রামপাল বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ও সুন্দরবনের ভবিষ্যৎ
১১ মার্চ ঢাকা থেকে রামপালের উদ্দেশে ‘তেল-গ্যাস-বন্দর রক্ষা কমিটির’ পদযাত্রা শুরু হয়েছে। এটা শেষ হচ্ছে ১৩ মার্চ। তাদের এই পদযাত্রা এবারই প্রথম নয়। আগেও হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে সাম্রাজ্যবাদের জ্বালানি লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে সংগঠনটি প্রাথমিকভাবে গঠিত হলেও তার কর্মপরিধি পরে বিস্তৃত হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে দেশে পরিবেশের প্রতি যে ঔদাসীন্য, এমনকি বৈরিতা সরকারের পক্ষ থেকে দেখানো হয়েছে, তার বিরুদ্ধে বড় আন্দোলন ফুলবাড়িয়ায় ব্রিটিশ কোম্পানি এশিয়া এনার্জির বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পকে কেন্দ্র করে হয়েছে। সেই আন্দোলনে অন্যরা শরিক হলেও মূল ভূমিকা ছিল এই কমিটির। রামপালে ভারতীয় কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে ব্যবস্থা সরকার করেছে, তাতে এদেশের পরিবেশ নিশ্চিতভাবে বিধ্বস্ত হবে। এর বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক মহল, পরিবেশ রক্ষা সম্পর্কিত সংগঠন, আওয়ামী ঘরানার বাইরে অবস্থিত বুদ্ধিজীবী মহল প্রথম থেকে সোচ্চার হয়েছে। কিন্তু এসব বিরোধিতাকে পরোয়া না করে এবং রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প যেভাবে পরিবেশ ধ্বংস করবে তার প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে ভারতের সঙ্গে ‘মৈত্রী বন্ধনে’ আবদ্ধ বাংলাদেশ সরকার এই প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে চলেছে।
এ বিষয়ে অনেক লেখালেখিও হয়েছে। ১১ মার্চ, ২০১৬ তারিখে ডেইলি স্টার পত্রিকায় মোশাইদা সুলতানা নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের এক অধ্যাপকের একটি প্রবন্ধ তেল-গ্যাস-বন্দর রক্ষা কমিটির রামপাল পদযাত্রাকে সামনে রেখেই প্রকাশিত হয়েছে। এতে পূর্ববর্তী অনেক লেখার মতো কিছুটা বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রটি স্থাপিত হলে সুন্দরবন কীভাবে ও কতখানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
২০১১ সালে বাংলাদেশের সংবিধানে একটি সংশোধনী আনা হয়। তাতে দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষার বিষয়ে নির্দেশনা অন্তর্ভুক্ত হয়। মনে হয় এর ভিত্তিতেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘Champions of the Earth’ পুরস্কার দেয়া হয়! এরপর শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের সব কাজের লক্ষ্য হল বন্যা, সাইক্লোন থেকে মানুষের জীবন রক্ষার জন্য পরিবেশ পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলা যাতে দ্রুত নগরায়ণ এবং ক্ষতিকর শিল্পায়নের থেকে সৃষ্ট দূষণের থেকে পরিবেশকে রক্ষা করা যায়।’ ২০১৪ সালে Global Tiger Stocktaking সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী সুন্দরবনের বাঘ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, ‘বঙ্গোপসাগরে সাইক্লোন এবং অন্য বিপদ থেকে দক্ষিণ সমুদ্রকূলবর্তী অঞ্চলকে রক্ষার ক্ষেত্রে সুন্দরবন হল এক প্রাকৃতিক রক্ষক।’ কিন্তু এসব কথা সত্ত্বেও তিনি রামপালে ভারতীয় কোম্পানির সঙ্গে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের চুক্তির মাধ্যমে সুন্দরবন ধ্বংসের নিশ্চিত শর্ত তৈরি করেছেন। ভারতের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য Bangladesh India Friendship Power Company Ltd.-এর সঙ্গে এই চুক্তির ভিত্তিতে তারা ১৮৩৪ একর জমি বরাদ্দ করেছেন! তাছাড়া সরকারের আরও পরিকল্পনা আছে প্লান্টটির উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে ২৬৪০ মেগাওয়াটে নেয়ার!! শুধু তাই নয়, তারা সেখানে Orion কোম্পানির সঙ্গে ৫৬৫ মেগাওয়াটের অন্য একটি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনেরও চুক্তি করেছেন এবং তার জন্য ২০০ একর জমিও ইতিমধ্যে বরাদ্দ করা হয়েছে!!! এর থেকেই বোঝা যায়, প্রধানমন্ত্রীর উপরোক্ত বক্তব্য সত্ত্বেও, এমনকি তার এই বক্তব্য দেয়ার আগেই, তারা কিভাবে সুন্দরবন ধ্বংস করার ব্যবস্থা পাকাপাকি করেছেন। তারা এ কাজ করেছেন ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের Chief Conservetor কর্তৃক সরকারকে দেয়া চিঠিতে একথা বলার পর যে, খুলনার সুন্দরবন এলাকায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করা হলে তার দ্বারা সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য সুন্দরবনের রামপাল এলাকায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য তারা মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেন। এসব সত্ত্বেও ২০১৩ সালে রামপাল বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জোর দিয়ে বলেন, এই বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের দ্বারা সুন্দরবন এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার জনগণের জীবন কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না! (ডেইলি স্টার, ১১.০৩.২০১৬)। এসব দ্বারা প্রমাণিত হয়, গায়ের জোরের কাছে তথ্য, যুক্তি, দেশের স্বার্থ ইত্যাদির কোনো মূল্য নেই। দেশের যতই ক্ষতি হোক, সরকারি সিদ্ধান্তই সঠিক!! তাদের অর্থমন্ত্রীও একই সুরে গান গেয়ে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনকে সমর্থন করেন। না করে উপায় কী?
এই চুক্তির ভিত্তিতে ভারত থেকে রামপাল বিদ্যুৎ উৎপাদনে কেন্দ্রটির জন্য নিয়মিত কয়লা আমদানি করা হবে এবং সেটা নিয়ে আসা হবে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে। এর ফলে সুন্দরবনের গাছপালা থেকে বাঘ, হরিণ, পাখি সব ধরনের প্রাণী ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাছাড়া এই কেন্দ্র থেকে যে ধোঁয়া বের হবে, তার দ্বারা যে সুন্দরবনের স্বাভাবিক পরিবেশ অসম্ভব রকম দূষিত হবে এতেও সন্দেহ নেই। এ বিষয়ে অনেক কিছু লেখা যায়, কিন্তু তার কোনো বিশদ বিবরণের প্রয়োজন এখানে নেই। এটা বলাই যথেষ্ট যে, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রটি চালু হলে অনেক দিক দিয়েই সুন্দরবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে এবং বাঘসহ সেখানকার সমগ্র প্রাণীকুল বিলুপ্ত হবে, রাতারাতি একদিনে নয়, কয়েক বছর ধরে। এছাড়া প্লান্টটি থেকে বর্জ্য পদার্থ পশুর নদীতে পতিত হয়ে নদীটির পানি বিষাক্ত করবে এবং তা কিছুদিনের মধ্যেই পরিণত হবে মৃত নদীতে, যেখানে মাছসহ সব জলজ প্রাণীরই অস্তিত্ব বলে কিছু থাকবে না। পার্শ্ববর্তী পরিবেশও দূষিত হবে।
কিন্তু শুধু এটাই নয়। প্লান্টটি স্থাপিত হলে বাগেরহাটের প্রায় সমগ্র এলাকায় জনজীবন বিপর্যস্ত হবে। এর পার্শ্ববর্তী বিশাল এলাকায় জমির মূল্য বৃদ্ধি পাবে, আশপাশে আরও শিল্প-কারখানা স্থাপিত হয়ে বিপুল আকারে কার্বন ডাই-অক্সাইড চারদিকে ছড়িয়ে সমগ্র অঞ্চলের পরিবেশ নষ্ট করবে এবং সেই সঙ্গে সুন্দরবন ধ্বংসের প্রক্রিয়া আরও ত্বরান্বিত হবে। এসবই হবে বাংলাদেশের স্বার্থে নয়, পুরোপুরিভাবে ভারতের স্বার্থে।
বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রটি দেশের অন্য কোনো জায়গায় স্থাপন না করে ভারতের কয়লার কাছাকাছি অঞ্চলে নিয়ে আসার উদ্দেশ্যে যেভাবে সুন্দরবন ও বাংলাদেশের এই উপকূলবর্তী অঞ্চলকে বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে সরকার এ কাজ করছে তার মধ্যেই ভারত-বাংলাদেশ ‘মৈত্রীর’ চরিত্র ভালোভাবেই বোঝা যায়। এ ‘মৈত্রীর’ সুফল বর্তাচ্ছে শুধু ভারতের কাছে। এতে বাংলাদেশের ষোলো আনা ক্ষতি ছাড়া কোনো লাভ নেই। এর থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশের সম্পর্ক ভারতের সঙ্গে কতখানি অধীনতামূলক। বাংলাদেশ এই অধীনতামূলক সম্পর্কের কারণে একতরফাভাবে ভারতকে করিডর দেয়াসহ সব রকম সুবিধা দিয়েই চলেছে। ভারত বাংলাদেশকে তিস্তার পানির ন্যায্য অংশ দেয়ার ব্যাপারে আজ পর্যন্ত আশ্বাস দেয়া ছাড়া আর কিছু না করলেও বাংলাদেশ ভারতকে ঢালাওভাবে করিডর দিয়েছে। এই করিডর দিয়ে ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এখন যাত্রী থেকে সব রকম মালামাল নিয়ে যাচ্ছে। এতে তাদের পরিবহন ব্যয় যে প্রভূতভাবে কমেছে তাই নয়, সময়ের দিক দিয়েও অনেক সুবিধা হয়েছে। তাছাড়া যে মালামাল তারা নিয়ে যাচ্ছে তাতে সাধারণ বাণিজ্যিক সামগ্রী ছাড়া সামরিক সাজসরঞ্জাম পাচার হলেও তাদের ধরার কোনো ব্যবস্থা নেই। সামরিক সরঞ্জাম এভাবে তারা নিতে পারবে না, তাদের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তিতে এই মর্মেও কিছু নেই। এ ব্যাপারে তাদের ষোলো আনা সুবিধা দেয়ার ব্যবস্থাই হয়েছে। এসবই করছে এমন এক সরকার, যারা নিজেকে দেশপ্রেমিক, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের একমাত্র রক্ষাকারী, মুক্তিযুদ্ধের ধারক-বাহক ইত্যাদি দাবি করে সব ধরনের বিরোধী শক্তিকে ফ্যাসিস্ট কায়দায় দমন করতে নিযুক্ত আছে।
১২.০৩.২০১৬
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল