রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিলের দাবি বিএনপির
সুন্দরবনের কাছে রামপাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগকে গণবিরোধী, ক্ষমতাসীনদের দায়িত্বজ্ঞানহীন কর্মকাণ্ড আখ্যায়িত করে প্রকল্পটি বাতিল করার জোর দাবি জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। একইসঙ্গে তিনি এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে দলমত নির্বিশেষে জনগণকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান।
বুধবার বিকেলে গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই দাবি জানান। লিখিত বক্তব্যে বিএনপি চেয়ারপার্সন রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ হলে সেখানকার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের যেসব ক্ষতি হতে পারে তার বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেন।
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পকে দেশবিরোধী আখ্যায়িত করে খালেদা জিয়া বলেন, সুন্দবনের কাছে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন একটি দেশবিরোধী ও গণবিরোধী সিদ্ধান্ত। জনমত উপেক্ষা করে দেশ ও জনগণের স্বার্থবিরোধী এই সিদ্ধান্ত জনগণের ওপর জবরদস্তিমূলকভাবে চাপিয়ে দিচ্ছে সরকার। কাজেই সুন্দরবনকে নিশ্চিত ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়ার হঠকারী, অযৌক্তিক, অলাভজনক রামপালের সব কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল করার জন্য আমরা সরকারের প্রতি জোর দাবি জানাচ্ছি। তবে রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রতিবাদে কোনো ধরনের কর্মসূচির ঘোষণা দেননি খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, যে প্রকল্প দেশের দক্ষিণাঞ্চলের প্রাকৃতিক বেষ্টনী ধ্বংস করবে, জীববৈচিত্র্যের বিলোপ ঘটাবে, লাখ লাখ মানুষের জীবন ও জীবিকা ধ্বংসের কারণ হবে, পরিবেশ ও পানি দূষিত করবে, আশপাশের কৃষি জমির উর্বরা শক্তি এবং মৎস্যসম্পদ ধ্বংস করবে এবং সর্বোপরি যে প্রকল্প অর্থনৈতিকভাবে অলাভজনক তা বাস্তবায়নে সরকারের যুক্তিহীন জেদ ও দ্রুততা শুধু সন্দেহজনক নয়, দেশবাসীর জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয়।
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কঠোর বিরোধিতা করে তিনি বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠন ও মানবতাবাদী মানুষ প্রতিনিয়ত রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন। বিশেষজ্ঞরাও একই ধরনের কথা বলছেন। দেশের ভেতরেও মানুষ এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে সোচ্চার। কিন্তু সরকার জনমতকে উপেক্ষা করে অনৈতিক সুবিধা নেয়ার জন্য রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দিয়েছে। এমনকি জনগণের আন্দোলনকে বল প্রয়োগের মাধ্যমে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে, যা এই দেশের বিবেকবান মানুষ কোনো দিন মেনে নেবে না।
সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্ন না করার আহ্বান জানিয়ে গণমাধ্যমের উদ্দেশে খালেদা জিয়া বলেন, এই বিষয়টা আমাদের সবার। এটা শুধু বিএনপি, আওয়ামী লীগ অথবা অন্য কারো বিষয় নয়, এটা সারাদেশের বিষয়। সেজন্য আজকে কোনো প্রশ্ন না করে রামপালের বিষয়টি আপনারা দেশবাসীর কাছে তুলে ধরুন। এটা আমার অনুরোধ।
দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার জন্য বিদ্যুৎ প্রয়োজন উল্লেখ করে বিএনপি চেয়ারপার্সন বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সরকারকে বিকল্প ভাবনারও পরামর্শ দেন। তিনি অবিলম্বে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবন এলাকা থেকে সরিয়ে নেয়ার দাবি জানান।
বিএনপি চেয়ারপার্সন বলেন, এ কেন্দ্র হলে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হবে এবং পরিবেশ নষ্ট হবে, পানি দূষিত হবে। বনাঞ্চলের পশুপাখির জীবনচক্র ক্ষতির মধ্যে পড়বে। জনগণের চাহিদা মেটানোর জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন সময়ের দাবি। কিন্তু সে উদ্যোগ বাস্তবায়নে জনস্বার্থ বা জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। তিনি বিকল্প বিদ্যুৎ ও বিকল্প জ্বালানির সন্ধান করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আমরা মনে করি বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনেক বিকল্প আছে। বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জায়গারও অনেক বিকল্পও আছে। কিন্তু সুন্দরবনে কোনো বিকল্প নেই।
খালেদা জিয়া বলেন, বিভিন্ন নদ নদীতে বাঁধের ফলে এমনিতেই একদিকে পদ্মা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রে পানি প্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে গেছে। এর ফলে দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে ব্যাপক মরুকরণ শুরু হয়েছে। এখন দক্ষিণাঞ্চলে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হলে সুন্দরবন ধ্বংস হলে বাংলাদেশ আর বাসযোগ্য থাকবে না। সুন্দরবনের এত কাছে স্থাপিত কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রভাব অনিবার্য অশুভ ও মারাত্মক ক্ষতিকর। সব প্রমাণ উপস্থাপনের পরও সরকার তার অবস্থান পরিবর্তনে শুধু অস্বীকৃতি জানাচ্ছে না, বরং আরো দ্রুত এ গণবিরোধী ও দেশবিরোধী প্রকল্প বাস্তবায়নে উদ্যোগী হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হলো, এ সরকার স্বৈরাচারী বলেই জনমত বা দেশের স্বার্থ পরোয়া করে না।
খালেদা জিয়া বলেন, ভারতের ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কর্পোরেশন (এনটিপিসি) নামের যে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যৌথভাবে রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হচ্ছে সেই একই প্রতিষ্ঠান ভারতের মধ্য প্রদেশের নরসিংহপুর জেলায় ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লা-বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের যে প্রস্তাব দিয়েছিল, ভারত সরকার তা বাতিল করে দিয়েছে। ভারতের সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের (সিএসই) এক গবেষণায় রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব প্রাপ্ত এনটিপিসি নামের প্রতিষ্ঠানটিকে ভারতের সব চেয়ে দূষণকারী প্রতিষ্ঠান বলে চিহ্নিত করেছে। যারা তাদের নিজের দেশে যা করতে পারে না শুধু ব্যবসায়িক স্বার্থে তা বাংলাদেশে করছে। রামপাল বিদ্যুৎকন্দ্র নির্মাণে অর্থায়ন না করতে ভারতীয় এক্সিম ব্যাংককে ১৪৯টি সামাজিক ও পরিবেশবাদী সংগঠন যৌথ বিবৃতি দিয়েছে বলেও জানান খালেদা জিয়া।
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, তরিকুল ইসলাম, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান ও আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী ছাড়াও ২০ দলীয় জোটের শরিক বিজেপির আন্দালিব রহমান পার্থ, কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, জাগপার শফিউল আলম প্রধান, জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দার, এলডিপির রেদোয়ান আহমেদ, এনডিপির খোন্দকার গোলাম মূর্তজা, এনপিপির ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, লেবার পার্টির মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, ন্যাপ ভাসানীর আজহারুল ইসলাম, ইসলামী ঐক্যজোটের মাওলানা আবদুল করিম খান, খেলাফত মজলিসের আহমেদ আবদুল কাদের, ন্যাপের গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়া, ইসলামিক পার্টির আবুল কাশেম, মুসলিম লীগের জুলফিকার বুলবুল চৌধুরী, পিপলস লীগের সৈয়দ মাহবুব হোসেন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মুফতি মহিউদ্দিন ইকরাম, সাম্যবাদী দলের সাঈদ আহমেদ, ডিএল-এর সাইফুদ্দিন মনি প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।