ভবিষ্যত সংকটের কথা চিন্তা করেই গ্যাস আমদানি সম্ভব নয়: তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী
নিজস্ব প্রতিবেদক:
প্রধানমন্ত্রী বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বীর বিক্রম বলেছেন, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কেনার পয়সা নেই। কী দামে বিক্রি করব সেটা পরের বিষয়। ভবিষ্যত সংকটের কথা চিন্তা করেই গ্যাস আমদানি সম্ভব নয়।
শিল্পখাতে প্রয়োজনে বেশি দামে হলেও এলএনজি সরবরাহ বাড়ানো হবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি এই কথা বলেছেন।
রোববার রাজধানীর একটি হোটেলে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই) আয়োজিত ‘শিল্পে জ্বালানি সংকট সমাধান’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি একথা বলেন।
সঙ্কট মোকাবিলায় ১০২ কোটি ডলার ব্যয় করে, বছরে ৪০০ এমএমসিএফডি গ্যাস আমদানির জন্য ব্যবসায়ীদের দাবি প্রত্যাখ্যান করেন জ্বালানি উপদেষ্টা। তিনি বলেন, এটি সম্ভব নয়, সম্ভাব্য আর্থিক সংকট মোকাবিলায় সরকারকে বৈদেশিক মুদ্রা সংরক্ষণ করতে হবে। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ের বিষয়ে খুব সতর্ক থাকতে হবে। কারণ, আমরা জানি না রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কখন শেষ হবে।
তৌফিক ইলাহী বলেন, ডলারের ঘাটতির কারণে এই অবস্থা। প্রয়োজনে শপথ নেব শিল্প ও কৃষিতে বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ানোর প্রয়োজনে দিনের বেলা অন্যখাতে বিদ্যুৎ ব্যবহার করব না। আসুন সবাই মিলে বিদ্যুতের ব্যবহার কমাই। যুদ্ধের সময় আমাদের কিছু ছিল না। বাতি ছিল না, খাওয়াও ছিল না, কিন্তু বাঙালিরা পেরেছে। সবাই মিলে চেষ্টা করলে ১০-২০ শতাংশ বিদ্যুতের চাহিদা কমাতে পারব। শিল্পকে বাঁচাতে পারব।
তিনি বলেন, কৃষি ও শিল্পে বিদ্যুৎ বেশি দেওয়ার চেষ্টা করব। প্রয়োজনে অন্যরা বিদ্যুৎ ব্যবহার কম করব। প্রয়োজনে দিনের বেলা ব্যবহারই করব না। যদি শিল্পে বিদ্যুৎ দেই, তাহলে আবাসিকে সরবরাহ কমাতে হবে। সেটা করলেই আবার মিডিয়ায় অনেকেই অনেক কথা বলবেন।
তিনি আরও বলেন, আজ যদি আমরা গ্যাস বাঁচাতে চাই তাহলে লোডশেডিং বাড়বে, তখন আপনারাই সমালোচনা করবেন। অথচ একসময় সব জায়গায় বিদ্যুৎ ছিল না। আমরা চাইলে এসি বন্ধ রাখতে পারি। বিদ্যুৎ ব্যবহার কমাতে পারি। সারা দেশে যে পরিমাণ এসি চলে, তাতেই পাঁচ থেকে ছয় হাজার মেগাওয়াট চাহিদা আছে। আমরা এসি বন্ধ রাখব বা কম চালাব। এতে দুই-তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে। গ্যাস সাশ্রয় হবে। সবাই যদি রাজি হই লোড কমাব, তাহলে কিছু গ্যাস রিলিজ হবে।
সম্ভাবনার কথা জানিয়ে তৌফিক ইলাহী বলেন, আগামী তিন চার মাসের মধ্যে ভোলা থেকে আট কোটি ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে প্রায় এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে। তখন বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে কিছু গ্যাস সরিয়ে শিল্পকারখানায় দেয়া যাবে। এছাড়া, স্বল্পতম সময়ের মধ্যে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে আরও এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা আছে।
আলোচনায় দেশের বর্তমান গ্যাস ও বিদ্যুতের সার্বিক অবস্থা নিয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসাইন। ইজাজ হোসেন বলেন, জ্বালানি পরিস্থিতির উন্নতির জন্য সরকারের কাছে কিছু বিকল্প রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে দাম কমতে থাকায় স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি করা, গাজীপুর, সাভার এবং নারায়ণগঞ্জের সিএনজি স্টেশন, গৃহস্থালী গ্রাহক ও বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে শিল্পে গ্যাস সরানো। আর, সার কারখানা বন্ধ করে, আন্তর্জাতিক বাজার থেকে সার আমদানি করা। এমন পদক্ষেপ শিল্পে গ্যাস সরবরাহ বাড়াবে, তবে লোডশেডিং বাড়াতে পারে।
ড. বিনায়ক সেন বলেন, সার কারখানা বন্ধ করে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমানো ভাল বিকল্প হতে পারে না। সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হচ্ছে খাদ্য উৎপাদনে কৃষিকে সহায়তা করা।
সেমিনারে এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন জানান, শিল্প খাতে গ্যাস সরবরাহ বাড়তে প্রয়োজনে আবাসিকে গ্যাস রেশনিং করা যেতে পারে। বিভিন্ন খাত থেকে কিছু কমিয়ে যদি শিল্প খাতে কিছুটা হলেও গ্যাস সরবরাহ বাড়ানো যায়, তাহলে সেখানে কারখানাগুলো বাঁচবে।
বিসিআই সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম পারভেজ বলেন, গ্যাস সংকট ও লোডশেডিং-এর কারণে অনেক শিল্পকে তাদের উৎপাদন স্থগিত করতে হচ্ছে। ফলে কাঁচামাল আমদানি কমেছে এবং রপ্তানি কমছে। আমরা যদি পর্যাপ্ত গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ না পাই, তাহলে শিল্প টিকবে না।
এফবিসিসিআই ও বিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এবং হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ বলেন, পোশাক কারখানার মালিকদের দিনের বেলা তাদের কার্যক্রম স্থগিত করতে হয়। এখন পরিস্থিতি এমন যে তারা জনবল কমাতে বাধ্য করছে। যদি কর্মচারীদের বরখাস্ত করি, তাহলে সমাজ ও অর্থনীতিতে এর কী প্রভাব পড়বে? এটি একটি বড় প্রশ্ন।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন জানান, আমাদের শিল্প-কারখানাগুলো এখন গ্যাস সংকটে ভুগছে। এ মুহূর্তে আমাদের কারখানাগুলো ভালোভাবে সচল রাখতে জাতীয় গ্রিডে অন্তত দৈনিক তিন হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের প্রয়োজন।
বিকেএমইএর ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. আক্তার হোসাইন অপূর্ব বলেন, আমাদের শিল্প-কারখানাগুলোর ৪০ শতাংশ উৎপাদন কমে গিয়েছে। ঠিকমতো গ্যাস-বিদ্যুৎ না পেয়ে বন্ধ হয়ে গিয়েছে অনেক ফ্যাক্টরি। এ অবস্থায় অনেকেই অর্ডার ক্যানসেল করে দিচ্ছেন।