ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকত না। তখন এই দেশে বিদেশি বিনিয়োগ স্থবির হয়ে গিয়েছিল।
“বাংলাদেশ যে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হতে পারে সেই চিন্তাভাবনা তাদের মধ্যে ছিল না। না থাকার কারণে বিএনপি জামায়াত জোট সরকারের সময় বাংলাদেশ একটা বিষয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল, দুর্নীতির বিষয়ে।“
আলোচিত নাইকো দুর্নীতি মামলায় সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রীর খালেদা জিয়ার আসামি হওয়ার কথাও উল্লেখ করেন তিনি।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, “যখন আমরা শুনতে পাই এই দলের কাছ থেকে, ভবিষ্যতে ক্ষমতায় আসলে উনারা বিদ্যুৎ, জ্বালানিতে কী করবেন, সেটা সত্যিই অদ্ভূত লাগে আমার কাছে।”
তিনি বলেন, “আজকের পরিস্থিতি যেটা এসেছে এটা বিশ্ব পরিস্থিতির বাইরে না। আমরা খুবই ভালো ছিলাম। বিদ্যুৎ বিভাগ শতভাগ বিদ্যুতায়ন করেছে।“
নতুন নির্মিত কয়লাভিত্তিক বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো উৎপাদনে আসছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “একটার পর একটা বেইসলোড এখন আসছে। এখন আপনারা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পাবেন। এই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র না করার জন্য বিরাটভাবে অনেক উপদেষ্টারা পিছে লেগেছিলেন।
“যুক্তরাজ্য বাদ দেওয়া কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রস্তুত রাখছে। জার্মান ইতোমধ্যে তাদের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালু করেছে। কোথায় গেল পরিবেশবাদীরা এবার বলেন। এখন জার্মানিতে কোন পরিবেশবাদী, কেউ বাধা দেয় না।”
দেশের সাম্প্রতিক বিদ্যুৎ ও জ্বালানির পরিস্থিতি তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমাদের চিন্তা করতে হবে বিশ্বের পরিস্থিতি ভালো না। আমি বারবার বলে আসছি এটা খুব সাময়িক। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে এটা খুবই সাময়িক।“
নতুন বিডিং রাউন্ড হচ্ছে এ বছরেই
সমুদ্রে তেল গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য এ বছরের শেষ দিকেই ‘বিডিং রাউন্ড’ হবে বলে সেমিনারে জানান পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান।
তিনি বলেন, ভূমিতে বিভিন্ন অনুসন্ধান চলছে। পাশাপাশি অফশোরে পিএসসির যে মোডিফিকেশন সেটি আমরা হাতে নিয়েছিলাম। ইতোমধ্যেই আমরা সেটি চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে এসেছি।
“আমরা আশা করছি খুব স্বল্প সময়ের মধ্যেই আমরা রিপোর্ট পাব। রিপোর্টের ভিত্তিতে এটিকে আমরা আপডেট করে এই বছরের শেষের দিকেই আমরা চেষ্টা করব বিডিং রাউন্ডে যাওয়ার জন্য।”
সেমিনারে ভূতত্ববিদ অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, বাংলাদেশ সবসময়ই নিজস্ব জ্বালানির অবহেলা করেছে।
“যৌক্তিকভাবে আমরা যদি বলি, বাংলাদেশে যে গ্যাস আছে তা উত্তোলন করতে পারলে গ্যাসের সংকট থাকবে না।”
সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানে বাংলাদেশ সর্বশেষ বিডিং রাউড করেছিল ২০১২ সালে। অগভীর সমুদ্রের ১১ নম্বর ব্লকে একাধিক বহুজাতিক কোম্পানির জরিপে গ্যাসের সন্ধানের কথা জানা গেলেও পরে মূল্য নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় উত্তোলন করা যায়নি।
আর গভীর সমুদ্রের অনুসন্ধান একেবারেই হয়নি বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
এসময়ে ২০০৯ থেকে ২০২২ অর্থনীতির বিশাল একটা পরিবর্তন এসেছে। কারখানা বেড়েছে। তৈরি পোশাক খাতে বড় বড় বিনিয়োগ হয়েছে। এতে গ্যাস ও বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে।
২০০৯ সালে দেশে গ্যাসের উৎপাদন ছিল দৈনিক ১৭০০ থেকে মিলিয়ন ঘনফুট। এরপর নানা প্রচেষ্টার মাধ্যমে দৈনিক উৎপাদন ২৭০০ মিলিয়ন ঘনফুটে পৌঁছায়। এরপর আবার কমতে শুরু করে এখন ২৩০০ মিলিয়নের মত উৎপাদন হচ্ছে।
এদিকে চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ঘাটতি তৈরি হওয়ায় দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে দৈনিক ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস এলএনজি আমদানি শুরু করা হয়। এরসঙ্গে আরও ২৫০ থেকে ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুটের মত এলএনজি স্পট মার্কেট থেকেও আমদানি করা হচ্ছিল। কিন্তু দাম বেড়ে যাওয়ায় ১ জুলাই থেকে স্পট মার্কেটের এলএনজি আমদানি বন্ধ রয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী বলেন, “আমরা সাগরে তিনটি কোম্পানিকে কাজ দিয়েছিলাম। মিয়ানমার বর্ডারে যারা কাজ করেছে। বলল, এত টিসিএফ গ্যাস আছে। কিন্তু ফিজিবল না। তাহলে তো কিছুর করার থাকে না। গ্যাসের দামও বাড়িয়ে দেব, তারপরও তারা থাকলেন না।
“মিয়ানমারে তারা খুব সস্তায় গ্যাস পেয়েছে। মিয়ারমার যে দামে গ্যাস বিক্রি করে দিয়েছে তাদের নিজস্ব সম্পদ, আমরা তো সেটা পারি না।”
চেষ্টার কোনও ‘কমতি’ হয়নি বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ‘এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ার’ সাময়িকীর সম্পাদক মোল্লাহ এম আমজাদ হোসেন।
এফইআরবির চেয়ারম্যান মো. শামীম জাহাঙ্গীর এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. মাহবুব হোসেন, ক্যাবের উপদেষ্টা শামসুল আলম বক্তব্য দেন।
সেমিনার সঞ্চালনা করেন এফইআরবির নির্বাহী পরিচালক রিশান নসরুল্লাহ।