রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র: মালিকানা দুই দেশের ঋণের দায় বাংলাদেশের
বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ উদ্যোগে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। এ জন্য ভারতের এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট (এক্সিম) ব্যাংক থেকে ১৬০ কোটি ডলার ঋণ নিতে হচ্ছে। এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৫০ শতাংশ করে মালিকানা দুই দেশের হলেও ঋণের পুরোটা দায়ভার থাকবে বাংলাদেশের ওপর।
ব্যাংকিংয়ের ভাষায় বাংলাদেশ সরকার দেবে এ ঋণের ‘গ্যারান্টি’, অর্থাৎ জামিনদার হবে। এর মানে হলো, লোকসান হলে বা কোনো কারণে মাঝপথে প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেলে কিংবা কিস্তির অর্থ দিতে ব্যর্থ হলে ঋণ পরিশোধের দায়িত্ব বাংলাদেশের ওপর বর্তাবে। বাংলাদেশকে এ ঋণের জামিনদার হওয়ার শর্ত দিয়েছে এক্সিম ব্যাংক। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
২০০ কোটি ডলার ব্যয়ে রামপাল কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এটি বাংলাদেশের অন্যতম অগ্রাধিকার প্রকল্প। বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফপিসিএল) বা বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী বিদ্যুৎ কোম্পানি এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। কোম্পানির ৫০ শতাংশ করে মালিক বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (পিডিবি) এবং ভারতের ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার কোম্পানি (এনটিপিসি) লিমিটেড।
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ভারতের এক্সিম ব্যাংকের কাছ থেকে ১৬০ কোটি ডলার ঋণ নিতে যাচ্ছে বিআইএফপিসিএল। এক্সিম ব্যাংকের দেওয়া চুক্তির শর্তাবলি জানিয়ে প্রয়োজনীয় অনুমোদনের জন্য বিদ্যুৎ বিভাগের সচিবের কাছে সম্প্রতি চিঠি দিয়েছেন বিআইএফপিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক উজ্জ্বল কান্তি ভট্টাচার্য। চিঠিতে বাংলাদেশের পুরো ঋণের জামিনদার হওয়ার শর্তটিও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আগামী অক্টোবর মাসে এ ঋণচুক্তি হতে পারে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব আনু মুহাম্মদ বলেন, সুন্দরবনের ক্ষতি হবে বলে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ উঠেছে। এখন কোনো কারণে যদি এ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ মাঝপথে বন্ধ হয়ে যায় কিংবা কোম্পানি লোকসানি হয়, তবে এক্সিম ব্যাংকের ঋণের দায় পুরোটাই বাংলাদেশ সরকারের ওপর পড়বে। বাংলাদেশকেই ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, প্রকল্পের এ ধরনের ঝুঁকি আঁচ করতে পেরেই যৌথ মালিকানার কোম্পানি হলেও এক্সিম ব্যাংক ঋণের দায় বাংলাদেশের ওপর চাপিয়েছে। তারা (এক্সিম ব্যাংক) হয়তো মনে করছে, এ প্রকল্প শেষ পর্যন্ত সফল না-ও হতে পারে।
আনু মুহাম্মদ মনে করেন, এ প্রকল্প থেকে শুধু মুনাফার অর্ধেকই ভারতীয় কর্তৃপক্ষ পাবে না; ঠিকাদারি কাজ, কয়লার সরবরাহ ব্যবসা—সবই পাবে। সেখানেও ভারত লাভবান হবে।
শর্তে যা আছে: এক্সিম ব্যাংকের দেওয়া শর্ত অনুযায়ী, ১৬০ কোটি ডলারের ঋণ পরিশোধ করতে হবে ২০ বছরে। সাত বছর পর থেকে ঋণের নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে। ২৭টি অর্ধবার্ষিক কিস্তিতে এক্সিম ব্যাংককে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। ঋণের সুদের হার হবে লন্ডন আন্তব্যাংক হারের (লাইবর) সঙ্গে ১ শতাংশ সুদ যোগ করে। গত জুন মাসের হিসাবে লাইবর দশমিক ৯৩ শতাংশ।
এ ছাড়া ঋণের অব্যবহৃত বা ছাড় না করা অর্থের ওপর বার্ষিক দশমিক ৫ শতাংশ হারে সুদ দিতে হবে। ঋণ প্রক্রিয়াকরণের জন্য ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের পরামর্শক মাশুল ২ লাখ ডলারও দিতে হবে বিআইএফপিসিএলকে।
চুক্তির জামিনদার সম্পর্কে জানতে চাইলে উজ্জ্বল কান্তি ভট্টাচার্য বলেন, বাংলাদেশের স্বার্থেই প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছে। উৎপাদিত বিদ্যুৎ বাংলাদেশই পাবে। তাই এ ঋণের জামিনদার বাংলাদেশ সরকার।
বাগেরহাটের রামপাল উপজেলায় বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সুপার থারমাল পাওয়ার প্রজেক্টটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এটি রামপাল কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র হিসেবে বেশি পরিচিত। ২০১৯ সালের মধ্যে কেন্দ্রটির বিদ্যুৎ উৎপাদনে যাওয়ার কথা রয়েছে। কেন্দ্রটির বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট। গত ১২ জুলাই ঢাকায় মূল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ভারত হেভি ইলেকট্রিক্যাল লিমিটেডের (ভেল) সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে বিআইএফপিসিএল। মূল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি তৈরি করতে খরচ হবে প্রায় ১৫০ কোটি ডলার। এরপর সবচেয়ে বেশি খরচ হবে ওই এলাকায় টাউনশিপ বা ছোট শহর নির্মাণে। এতে ১০ কোটি ডলার খরচ হবে।
এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিদ্যুতের দাম হবে উৎপাদন খরচের সঙ্গে কিছুটা মুনাফা যোগ করে। এর মানে হলো, বিদ্যুতের দামে কোনো ভর্তুকি দেওয়া হবে না। বিদ্যুৎ কিনবে পিডিবি।
ঋণের জামিনদার বাংলাদেশ—এ শর্তের কারণে চুক্তিটি কিছুটা ভারসাম্যহীন বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, যেহেতু দুই দেশের ৫০ শতাংশ করে মালিকানা আছে। তাই ঋণের গ্যারান্টিও আনুপাতিকভাবে হওয়া উচিত। ব্যবসা-বাণিজ্যে এটাই সবচেয়ে ভালো চর্চা। বাংলাদেশের ওপর পুরো ঋণের দায়ভার হলে চুক্তিটি কিছুটা ভারসাম্যহীন হবে। তবে তিনি এ-ও মনে করেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রটির অবস্থান বাংলাদেশে হওয়ায় এ দেশের আইনকানুন অনুযায়ী পরিচালিত হওয়ার কথা। কোম্পানির ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনায় বাংলাদেশের বেশি নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত। বাংলাদেশ তা কতটা পারবে, সেটাই দেখার বিষয়।
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণস্থল ও পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ নিয়ে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো তীব্র আপত্তি করে আসছে। তারা এ প্রকল্পটিকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের ধ্বংসকারী হিসেবে অভিহিত করে প্রকল্প অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার দাবি জানাচ্ছে। কেন্দ্রটির নির্মাণস্থল সুন্দরবনের উত্তর-পশ্চিমাংশ থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে।