মধ্যআয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্ন: সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকার বাজেট
মধ্যআয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্নপূরণে আগামী অর্থবছরের বাজেট পেশ করলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বৈষম্যদূর করে সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের আয় বাড়ানোর লক্ষ ঠিক করা হয়েছে। এজন্য বেশি আয়ের মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে দারিদ্র দূর করা ও উন্নয়নে খরচ করার হিসাব দেয়া হয়েছে। তবে সে হিসাবে বিশাল অর্থের ঘাটতি রয়েগেছে।
বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী।
প্রস্তাবিত বাজেটের আকার তিন লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি সর্বোচ্চ বরাদ্দ। তবে এই টাকার মধ্যে ঘাটতি রয়েছে ৯৭ হাজার ৮৫৩ কোটি। ব্যয় করা হবে বলা হয়েছে ঠিকই কিন্তু আয়ের উৎস ঠিক নেই। চলতি অর্থ বছর বাজেট ছিল দুই লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা। চলতি বছর থেকে আসছে বছর বাজেট ৪৫ হাজার কোটি টাকা বাড়ছে। তবে ২০১৫-১৬ অর্থবছর মোট খরচ হয়েছে দুই লাখ ৬৪ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকা।
উন্নয়ন কাজের জন্য সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে পরিবহনে। তারপর স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন। শিক্ষা আছে তিন নম্বরে। তারপর বিদ্যুৎ জ্বালানি। মানুষের জীবন যাত্রার মান উন্নয়নের সহায়ক বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ২০২১ সালে মধ্য আয় ও ’৪১ সালে সমৃদ্ধ দেশ গড়ার লক্ষ্যকে সামনে রেখে এই বাজেট পেশ করা হয়েছে। পদ্মা সেতু, তথা যোগাযোগ অবকাঠামো, ভৌত অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান- প্রযুক্তি, কৃষি, মানবসম্পদ উন্নয়ন খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে।
করহার বেড়েছে, ভ্যাট আইন এক বছর পেছালেও প্যাকেজ ভ্যাট দ্বিগুণ করা হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে ভ্যাটের আওতা। নতুন নতুন পণ্য ও সেবা খাত ভ্যাটের আওতাভুক্ত হয়েছে।
একই ব্যক্তিমালিকানাধীন ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্য আগে ভিন্ন ভ্যাট খাতে ভিন্ন নিবন্ধনের প্রয়োজন হত। এবারে সেটি রহিত করা হয়েছে। যা ব্যবসায়ীদের হয়রানি দূর করবে। একই ভাবে কোনো কোনো শিল্পখাতের কাঁচামাল আমদানি শুল্ক কমানো হয়েছে। সম্পূর্ণ তৈরি কিছু পণ্যের ওপর সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে।
নতুন বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে যোগাযোগ খাতে ২৫ দশমিক আট শতাংশ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। মানব সম্পদ খাতে ২৪ দশমিক ছয় শতাংশ। এরপর সার্বিক কৃষি খাতে ২৪ দশমিক পাঁচ শতাংশ, বিদ্যুত্ ও জ্বালানি খাতে ১৩ দশমিক তিন শতাংশ।
বেশি করে কর আদায় করেই আগামী বছরের খরচ মেটানো হবে। এজন্য করের আওতা, ভ্যাটের আওতা বাড়ানো, প্যাকেজ ভ্যাট দ্বিগুণ করা, মোবাইল ফোনে কথা বলার ওপর কর বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে।
বাজেটে মোট রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে দুই লাখ ৫২ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা, যা জিডিপি’র ১২ দশমিক চার শতাংশ। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এর মাধ্যমে আয় ধরা হয়েছে দুই লাখ তিন হাজার ১৫২ কোটি টাকা, যা জিডিপি’র ১০ দশমিক ৪ শতাংশ। এছাড়া, এনবিআর ছাড়া অন্য খাত থেকে কর রাজস্ব ধরা হয়েছে সাত হাজার ২৫০ কোটি টাকা, যা জিডিপির ০দশমিক চার শতাংশ। কর ছাড়া অন্য খাত থেকে রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ৩২ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা, যা জিডিপির এক দশমিক ছয় শতাংশ।
অনুন্নয়নসহ খরচ ধরা হয়েছে দুই লাখ ২৩ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১১দশমিক ৪ শতাংশ। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে এক লাখ ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা যা জিডিপির পাঁচ দশমিক ছয় শতাংশ এবং বিদ্যুৎ খাতে ইসিএ ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার ১২ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা। এর ফলে এডিপির মোট আকার হলো এক লাখ ২৩ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা, যা জিডিপির ছয় দশমিক তিন শতাংশ।
সার্বিক বাজেট ঘাটতি ৯৭ হাজার ৮৫৩ কোটি টাকা দেখানো হয়েছে, যা জিডিপির পাঁচ শতাংশ। এ ঘাটতি অর্থায়নে বৈদেশিক সূত্র থেকে ৩৬ হাজার ৩০৫ কোটি টাকা, যা জিডিপির এক দশমিক নয় শতাংশ এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৬১ হাজার ৫৪৮ কোটি টাকা, যা জিডিপি’র তিন দশমিক এক শতাংশ ধরা হয়েছে। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৩৮ হাজার ৯৩৮ কোটি টাকা, যা জিডিপির দুই শতাংশ এবং সঞ্চয়পত্র ও অন্যান্য ব্যাংক ছাড়া অন্য উৎস থেকে ২২ হাজার ৬১০ কোটি টাকা সংস্থানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা সাত দশমিক দুই শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া মূল্যস্ফীতি পাঁচ দশমিক আট শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।
বাজেটে সামাজিক অবকাঠামোগত খাতে মোট বরাদ্দের ২৩ দশমিক ৩ শতাংশ, যার মধ্যে মানব সম্পদ খাত- শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সংশ্লিষ্ট খাতে ২৫ দশমিক দুই শতাংশ, ভৌত অবকাঠামো খাতে ২৯ দশমিক সাত শতাংশ- যার মধ্যে রয়েছে সার্বিক কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন খাতে ১৩ দশমিক ছয় শতাংশ, যোগাযোগ অবকাঠামো খাতে ১০ দশমিক দুই শতাংশ এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানী খাতে চার দশমিক চার শতাংশ।
এছাড়া সাধারণ সেবা খাতে ২৪ দশমিক পাঁচ শতাংশ, সরকারি বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি), বিভিন্ন শিল্পে আর্থিক সহায়তা, ভর্তুকি, রাষ্টায়ত্ত, বাণিজ্যিক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের জন্য ব্যয় বাবদ দুই দশমিক দুই শতাংশ। এছাড়া সুদ পরিশোধ বাবদ ১১ দশমিক সাত শতাংশ নিট ঋণদান ও অন্যান্য ব্যয় খাতে অবশিষ্ট তিন দশমিক পাঁচ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় গত সাত বছরে বিভিন্ন খাতে সরকারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন চিত্র বিস্তারিত ভাবে তুলে ধরেন। বিশেষ করে গত সাড়ে ৬ বছরে মন্দা মোকাবেলায় সাফল্য, বিদুৎ-জ্বালানি, ডিজিটাল বাংলাদেশ, কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, যোগাযোগ, শিল্প-বাণিজ্য, সামাজিক নিরাপত্তা, প্রবাসী কল্যাণ, নারী ও শিশু, ভূমি ব্যবস্থাপনা, বিনিয়োগ বৃদ্ধি, আমদানি রপ্তানি, রেমিট্যান্স ও জনশক্তি রপ্তানী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও বিনিময় হার, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, স্থানীয় সরকার পুর্নগঠন ও ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ, কর্মসংস্থানসহ সকল ক্ষেত্রে অর্জিত সাফল্যের বর্ণনা করেন।
এর আগে দুপুরে সংসদ ভবনের মন্ত্রিসভা কক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিপরিষদের সভায় প্রস্তাবিত বাজেট অনুমোদন করা হয়। এরপরই রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ প্রস্তাবিত বাজেট অনুমোদন করেন।
এছাড়াও অর্থমন্ত্রী ২০১৫-১৬ অর্থবছরের জন্য দুই লাখ ৬৪ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকার সংশোধিত বাজেট পেশ করেন। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেট ছিল দুই লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের পর এটি হচ্ছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের তৃতীয বাজেট। এছাড়া গত বছরের মতো এবারও সংসদে বিরোধীদলের উপস্থিতিতে বাজেট পেশ করা হলো।
অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় বলেন, বিগত ৭ বছরে সরকারের নিরন্তর কর্মপ্রচেষ্টার সাথে সর্বস্তরের জনগণের একাত্মতা প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের ধারাকে নির্বিঘœ ও গতিশীল রেখেছ্ে এতে সবার জীবনে আয়, উন্নতি ও স্বাচ্ছন্দ্য এসেছে। তিনি বলেন, সমৃদ্ধি অর্জনের অভিযাত্রায অনেকটা পথ এগুলেও আমাদের যেতে হবে আরও অনেক দূর। বিশেষ করে, দারিদ্র্রকে সমূলে উৎপাটন করতে হবে। সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থান। বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে নির্মাণ করতে হবে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি, সমাজের সর্বক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অর্থমন্ত্রী বলেন, একই সাথে গুরুত্বপূর্ণ খাতসমূহে সম্পদ সঞ্চালনের জন্য রাজস্ব আদায়সহ বিদেশী সহায়তার ব্যবহারও বাড়ানো দরকার। পাশাপাশি, জনপ্রশাসনে সক্ষমতার উন্নয়ন, ই-গভর্নেন্স, ভূমি ব্যবস্থার আধুনিকায়নসহ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারলে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে আমরা এগিয়ে যেতে পারব বহুদূর। মুহিত বলেন, বাংলাদেশের এ অগ্রযাত্রার চ্যালেঞ্জগুলো সরকার চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছে। এখন সবচেয়ে বড় প্রয়োজন এ সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাস্তবানুগ কার্যক্রম। বিশেষ করে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে নারীর অংশগ্রহণ, দক্ষতার উন্নয়ন, বিনিয়োগে বাস্তবায়ন সক্ষমতা ও গুণগত মান বৃদ্ধি, উৎপাদনে উদ্ভাবন ও প্রযুক্তির প্রসার, রপ্তানি পণ্য ও বাজারের বহুমুখীকরণ, প্রবাসে শ্রমবাজার সম্প্রসারণ ও পরিকল্পিত নগরায়ন ইত্যাদি একান্ত জরুরি।
আগামী ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের ১৩তম বাজেট। আগের মেয়াদসহ টানা অষ্টম বাজেট এটি। এর আগে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ মেয়াদে পাঁচবার তার সরকারের বাজেট দেয়া হয়।
বাজেটে উন্নয়নের লক্ষ ও কৌশল হচ্ছে উচ্চ প্রবৃদ্ধি। মাথাপিছু আয় বাড়িয়ে জনগণের জীবনমান উন্নয়ন। আর রূপকল্পের স্বপ্ন বাস্তবায়নে কৌশল হচ্ছে উপযুক্ত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর উন্নয়ন, গণদ্রব্য ও সেবার যোগান বাড়ানো, বিশ্বাবাজারের সাথে ক্রমান্বয়ে একীভূত হওয়া, উৎপাদন বিশেষায়ন ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষা করা।