বিশ্ব বাজারে তেলের দাম কমলেও বিপিসি নীরব

আন্তর্জাতিক বাজারে দফায় দফায় জ্বালানি তেলের দাম কমলেও দেশের বাজারে এর কোন প্রভাব পড়ছে না। গত ফেব্রুয়ারি থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমতে শুরু করে। বিগত কয়েক বছরের মধ্যে এখন জ্বালানি তেলের মূল্য সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত কয়েক দফায় জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করলেও দেশে এখনই এ ধরনের কোন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। জ্বালানি বিভাগ বলছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন বিপিসির লোকসান পুষিয়ে নিতে জ্বালানি তেলের মূল্য কমানোর কোন পরিকল্পনা নেই। যদিও সরকারের ওপর বিষয়টি নির্ভর করছে বলে জানিয়েছে বিপিসি।
জানতে চাইলে বিপিসি চেয়ারম্যান ইউনুসুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, এখন বিপিসি আর লোকসান করছে না। আমরা সকল ধরনের জ্বালানি তেল বিক্রিতে লাভ করছি। এখন ডিজেলে লিটার প্রতি এক থেকে দেড় টাকা করে লাভ হচ্ছে। এছাড়া অন্যান্য জ্বালানি তেল বিক্রিতে বিপিসি আগেই লাভ করত। তবে যেহেতু বিপিসির বিক্রিত জ্বালানির মধ্যে ৭০ ভাগই ডিজেল তাই অন্য জ্বালানি তেল বিক্রিতে লাভ করলেও বিপিসির তেমন একটা লাভ হতো না। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করতে বিপিসি জ্বালানি তেলের দাম কমানোর কোন প্রস্তাব করবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিপিসির পুঞ্জিভূত লোকসানের পরিমাণ অনেক বেশি। এই লোকসান কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। এরপরও সরকার চাইলে আমরা আপত্তি করব না। বিষয়টি পুরোপুরি সরকারের ওপর নির্ভর করছে বলে মনে করেন বিপিসি চেয়ারম্যান।
অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই ইলাহী চৌধুরী সম্প্রতি বলেন, বিপিসি এমনিতে লোকসানে রয়েছে। এর আগের বছরগুলোতে জ্বালানি বিক্রিতে ভর্তুকি দেয়া হয়েছে। এখন বিপিসির লোকসান কমিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে।
সর্বশেষ দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির সময় সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছিল বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় অভ্যন্তরীণ বাজারে দাম বৃদ্ধি ছাড়া কোন উপায় নেই। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম ওঠা-নামার সঙ্গে দেশের বাজারেও তা করার ইঙ্গিত দেয়া হয়। কিন্তু এখন সেই প্রতিশ্রুতি আর রক্ষা করা হচ্ছে না। গত অর্থবছর বিপিসির ঘাটতি ছিল দুই হাজার ৪৭৮ কোটি টাকা। একই সময়ে সরকারকে প্রতিষ্ঠানটি রাজস্ব আয় করে দিয়েছে চার হাজার ৫২৫ কোটি টাকা। কিন্তু এই কেনা-বেচায় প্রকৃতপক্ষে দুই হাজার ৪৭ কোটি টাকা রাষ্ট্রের মুনাফা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক বাজার বিশ্লেষণ করে বলা হচ্ছে অর্গানাইজেশন অব দ্যা পেট্রোলিয়াম এক্সপোট্রিং কান্ট্রিজ (ওপেক) সদস্য দেশগুলোর জ্বালানি তেলের উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি আমেরিকার শেল অয়েলের পর্যাপ্ত যোগানের ফলে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের দাম ব্যাপকভাবে পড়ে যায়। গত ফেব্রুয়ারিতে যেখানে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ছিল ১১১ ডলার নবেম্বরের মাঝামাঝিতে ছিল ৬৮ দশমিক ২৪ ডলারে। এখন তা আরও কমে ৬৫ দশমিক ৫২ ডলারে দাঁড়িয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম কমে যাওয়ার আরও একটি বড় কারণ হচ্ছে এশিয়া এবং ইউরোপের দেশগুলোর জ্বালানি তেলের চাহিদা ব্যাপকভাবে কমে যাওয়া। এ অবস্থায় ওপেক দেশগুলো জ্বালানি তেলের উৎপাদন অন্তত ৫০ ভাগ না কমালে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ৬০ ডলারে নেমে আসতে পারে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমতে থাকায় তেলে লগ্নিকারীরা শঙ্কিত হয়ে তেল বিক্রি করতে থাকলে তেলের দাম আরও কমে যায়। অন্যদিকে ওপেক দেশগুলোতে জ্বালানি তেলের দাম ক্রমাগত কমতে থাকায় অভ্যন্তরীণ দেশগুলোর বাজেট পেশ করতে জটিলতায় পড়তে হচ্ছে। এজন্য সদস্য দেশগুলো মিলে জ্বালানি তেলের উৎপাদন কমানোর আলোচনা হলেও ওপেক এখনও মানতে নারাজ। বলা হচ্ছে জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ৮৫ ডলারে উন্নীত করতে হলে দৈনিক উৎপাদন ১০ লাখ ব্যারেল কমাতে হবে।
কিন্তু মূল তেল উৎপাদনকারী দেশ সৌদি আরব ওপেকের এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত নয় তারা ক্রমাগতভাবে তেলের উৎপাদন বাড়িয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে শেল অয়েলের উৎপাদন এখন থেকে দৈনিক এক দশমিক ৬ লাখ ব্যারেলে পৌঁছেছে। সৌদি আরবের মতো আমেরিকাও তেলের উৎপাদন বাড়িয়েই চলেছে। সৌদি আরব এবং কুয়েতের সঙ্গে গলা মিলিয়ে ইরানও বলছে তেলের দাম কমলে তাদের কিছু যায় আসে না। সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তেল নিয়ে এখন আন্তর্জাতিক জ্বালানি রাজনীতি শুরু হয়েছে। সম্প্রতি পত্রিকাটি এক প্রতিবেদনে সন্দেহ প্রকাশ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সৌদি আরব যেভাবে তেলের যোগান বাড়িয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ফেলে দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন দ্রুততর করেছিল এবারও রাশিয়া এবং ইরানকে বাগে আনতে এই কৌশল নেয়া হয়ে থাকতে পারে।
জ্বালানির আন্তর্জাতিক রাজনীতি যাই হোক না কেন তেলের দাম কমায় আমদানিকারক দেশগুলো এর সুফল পাচ্ছে। প্রতিবেশী দেশ ভারত গত আগস্ট থেকে পেট্রোলের দাম ৭ বার আর ডিজেলের দাম কমিয়েছে তিনবার। নবেম্বরের শুরুতেই পেট্রোলের দাম কমেছে ২ দশমিক ৪১ রূপী আর ডিজেলের দাম কমেছে দুই দশমিক ২৩ রূপী। আগস্ট থেকে ভারতের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমেছে গড়ে ৯ দশমিক ৩৬ রূপী।
জ্বালানি তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে নিম্নমুখী হলেও এখন দেশের বাজারে তো তেলের দাম কমানো হচ্ছেই না উল্টো বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এখন দেশে তরল জ্বালানি ভিত্তিক বিদ্যুত ছাড়া অন্য উৎপাদনে কোন লোকসান নেই। যেখানে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমছে সেখানে দেশে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কোন কোন বিদ্যুত কেন্দ্র সরাসরি জ্বালানি আমদানি করছে। এর ফলে বিপিসির দামের সঙ্গে তাদের দামের একটি পার্থক্যও রয়েছে।
বর্তমানে দেশে ডিজেল এবং কেরোসিন ৬৮, পেট্রল ৯৬ ও অকটেন ৯৯ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অন্যান্য ব্যয়সহ বর্তমানে বিশ্ববাজার থেকে প্রতি লিটার ডিজেল কিনতে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) ব্যয় হয় ৬৫ টাকা। আর বাজারে বিক্রি হয় ৬৮ টাকায়। কিন্তু প্রতি লিটারে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে ৭-৮ টাকা শুল্ক দিতে হয়। আর তাতেই ডিজেলে লোকসানে পড়ে বিপিসি। বর্তমানে প্রতি লিটার ফার্নেস অয়েল বিক্রি করে ২ টাকা মুনাফা করে প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়া পেট্রল, অকটেন ও জেট ফুয়েল বিক্রি করে অনেক আগে থেকেই মুনাফা করছে। বিপিসি সূত্রে জানা যায়, বছরে দেশে আমদানি করা ৫৭ লাখ টন জ্বালানি তেলের মধ্যে ৩৩ লাখ টনই ডিজেল, যা মোট আমদানির ৬৫ শতাংশ। ডিজেলের পর বেশি আমদানি হয় ফার্নেস অয়েল। এর পরিমাণ ১০-১২ লাখ টন। অন্যদিকে প্রতি লিটার ফার্নেস অয়েল কিনতে বিপিসির ব্যয় হয় ৫০ টাকা। তা বিক্রি থেকে আয় হয় ৬০ টাকা।