রামপাল ও মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্রর জমি আধিগ্রহণে দুর্নীতির অভিযোগ

রামপাল ও মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্রর জমি অধিগ্রহণ ও পরিবেশ সমীক্ষায় দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছে বাংলাদেশ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। অভিযোগে বলা হয়েছে, জমি অধিগ্রহণের পাওনা টাকা নিতে গিয়ে ১০ ভাগ করে ঘুষ দিতে হয়েছে। যারা প্রভাবশালী তাদেরকে বাজার দরের চেয়ে বেশি এবং যারা দরিদ্র তাদেরকে কম মূল্যে দেয়া হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন এই দুর্নীতির সাথে জড়িত।
টিআইবি গবেষণা প্রতিবেদনে এই তথ্য দেয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার টিআইবি কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে গবেষণা প্রতিবেদক উপস্থাপন করা হয়। প্রতিবেদনটি তৈরী করেছেন মোহাম্মদ হোসেন ও মো. রবিউল ইসলাম। এসময় টিআইবি ট্রাস্ট্রি বোর্ডের চেয়ারম্যান সুলতানা কামাল, নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপ নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং রিসার্চ এ্যান্ড পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রশাসনের যোগসাজশে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহল সিন্ডিকেট করে ব্যাপক সুবিধা নিয়েছে। ক্ষতিপূরণ দিতে প্রশাসনের একটি শ্রেণী সরাসরি দুর্নীতির সাথে জড়িত। ফলে নিয়মবহির্ভূত টাকা দেয়ার বিষয়টি স্বীকৃত বলে বিবেচিত হয়েছে। আইন সীমাবদ্ধতা, পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষার নির্দিষ্ট আইন অনুসরণ না করার কারণে এই পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে।
গবেষনা প্রতিবেদনে বলা হয়, জমি অধিগ্রহণের পর ক্ষতিপুরণের টাকা পেতে সাধারণ মানুষদেরকে নানাভাবে হয়রানি করা হয়েছে। যারা টাকা পাওয়ার আগে ঘুষ দিতে পারেনি তাদের টাকা পেতে দেরি হয়েছে। রামপালের জন্য জমি অধিগ্রহণ করতে যথাযথ প্রক্রিয়া মানা হয়নি। নোটিশ দেয়ার আগেই জমি দখল করা হয়েছে। মাতারবাড়ি প্রকল্পে ক্ষতিপূরন না দিয়েই জমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। প্রকল্প বাতিলের জন্য হাইকোর্টে একাধিক রিট নিষ্পত্তি না করেই জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে।
অভিযোগে বলা হয়, মাতারবাড়ি প্রকল্পে চিংড়ি ঘেরের ক্ষতিপূরণে অতিমূল্যায়ন করা হয়েছে। সবগুলো ঘেরের ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে সবগুলোতে চাষ হয় না।  পরিত্যাক্ত লবন মিলের বিপরীতে আট কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে।

পরিবেশ বিষয়ে জানানো হয়, মাতারবাড়ির পরিবেশ বিষয়ে সমীক্ষা করেছে জাপানি প্রতিষ্ঠান। রামপালেও পিডিবি ও এনটিপিসি’র পক্ষে বিভিন্ন কারিগরি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যা নিরপেক্ষতার মানদন্ডে প্রশুবিদ্ধ। এজন্য নতুন করে নিরপেক্ষভাবে পরিবেশ সমীক্ষা করানোর দাবি জানানো হয়। বলা হয়, পরিবেশ অধিদপ্তর নিয়মবর্হিভূতভাবে পরিবেশ ছাড়পত্র দিয়েছে। রামপাল বিষয়ে বনবিভাগের মতামত নেয়া হয়নি। রামপালে পরিবেশ পর্যালোচনার আগেই নিয়ম ভেঙ্গে মাটি ভরাট করা হয়েছে। অভিযোগ করে বলা হয়, প্রকল্পের বিরোধীতা না করার জন্য রাজনৈতিক নেতারা স্থানীয়দের হুমকি দিয়েছে।
অভিযোগ করে বলা হয়েছে, জাপান সরকার জলবায়ু তহবিল থেকে মাতারবাড়ি প্রকল্পের জন্য ঋণ দিয়েছে। এই টাকা অনুদান হিসেবে দেয়ার কথা। কিন্তু অনুদান হিসেবে না দিয়ে ঋণ দেয়া হচ্ছে। এটা প্রতারণা। জলবায়ু তহবিল থেকেই জাপান বাংলাদেশকে ঋণ দিচ্ছে বিষয়টি নিশ্চিত কিনা জানতে চাইলে ইখতেখারুজ্জামান বলেন, সংশ্লিষ্ট বিশ্বস্ত সূত্র এটি নিশ্চিত করেছে। তবে বিশেষ কোন প্রমান তাদের কাছে নেই বলে তিনি জানান।

সাংবাদিক সম্মেলনে সুলতানা কামাল বলেন, রামপাল নিয়ে যে পরিবেশগত সমীক্ষা করা হয়েছে তা বিজ্ঞান সম্মত নয়। স্থানীয়রা নিজেদের মতামতে একাজ করছে না। প্রধানমন্ত্রী যা বলেন তারা তাই করেন। প্রধানমন্ত্রীর বাক্যকে বেদ বাক্য মনে করেন। ইফতেখারুজ্জামান বলেন, মাতারবাড়ি ও রামপালের বিষয়ে জবাবদীহি ও স্বচ্ছ হতে হবে। প্রভাবশালীরা বেশি ক্ষতিপূরণ নিয়েছে। এতে আর্থ সামাজিকভাবে অন্যরা দরিদ্র হচ্ছে।

গবেষনা প্রতিবেদনে ১২টি সুপারিশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশ থেকে পর্যায়ক্রমে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করে দিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিদ্যুৎ ব্যবহারের সুপারিশ করা হয়। বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশ ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। এজন্য জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে নিজেদেরই উদ্যোগী হতে হবে। কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রর বিকল্কপ্প হিসেবে সৌর বা বায়ু বিদ্যুৎ ব্যবহার সম্ভব কিনা জানতে চাইলে বলা হয়, এটি কারিগরি বিষয়। এটি সম্ভব কিনা জানা নেই। বলা হয়েছে, রামপাল ও মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্রর জন্য নতুন করে নিরপেক্ষ সমীক্ষা করাতে হবে। জমির মালিকদের ক্ষতিপুরণ নতুন করে নির্ধারণ করতে হবে। ক্ষতিপুরণের বিষয়টি জনসম্মুখে প্রকাশ করতে হবে। জমি অধিগ্রহণে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করে দোষীদের শাস্তি দিতে হবে। পরিবেশ সংরক্ষণ বিধি অনুযায়ি উপযুক্ত স্থানে শিল্প স্থাপন করতে হবে। কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রর অংশীদারিত্ব ঋণ চুক্তি জনসম্মুখে প্রকাশ করতে হবে। প্রকল্পের লাভ দিয়ে প্রকল্প এলাকা উন্নয়নে খরচ করতে হবে। জমি হারানো ব্যক্তিদের জন্য স্থায়ী অর্থ সংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।