মেট্রোরেলে চড়ে যোগাযোগের নতুন পর্বে ঢাকা

নিজস্ব প্রতিবেদক/বিডিনিউজ:

উচ্ছ্বাস আর প্রত্যয়ী ঘোষণার মধ্য দিয়ে নগর যোগাযোগের মেট্রোরেল পর্বে যাত্রা করেছে বাংলাদেশ; যানজটের নগরীতে ঠিক সময়ে ও নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছানোর আশা দেখাচ্ছে আধুনিক এই গণপরিবহন।

বুধবার বর্ণিল আয়োজনে দেশের প্রথম মেট্রোরেলের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা; পরে পতাকা নাড়িয়ে ট্রেন চালু করে দিয়ে টিকেট কেটে যাত্রী হয়ে তিনি গন্তব্যেও গিয়েছেন।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সরকারপ্রধান বলেন, “বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় আরেকটি পালক, আজ বাংলাদেশ তথা ঢাকায় আমরা দিতে পারলাম, সংযোজিত করতে পারলাম। এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় কথা।”

জাপানের আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতায় উত্তরার দিয়াবাড়ি থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ২১ দশমিক ২৬ কিলোমিটার মেট্রোরেল নির্মাণের এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার।

নির্মাণকাজ চলার মধ্যে প্রথম দফায় উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী। বৃহস্পতিবার থেকে ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এই পথে বৈদ্যুতিক ট্রেনে চলাচল করতে পারবে সাধারণ যাত্রীরাও।

উদ্বোধন ঘিরে এদিন উৎসবমুখর পরিবেশে সাজানো হয় ঢাকার বিভিন্ন এলাকা। উত্তরা-১৫ সেক্টরের দিয়াবাড়ি মাঠে সুধী সমাবেশে মিলিত হন বিপুল সংখ্যক মানুষ।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখতে গাজীপুরের চন্দ্রা থেকে এসেছেন টেইলার্স দোকানি মোহাম্মদ আরাফাত। তিনি বলেন, “মেট্রোরেল তো উদ্বোধনের পরেও দেখা যাবে, আমি এসেছি ইতিহাসের অংশ হতে। এটা আমাদের জন্য গর্বের, শুধু শুনেছি বিদেশে মেট্রো রেল চলে আজকে আমাদের দেশেও চালু হচ্ছে এটা দেখতেই এসেছি।”

ময়মনসিংহের ত্রিশাল থেকে ভোরে এসে সুধী সমাবেশে যোগ দেন আওয়ামী লীগ কর্মী সরাফাত আলী। তিনি বলেন, “মেট্রোরেল আমাদের অহংকার, এটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমাদের নেত্রী উদ্বোধন করবেন, এটাই দেখতে আসছি।”

কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক পাঠাগার সম্পাদক সৈয়দ ইমাম বাকেরও উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। তার ভাষায়, মেট্রোরেল হবে তরুণ প্রজন্মের অহঙ্কার।

“বাংলাদেশ আজকে উন্নত বিশ্বের কাতারা, ঢাকার মানুষের কর্মঘণ্টা বেঁচে যাবে। আজকের দেশরত্ন শেখ হাসিনার উন্নয়নের দিনটি মাইল ফলক হয়ে থাকবে। দিনটি উদযাপন করতে আমি এসেছি।”

নারায়ণগঞ্জ চাষাঢ়া থেকে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আসা রায়হান উদ্দিন বলেন, “এমন একটা উন্নয়নকাজ উদ্বোধন হচ্ছে, দেখতে না এসে থাকতে পারলাম না। আগামীকাল আবার আসব মেট্রোরেলের চড়ার জন্য।”

বুধবার বেলা ১১টায় দিয়াবাড়ি খেলার মাঠে তৈরি উদ্বোধনী মঞ্চে আসেন প্রধানমন্ত্রী। মেট্রোরেলের উদ্বোধনী ফলকের প্রতিরূপ উন্মোচন করে উদ্বোধনের আনুষ্ঠানিকতা সারেন।

এরপর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের সিনিয়র পেশ ইমাম হাফেজ মাওলানা মুফতি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান মোনাজাত করেন।

পরে উদ্বোধনের বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতায় যোগ দেন শেখ হাসিনা। পুরো আয়োজনে তার সঙ্গে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানা।

সুধী সমাবেশের মঞ্চে শেখ রেহানা ছাড়াও সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, ঢাকা উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি বেগম রওশন আরা মান্নান, স্থানীয় সংসদ সদস্য হাবীব আহসান, সচিব এ বি এম আমিনুল্লা নূরী, ডিএমসিটিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক, ঢাকায় জাপানের নতুন রাষ্ট্রদূত কিমিনোরি ইওয়ামা ও জাইকার মুখ্য প্রতিনিধি ইচিগুচি তোমোহিদে এবং মেট্রোরেলের প্রকল্প পরিচালক আফতাব উদ্দিন উপস্থিত ছিলেন।

সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরীর স্বাগত বক্তব্যের পর ডিএমসিটিএলের এমডি এম এ এন ছিদ্দিক, জাইকা প্রতিনিধি ইচিগুচি তোমোহিদে ও জাপানি রাষ্ট্রদূত কিমিনোরি ইওয়ামা বক্তব্য দেন।

মেট্রোরেলের এরিয়াল ভিডিও দেখানোর পর বাজানো হয় থিম সং। ‘অর্থনীতির চাকা ঘুরবে পেছনে ফেলে যানজট’ শিরোনামে এ গানে কণ্ঠ দেন সংগীত শিল্পী সংসদ সদস্য মমতাজ বেগম।

সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সভাপতির বক্তব্য দেওয়ার পর প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বক্তৃতা পর্বের পর মেট্রোরেলের শুভেচ্ছা স্মারক প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেন ওবায়দুল কাদের। এরপর মেট্রোরেলের কাজে জড়িতদের সঙ্গে দলীয় ছবি তোলেন সরকারপ্রধান। উন্মোচন করেন স্মারক ডাকটিকেট ও স্মারক নোট প্রধানমন্ত্রী।

‘আরেকটি পালক’ 

দেশের প্রথম মেট্রোরেল চালুর মাধ্যমে দুর্বার গতিতে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যাশা ব্যক্ত করে উন্নত স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বক্তৃতায় মেট্রোরেলের পথ ধরে আসন্ন সুযোগ-সুবিধার কথা তুলে ধরার পাশাপাশি সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনার নানা দিক তিনি তুলে ধরেন।

মেট্রোরেলের সুবিধা নেওয়ার সঙ্গে উন্নত প্রযুক্তিসম্পন্ন এই বাহন ব্যবহারের ক্ষেত্রে নাগরিকদের দায়বদ্ধতার বিষয়ও স্মরণ করিয়ে দেন সরকারপ্রধান। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, রক্ষণাবেক্ষণে সচেতনতা ও নিয়ম মেনে চলার অনুরোধ জানান সবাইকে।

উন্নয়নের যাত্রায় দেশকে এগিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে সরকার কাজ করছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করে বাংলাদেশ এবং বাঙালি জাতি সারা বিশ্বে মর্যাদা পেয়েছে। আমরা আজকে আরেকটি নতুন অহঙ্কারের পালক বাংলাদেশের মুকুটে সংযোজিত করলাম।”

মেট্রোরেলের মাধ্যমে নতুন মাইলফলকে যাওয়ার পাশাপাশি আরও তিনটি নতুন অর্জন হওয়ার কথা অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন সরকারপ্রধান।

তিনি বলেন, “এই প্রথম বাংলাদেশ বৈদ্যুতিক ট্রেনের যুগে প্রবেশ করল। মেট্রোরেল দূর-নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে পরিচালিত হবে, ডিজিটাল পদ্ধতিতে এটাকে পরিচালনা করা হবে। তার ফলে আমরা যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা দিয়েছি, এটা সেখানে নতুন মাত্রা সংযুক্ত হল।”

ঢাকাকে যানজটমুক্ত করার লক্ষ্য নিয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে ঢাকায় মেট্রো নেটওয়ার্ক নির্মাণের কাজ শেষ করার আশা প্রকাশ করেন তিনি। মোট ছয়টি লাইনের এই মেট্রো নেটওয়ার্ক দিয়ে পুরা শহরের মানুষকে সেবা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে সরকার।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “মেট্রোরেল চালু করার আমাদের যে সম্পূর্ণ পরিকল্পনা, তা চালু হওয়ার সাথে সাথে আমাদের দেশের মানুষের কর্মক্ষমতা বাড়বে, যোগ্যতা বাড়বে, কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে আর আমাদের জিডিপিতেও যথেষ্ট অবদান রাখবে।”

ঢাকা আসার পর দেশবাসীও মেট্রোরেলের সুবিধা পাবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “কমলাপুরে নেমে উত্তরা পর্যন্ত যেতে আর যানজটে পড়তে হবে না। এভাবে যানজট নিরসন হবে।”

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘হবে জয়’ কবিতার চরণ উদ্ধৃত করে সরকারপ্রধান বলেন, “অসম সাহসে আমরা অসীম, সম্ভাবনার পথে ছুটিয়া চলেছি, সময় কোথায় পিছে চাব কোন মতে!”

কবি নজরুল ইসলামের কবিতাংশের সঙ্গে যুক্ত করে বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “এগিয়ে যাব আমরা দুর্বার গতিতে, এগিয়ে যাবে বাঙালি দুর্বার গতিতে। গড়ে তুলব সকল বাধা অতিক্রম করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত, উন্নত, সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলব।”

জনগণকে নিয়ম মেনে পরিচ্ছন্নভাবে মেট্রোরেল ব্যবহারের অনুরোধ জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, “একটা অনুরোধ থাকবে, অনেক টাকা খরচ করে এই মেট্রোরেল করা হয়েছে। এটাকে সংরক্ষণ করা, এটার মান নিশ্চিত রাখা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা- এই সবকিছু কিন্তু যারা ব্যবহার করবেন তাদের দায়িত্ব।

“এখানে অনেক আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়েছে, ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার হয়েছে। এই সমস্ত জিনিস যেন নষ্ট না হয়। ব্যবহারের ক্ষেত্রে সকলে যত্নবান হবেন। খেয়াল রাখবেন কেউ যেন আমাদের রেল স্টেশনগুলিতে আবর্জনা-ময়লা না ফেলে, অপরিচ্ছন্ন করতে না পারে- সবাইকে এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে।”

প্রথম যাত্রা 

উত্তরার দিয়াবাড়িতে উদ্বোধনের আনুষ্ঠানিকতা শেষে মেট্রোরেলের যাত্রী হয়ে আমন্ত্রিত অতিথিদের নিয়ে মাত্র ১৮ মিনিটে আগারগাঁও এসেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

যাত্রাপথে আসন থেকে উঠে অতিথিদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন প্রধানমন্ত্রী। সঠিক গতি রেখে চললে ১০ মিনিট ১০ সেকেন্ডে উত্তরা থেকে আগারগাঁও স্টেশনে পৌঁছার কথা ছিল। তবে ধীরগতিতে চলায় ১৮ মিনিটের মত সময় নেয় প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী দেশের প্রথম মেট্রোরেল।

বুধবার দিয়াবাড়িতে সুধী সমাবেশে বক্তব্য শেষে বেলা ১টা ৩০ মিনিটের সময় উদ্বোধনী ফলকের কাছে একটি তেঁতুল গাছ রোপণ করেন প্রধানমন্ত্রী। বেলা ১টা ৩৪ মিনিটে উত্তরা উত্তর স্টেশনের এক নম্বর কাউন্টার থেকে মেট্রোরেলের টিকিট কাটেন তিনি ও তার বোন শেখ রেহানা।

সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নূরী, ডিএমটিসিএল এমডি এম এ এন ছিদ্দিকসহ বেশ কয়েকজন এই সময় তাদের সঙ্গে ছিলেন।

টিকেট কেটে চলন্ত সিঁড়িতে চড়ে স্টেশন প্লাজার তৃতীয় তলায় প্ল্যাটফর্মে গিয়ে দাঁড়ান তারা। সেখানে বেলা ১টা ৩৯ মিনিটে সবুজ পতাকা দুলিয়ে একটি ট্রেনের আনুষ্ঠানিক যাত্রার উদ্বোধন করেন। পরে সেই পাতাকায় তিনি সই করেন, যা একটি স্মারক হয়ে থাকল।

সেই অনুষ্ঠানিকতা শেষে বেলা ১টা ৪৫ মিনিটে নির্ধারিত ট্রেনে চেপে বসেন প্রধানমন্ত্রী। এই যাত্রায় তার সহযাত্রী ছিলেন দুই শতাধিক নাগরিক, যাদের মধ্যে ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা, স্কুল কলেজ ও মাদ্রাসা শিক্ষার্থী, মসজিদের ইমাম, পোশাক কর্মী, রিকশা চালক, সবজি বিক্রেতা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রতিনিধি, ব্যবসায়ী, কূটনীতিক আর সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা।

বেলা ১টা ৫৩ মিনিটে প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী ট্রেন উত্তরা থেকে আগারগাঁওয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। প্রধানমন্ত্রী ও তার বোন শেখ রেহানা মাঝের আসনে বসেছিলেন দলের জ্যেষ্ঠ নেতা মতিয়া চৌধুরী। যাত্রা পথে আসন থেকে উঠে অতিথিদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন প্রধানমন্ত্রী।

বেলা ২টা ১১ মিনিটে প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী ট্রেন আগারগাঁও স্টেশনে পৌঁছায়। দুই মিনিট পর অপেক্ষমান গাড়িতে চড়ে গণভবনের দিকে চলে যান প্রধানমন্ত্রী।

তার ট্রেনের চালক ছিলেন মরিয়ম আফিজা, যিনি নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেমিস্ট্রি অ্যান্ড কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতকোত্তর করে মেট্রোরেলের চাকরিতে যোগ দিয়েছেন।

যাত্রী নিয়ে প্রথম মেট্রোরেল যাত্রার পর এক প্রতিক্রিয়ায় মরিয়ম আফিজা বলেন, “আমার জন্যও এটা গর্বের একটা মুহূর্ত, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের সঙ্গে ছিলেন। আমরা সবাই জানি, ঢাকা শহরের যানজট কতটা সমস্যার; মেট্রোরেল তাতে কিছুটা স্বস্তি দেবে বলেই আমি আশা করি।”

স্মরণে তারা 

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় নিহত সাত জাপানি নাগরিককেও স্মরণ করেন প্রধানমন্ত্রীসহ প্রায় সব বক্তা।

২০১৬ সালের ১ জুলাইয়ের ওই ঘটনার পর মেট্রোরেলের কাজ পুনরায় চালু করার পেছনে জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে’র যে ভূমিকা, তাও স্মরণ করেন শেখ হাসিনা।

ওই হামলায় নিহত সাত জাপানি নাগরিকের মধ্যে ৬ জন ঢাকায় নতুন দুই মেট্রোরেল লাইন নির্মাণের সমীক্ষায় জড়িত ছিলেন।

জাপানি নাগরিকদের স্মরণে দিয়াবাড়িতে স্মৃতিফলক নির্মাণের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “তাদের নামটা যেন স্মরণে থাকে, আমরা সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

ঢাকার মেট্র্রোরেল নির্মাণ কাজের উদ্বোধনের কিছুদিন পর ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলা হয়। মোট ১৭ বিদেশি নাগরিকসহ ২২ জনকে সেদিন নির্মমভাবে হত্যা করেছিল জঙ্গিরা। দুই নারীসহ সাত জাপানি নাগরিক ছিলেন তাদের মধ্যে।

চলতি বছরের জুলাইয়ে উত্তরার দিয়াবাড়িতে মেট্রো রেল ডিপোতে নিহতদের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেছে সরকার। তাদের প্রাণক্ষয়ের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, “আমি তাদের আত্মার শান্তি কামনা করি ও তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।”

ঢাকায় টোকিওর প্রতিনিধি, রাষ্ট্রদূত কিমিনোরি ইওয়ামাও তার দেশের বিশেষজ্ঞদের স্মৃতি ধরে রাখার ওপর জোর দেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে।

জাপানি নাগরিকদের ত্যাগকে স্মরণ ও তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য সপ্তাহখানেক আগে হলি আর্টিজান বেকারির স্থানটি পরিদর্শনে যাওয়ার কথা এ সময় বলেন তিনি।

মাত্র ১০ দিন ঢাকা মিশনে যোগ দেওয়া কিমিনোরি ইওয়ামা বলেন, “এই মর্মান্তিক ঘটনা ও তাদের আত্মোৎসর্গ যেন আমরা কোনোভাবে না ভুলি। আমরা সামনে এগিয়ে যাব এবং দুঃখ কাটিয়ে উঠে আর প্রকল্পটি সম্পন্ন করার মাধ্যমে আমাদের দায়িত্ব পালন করব।”

জাপানি বিশেষজ্ঞদের প্রাণক্ষয়ের পথ ধরে মেট্রোরেল প্রকল্প এগিয়ে যাওয়ার কথা স্মরণ করেন ঢাকায় জাইকার মুখ্য প্রতিনিধি ইচিগুচি তোমোহিদে-ও।

‘কালের সাক্ষী’ 

রাজধানীর উত্তরায় দেশের প্রথম বৈদ্যুতিক ট্রেনের উদ্বোধনী উদযাপন যখন চলছে আগারগাঁও প্রান্তেও জড়ো হয়েছিলেন একদল উৎসুক জনতা।

ব্যানার-ফেস্টুন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সচকিত উপস্থিতি এবং গণমাধ্যম কর্মীদের ব্যস্ততায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের কিছুটা আমেজ আগারগাঁওয়ে এসে পড়েছিল।

সেখানে উপস্থিত নওগাঁ জেলার মান্দা থানা আওয়ামী লীগের মহিলা সম্পাদিকা জেসমিন আরা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আজ মেট্রো রেল উদ্বোধন হচ্ছে। আমাদের জন্য এতবড় আনন্দ আর দ্বিতীয়টি নেই। বাংলাদেশের এত বড় অর্জনের সাক্ষী হতে গত এক সপ্তাহ ধরে আমি ঢাকায়।

“সময়ের অভাবে উত্তরা দিয়াবাড়ি যেতে পারিনি। তাই এখানে দাঁড়িয়েছি যদি প্রধানমন্ত্রী যাওয়ার সময় তাকে এক নজর দেখা যায়।”

সিলেটের গোপালপুরের নাসির উদ্দিন বলেন, গতকাল তিনি ঢাকার আগারগাঁওয়ে এক আত্মীয়র বাসায় বেড়াতে এসেছেন। মেট্রো রেলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখতে সকাল থেকেই আগারগাঁওয়ে অবস্থান করছেন।

“মেট্রোরেল নিয়ে আমাদের সিলেটের মানুষও অনেক বেশি উচ্ছ্বসিত। আমাদের এখন একটা মেট্রো রেল আছে। আগামী কাল মেট্রোরেলে চড়ে তারপরেই বাড়ি ফিরব।”

আগারগাঁওয়ে যেসব উৎস্যুক জনতা ভিড় করেছিলেন, তাদের অনেকেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী; গত ২৪ ডিসেম্বর জাতীয় সম্মেলন উপলক্ষে ঢাকায় এসে মেট্রোরেলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখার জন্য থেকে গেছেন। আগারগাঁওয়ে কোনো কর্মসূচি না থাকলেও নিজেদের উদ্যোগে বিচ্ছিন্নভাবে আগারগাঁও এলাকায় জড়ো হয়েছেন তারা।

এমনই একজন নাটোর জেলার লালপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা কাজী আসিয়া জয়নুল বেনু।

তিনি বলেন, “বাংলাদেশের এত বড় অর্জনের দিনে ঘরে বসে থাকতে পারি না। কালের সাক্ষী হতে আমি আগারগাঁও এসে দাঁড়িয়েছি।

“আমরা চাই আাগামী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আবার ভোটে জয়লাভ করুক। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের শাসন অব্যাহত থাকলে এরকম আরও মেট্রোরেল হবে। সেজন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুস্থ্য থাকা খুব জরুরি “

পরের মেট্রোরেল কবে? 

উত্তরার দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশের উদ্বোধনের প্রস্তুতির মধ্যে মেট্রোরেল নির্মাণ তদারকি ও পরিচালনার দায়িত্ব থাকা ডিএমটিসিএল জানিয়েছে, আগামী বছরের ডিসেম্বরে চালু করা হবে আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত অংশও।

দেশের প্রথম মেট্রোরেল উদ্বোধন করে বুধবারের সুধী সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “আমরা নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষণা দিয়েছিলাম, ঢাকার যানজটমুক্ত করার জন্য বিভিন্ন রকমের পদক্ষেপ নেব। এবং পাশ্ববর্তী এলাকার সাথে এটার সংযোগ স্থাপন করব।

“আমরা ৬টি মেট্রোরেল করার পরিকল্পনা নিয়েছি, যা ২০৩০ সালের মধ্যে সম্পন্ন হবে বলে আমি আশা করি। চারটি মেট্রোরেল নির্মাণ বিভিন্ন পর্যায়ে বাস্তবায়নাধীন। আরও দুটি মেট্রোরেল নির্মাণের জন্য সম্ভাব্যতা যাচাই করা হচ্ছে।“

চলতি মাসে মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত অংশের কাজ শুরুর সম্ভাবনা এর আগে জানিয়েছিলেন ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক।

বুধবারের অনুষ্ঠানে মেট্রোরেল ঘিরে সরকারের পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে এই কর্মকর্তা বলেন, এমআরটি লাইন-৬ এর মতিঝিল অংশ ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে উদ্বোধনের পরিকল্পনা রয়েছে। কমলাপুর পযন্ত বর্ধিত করার কাজ পুরো দমে এগিয়ে চলছে।

কমলাপুর পর্যন্ত অংশ ২০২৫ সালের জুন মাসে চালুর প্রত্যাশা করে ডিএমটিসিএল এমডি বলেন, “আরও তিনটি মেট্রোরেলের নির্মাণ কাজ বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। এমআরটি লাইন-১ দেশের প্রথম পাতাল রেলের নির্মাণ ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শুভ উদ্বোধন করবেন বলে আমরা প্রত্যাশা করছি।

“এমআরটি লাইন-৫ নর্দান ২০২৩ সালের জুলাই মাসে প্রধানমন্ত্রী শুভ উদ্বোধন করবেন। আরও দুই লাইনের কাজ চলছে। সেটার ফিজিবিলিটি স্টাডিজের কাজ করছি। আশা করি, এর ভিত্তিতে বিনিয়োগ গ্রহণ করে ২০৩০ সালে ঢাকা মহানগরীতে মেট্রোরেলের একটা মাকড়সার জাল তৈরি করা সম্ভব হবে।”