রাজধানীর দুঃস্বপ্নের পরিবহন ব্যবস্থায় স্বস্তি এনেছে মেট্রো রেল

মলয় কুমার দত্ত, বাসস:

উত্তরা থেকে আগারগাঁও হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত বহুল প্রত্যাশিত মেট্রো রেল নামে পরিচিত দ্রুত পরিবহন পরিষেবা ওভারহেড বৈদ্যুতিক রেলওয়ে চলাচল শুরু করায় যানজটের দুঃস্বপ্নের মধ্যে নগরবাসীর জীবনে স্বস্তি নিয়ে এসেছে। মেট্রো রেল চালু হওয়ায় রাজধানীবাসী এখন থেকে উন্নত, দ্রুত ও নিরাপদ পরিবহন উপভোগ করতে পারবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শনিবার বিকেলে ম্যাস র‌্যাপিড ট্রান্সপোর্ট (এমআরটি) লাইন-৬ এর আগারগাঁও-মতিঝিল সেকশনের উদ্বোধনের পর, আজ সকাল থেকে যাত্রীদের জন্য এই সেবা চালু হয়েছে।
কর্তৃপক্ষ জানায় উত্তরা উত্তর, উত্তরা কেন্দ্র, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, মিরপুর ১১, মিরপুর ১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও, ফার্মগেট, সচিবালয় ও মতিঝিলসহ মোট ১৬টির মধ্যে ১২টি স্টেশনে বর্তমান ১০ মিনিটের ব্যবধান এবং স্টপেজসহ উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে মতিঝিল পৌঁছতে মাত্র ৩২ মিনিটের প্রয়োজন হবে। বিজয় সরণি, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়- এ চারটি স্টেশন ডিসেম্বরের মধ্যে চালু করা হবে বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নূরী।
উত্তরায় বসবাসকারী এক বেসরকারী চাকুরিজীবি কামাল আহমেদ উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে অফিসে যাওয়ার সময় মেট্রোরেলের মধ্যে বাসস প্রতিনিধিকে বলেন, ‘আমরা খুব রোমাঞ্চিত কারণ আমরা এই পরিবেশ-বান্ধব এবং দ্রুত রেল পরিষেবা উপভোগ করছি। আগে গন্তব্যে পৌঁছতে আমার প্রায় ২ থেকে ৩ ঘন্টা সময় লাগত। আজ আমি মতিঝিল এলাকায় মাত্র আধা ঘন্টায় পৌঁছব।’ তিনি বলেন, ‘উত্তরা থেকে মতিঝিলে তার অফিসে মাত্র আধা ঘণ্টায় পৌঁছানো তার কাছে স্বপ্নের মতো, কারণ ঈদের ছুটিতে যখন বেশির ভাগ মানুষ তাদের গ্রামের বাড়ি যাওয়ার জন্য রাজধানী ছেড়ে যায়, তখন রাস্তা প্রায় ফাঁকা থাকলেও এক ঘণ্টার প্রয়োজন হয়। আর, এখন এটা আমাদের জন্য স্বপ্ন সত্যি হওয়ার মতো, কারণ আমরা একটি উন্নত এবং পরিবেশবান্ধব নিরাপদ পরিবহনের সুযোগ পেয়েছি।’
কাজীপাড়া এলাকার বাসিন্দা ৪০ বছর বয়সী ব্যাংকার তৃষ্ণা রায় বলেন, আগে মেট্রো রেল প্রকল্পের নির্মাণ কাজের জন্য তাদের ভোগান্তি পোহাতে হয়েছিল, কিন্তু এখন এমন নিরাপদ রেল পরিষেবা পেয়ে তারা সবচেয়ে বেশি সৌভাগ্যবান নাগরিক। তিনি বলেন, ‘নিরাপত্তাজনিত সমস্যার কারণে আমি রিকশা বা সিএনজিচালিত অটোরিকশায় কারওয়ান বাজার এলাকায় আমার অফিসে যেতাম। কিন্তু এটি খুব ব্যয়বহুল। মেট্রো রেল একটি নতুন আশার সঞ্চার করেছে, কারণ এখন আমরা ১০ মিনিটের মধ্যে পৌঁছতে পারব, যা একসময় আমাদের কল্পনার বাইরে ছিল।’
মিরপুর-১০ এর বাসিন্দা বেসরকারী চাকুরিজীবি সাজ্জাদ হোসেন জানান, শহরের যানজটের কারণে তার বাসা থেকে দৈনিক বাংলা মোড়ের কাছে অবস্থিত তার অফিসে যেতে বেশ ঝামেলা পোহাতে হতো। কিন্তু মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল সার্ভিস চালু হওয়ায় দ্রুত ও নিরাপদে তার অফিসে পৌঁছাতে তার জন্য খুবই সহায়ক হবে। তিনি যত দ্রুত সম্ভব মেট্রো রেলের কার্যক্রম সন্ধ্যা পর্যন্ত বাড়ানোর দাবি জানান, কারণ বর্তমানে এই পরিষেবা পাওয়া যাবে সকাল সাড়ে ৭টা থেকে সকাল সাড়ে ১১টা পর্যন্ত । হোসেন বলেন, ‘এখন আমরা শুধু মেট্রো রেলে অফিসে যেতে পারি, কিন্তু বাসায় ফেরার সময় এই সেবা পাওয়া যায় না। তাই, কর্তৃপক্ষের উচিত দ্রুত সময়সীমা বাড়ানো।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী এবং মিরপুর এলাকার বাসিন্দা অনিন্দিতা বোস বলেন, যানজট তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর অনেক প্রভাব ফেলে, কারণ তিনি প্রতিদিন ক্লাস করতে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছতে যানজটে ক্লান্ত হয়ে পড়েন এবং পাশাপাশি এটি তার পড়াশুনার উপরও প্রভাব ফেলে। তিনি বলেন, ‘আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে আমার ক্লাসে যোগ দিতে গড়ে ২ ঘণ্টা দরকার হতো, কিন্তু এখন থেকে আমি ১৫ মিনিটের মধ্যে পৌঁছতে পারব। নিরাপদে ও দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য এটি সত্যিই একটি যাদুকরী যোগাযোগের মাধ্যম।’
শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে ২০.১ কিলোমিটার এমআরটি লাইন-৬-এর দ্বিতীয় ধাপের উদ্বোধন করায় মেট্রো রেলের ৮.৭২ কিলোমিটার আগারগাঁও-মতিঝিল অংশের উদ্বোধনের জন্য ঢাকাবাসী বিশেষ করে মিরপুর ও মতিঝিল এলাকার দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটে। বাসস’র সাথে আলাপকালে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নূরী বলেন, ডিসেম্বরের মধ্যে এমআরটি লাইন-৬-এর সব স্টেশন খুলে দেওয়া হবে এবং দ্রুততম সময়ে পর্যায়ক্রমে পরিষেবার সময় বাড়ানো হবে, যদিও প্রাথমিকভাবে মেট্রো উত্তরা-মতিঝিল রুটে সকাল সাড়ে ৭টা থেকে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত চলবে। তিনি বলেন, একবার পরিষেবা সম্পূর্ণরূপে চালু হলে ট্রেনের ব্যবধান তিন মিনিট পর্যন্ত কমিয়ে দেওয়া হবে। একক পাস সংগ্রহের জন্য স্টেশনে দীর্ঘ লাইন এড়াতে তিনি ঢাকাবাসীকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্ধারিত স্টেশন ও ব্যাংকের বুথ থেকে দ্রুত পাস সংগ্রহ করার আহ্বান জানান।
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন সিদ্দিক বলেন, প্রতিটি ট্রেন ২,৩০০ জন যাত্রী নিয়ে ১০০ থেকে ১১০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারে। তবে বাঁকযুক্ত এলাকায় গতি কম হবে বলেও জানান তিনি।
মেট্রো রেল প্রতি ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী এবং প্রতিদিন পাঁচ লক্ষ যাত্রী বহন করতে সক্ষম হবে এবং প্রতি চার মিনিটে একটি ট্রেন প্রতিটি স্টেশনে পৌঁছাবে। প্রধানমন্ত্রী শনিবার এমআরটি লাইন-৫ (উত্তর রুট) নির্মাণ কাজেরও উদ্বোধন করেন, যা হেমায়েতপুর থেকে ভাটারা হয়ে গাবতলী, মিরপুর-১০, গুলশান পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার লাইন হবে। ৪১,২৩৯ কোটি টাকার এই প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়সীমা হল ২০২৮ সাল। এর আগে গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশ পর্যন্ত দেশের প্রথম মেট্রো রেল সার্ভিসের প্রথম ধাপের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী।
জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) মেট্রোরেল নির্মাণ করছে এবং প্রকল্পে ঋণ দিচ্ছে। জাইকা প্রকল্পের জন্য ১৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা দিয়েছে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর রাজধানীর ওপর চাপ কমাতে নানা উদ্যোগ নেয় আওয়ামী লীগ সরকার।