বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন: প্রযুক্তি বিনিময় ও অর্থ সহায়তা নিয়ে দরকষাকষি

আলীম আল রাজী, সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই থেকে  ফিরে:

বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের (কপ২৮) নানা ফোরামে আলোচনা ও দরকষাকষি চলছে প্রযুক্তি বিনিময় ও অর্থ সহায়তা নিয়ে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় উন্নত দেশগুলোর মধ্যে সেতু বন্ধন এবং লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ।
নেট-জিরো লক্ষ্য পুরণে ২০৫০ সালের মধ্যে নিউক্লিয়ার এনার্জি তিনগুণ করার আহ্বান জানিয়ে চুক্তিতে সই করেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ২২টি দেশ। সেই ধারাবাহিকতায় এবার নিউক্লিয়ার এনার্জির পরিবর্তে নবায়নযোগ্য জ্বালানি তিনগুন করার কথা বলেছে অস্ট্রেলিয়াসহ ১শ’১৫টি দেশ।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবেলায় এবারের সম্মেলনে ঘোষণা আসলেও দূষণ বন্ধে কার্যকরী উদ্যোগ না নেওয়ায় উদ্বেগ জানিয়েছে ১শ’২০টি দেশ। জীবাশ্ম জ্বালানি নিষিদ্ধ করাসহ কার্যকর উদ্যোগের দাবিতে সম্মেলন চত্ত্বরে প্রতিবাদ করেছেন পরিবেশকর্মী ও চিকিৎসকরা।
সম্মেলনের সম্ভাব্য চূড়ান্ত চুক্তির একটি খসড়া প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। চুক্তিতে দেশগুলো শেষ পর্যন্ত জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদন বন্ধ করতে সম্মত হবে, নাকি এ বিষয়ে একটি পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য লড়াই চালিয়ে যাবে, সে বিষয়ে আলোচনা চলছে।
ইউনিসেফের তথ্যমতে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে বাংলাদেশ।
রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের দুই দিনের আলোচনা শেষে সম্মেলনে সাইড ইভেন্টে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের আলোচনা চলছে।
বিবেচনায় খাদ্য ও কৃষি
বিশ্বে প্রায় এক তৃতীয়াংশ উষ্ণায়নের জন্য দায়ী খাদ্য ব্যবস্থাপনা। খাদ্য ও কৃষি খাতে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ হয় ১ হাজার ৮শ’ কোটি টন আবার জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের খাদ্য উৎপাদনের এক-তৃতীয়াংশই ঝুঁকির মুখে আছে। সম্মেলনে ১৩৪টি দেশের নেতারা প্রথম এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে ঘোষণাপত্র সই করেছেন। নিজেদের জাতীয় পরিকল্পনায় খাদ্য ও কৃষি খাতকে বিবেচনায় নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং ব্রাজিলসহ বড় বড় কয়েকটি দেশ বিশ্বে খাবারের ৭০ শতাংশ উৎপাদন করে। দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তন রোধের লড়াইয়ে জাতীয় পরিকল্পনায় খাদ্য ও কৃষিকে বিবেচনায় নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
জীবাশ্ম জ্বালানি কমানো
২০৩০ সালের মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানি ৪৩ শতাংশে নামিয়ে আনতে বিজ্ঞানসম্মত সমাধানে গুরুত্বারোপ করেছেন জলবায়ু সম্মেলনের প্রেসিডেন্ট সুলতান আহমেদ আলÑজাবের। তিনি বলেন, তার দেশ বিজ্ঞানকে সম্মান করে এবং বিজ্ঞানসম্মত সমাধানে একমত। বৈশ্বিক তাপমাত্রার বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখতে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার পর্যায়ক্রমে বন্ধ করার ওপর জোর দেন তিনি।
প্রতিশ্রুতি
বনভূমি ও মহাসাগর সংরক্ষণে ২ দশমিক ৪ বিলিয়নেরও বেশি অর্থ সহায়তার ঘোষণা এসেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোতে কৃষকদের জীবন ও জীবিকা রক্ষা এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সই করেছে ১৩৪টি দেশ। স্বাস্থ্য নিরাপত্তা চুক্তিতে সই করেছে ১২৩টি দেশ। এছাড়া এ খাতে ২ দশমিক ৫ বিলিয়নের বেশি অর্থ সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন।
পরমাণু নয়, বরং ২০৩০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি তিনগুণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। এতে সমর্থন জানিয়েছে ১শ’১৫টি দেশ।
বাস্তুচ্যুত
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের প্রায় এ কোটি ৩০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারে বলে সতর্ক করেছে বিশ্বব্যাংক। এ অবস্থায় অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের মানসিক স্বাস্থ্যের সম্ভাব্য অবনতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, আবহাওয়া এবং জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে হুমকিতে পড়তে পারে পুরো সভ্যতা।
নারীর ক্ষমতায়ন
চলতি শতাব্দীর মাঝামাঝিতে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বে আরও ১৫ কোটি ৮০ লাখ নারী দরিদ্র হতে পারে বলে শঙ্কা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাই এবিষয়ে বিশেষ তাগিদের দাবি উঠেছে।
স্বাস্থ্যসেবা
জনস্বাস্থ্যের জন্য সৃষ্ট হুমকি মোকাবিলায় করণীয় ঠিক করতে সম্মেলনে গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। এরই মধ্যে ১২৩টি দেশ স্বাস্থ্য নিরাপত্তা চুক্তিতে সই করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে যে সমস্যাটি আগামী দিনে বিশ্বের সবচেয়ে চিন্তার তাহলো স্বাস্থ্য। বিশেষ করে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা। সচেতনতা বৃদ্ধি, দীর্ঘমেয়াদী মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, অর্থনৈতিক সহায়তা, গবেষণা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় সমস্যা মোকাবিলায় সবাইকে এক হয়ে কাজ করার আহ্বান জানান বিশেষজ্ঞরা।
বিক্ষোভ
জীবাশ্ম জ্বালানি নিষিদ্ধ করাসহ কার্যকর উদ্যোগের দাবিতে সম্মেলন চত্ত্বরে প্রতিদিনই বিক্ষোভ করছে পরিবেশকর্মীরা। নানা সাজে সেজে এই প্রতিবাদে অংশ নিচ্ছেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পরিবেশকর্মীরা।
বাংলাদেশ প্যাভিলিয়ন
জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে পরিবেশবান্ধব নানা প্রযুক্তি তুলে ধরা হয়েছে। গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে নেচার বেইজড সলিউশনে। জলবায়ু অভিঘাত মোকাবিলায় বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে প্রদর্শন হচ্ছে নানা বিষয়। বাংলাদেশসহ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিপর্যয়ের হুমকিতে থাকা দেশগুলোর চিত্র ও কার্যকর সমাধানের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন সংগঠন।
অন্য সব কপ সম্মেলনের মতোই এবারো জড়ো হচ্ছেন পরিবেশবাদিরা। ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য জলবায়ু সুরক্ষা ও অর্থ সহায়তার জন্য প্রতিবাদ করছেন তারা। জীবাশ্ম জ্বালানি নিষিদ্ধ করাসহ কার্যকর উদ্যোগের দাবিও জানানো হয়েছে। কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে ধীর গতির কারণে বিশ্বনেতাদের উপর আস্থা রাখতে পারছেন না তারা।
জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী বৈশ্বিক তাপমাত্রা কমানো, কার্বন নির্গমনসহ, জীবাশ্ব জ্বালানির ব্যবহার কমাতে দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়ার ওপর জোর দিয়েছেন আলোচনায় অংশ নেওয়া বিশ্ব নেতারা।
সম্মেলন নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করে আগামী প্রজস্মের জন্য সুন্দর বাসযোগ্য বিশ্ব গড়ে তুলতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশের পরিবেশবিদরা।
বিশ^ জলবায়ু সম্মেলনের বিভিন্ন পর্যায়ের আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন প্রায় দুইশ’টি দেশের মন্ত্রী ও প্রতিনিধিরা। কার্বণ নির্গমন কমানোর লক্ষ্যমাত্রায় ধনী দেশগুলোকে বাধ্য করা এবং অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে অনড় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলো।