রাশিয়া থেকে তেল কেনার ‘উপায় খোঁজার নির্দেশ’ প্রধানমন্ত্রীর
বিডিনিউজ:
রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল কীভাবে আমদানি করা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘তার উপায় খুঁজে বের করার নির্দেশ দিয়েছেন’ বলে জানিয়েছে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।
তিনি জানান, মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশনা আসে।
রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে একনেক পরবর্তী সংবাদ সম্মেলন পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, “বৈঠকে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভারত যদি রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করতে পারে, তাহলে আমরা কেন পারব না?”
রাশিয়ার কাছ থেকে তেল আমদানি করা গেলে বিনিময় মুদ্রা কী হবে তা নিয়ে, সে বিষয়েও একটি সমাধান খুঁজে বের করতে প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানান মান্নান।
তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, রাশিয়া থেকে তেল আমদানির জন্য রুবলের সঙ্গে টাকা বিনিময় মুদ্রা হিসেবে ভাবা হচ্ছে। রুবলের সঙ্গে টাকা বিনিময়ের মাধ্যমে এটা করা যেতে পারে।”
পরে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, “বৈঠকে আলোচনা হয়েছে যে রাশিয়া বলেছে, টাকা দিয়েও তেল কেনা যাবে। তবে তারা রুবলেই বেশি চায়। কারণ টাকাতো তাদের বেশি দরকার নাই। আবার আমাদেরও বেশি রুবল থাকবে না।
“আবার রুবল আমাদের কাছে যদি বেশি জমে যায়, তাহলে আমরা কীভাবে দেব। বিষয়টি আমরা এভাবে চিন্তা করছি, হয়ত শূন্য সুদে ঋণ আকারেও এটা নিতে পারি, এটাও হতে পারে। বিষয়টি আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের ব্যাপার।”
বিষয়টি কীভাবে সমাধান করা যায়, তার উপায় খুঁজে বের করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করছে বলে জানান প্রতিমন্ত্রী।
তিনি বলেন, চলমান পরিস্থিতিতে দেশের আমদানি রপ্তানি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভসহ সকল কিছু কীভাবে সমন্বয় করা হবে- সেসব বিষয় নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
“এক্ষেত্রে চীন- ভারতসহ আমাদের সঙ্গে আমদানি রপ্তানিকারী দেশগুলোর সঙ্গে আমদানি রপ্তানির মূল্য পরিশোধ সোয়াপ করতে হবে। এটা কীভাবে করা যায় তা খুঁজে বের করার উপায় খুঁজতে বলা হয়েছে।”
প্রতিমন্ত্রী বলেন, “ভারতে আমরা যে রপ্তানি করি আমদানি করি তার তিনগুণের বেশি। কিন্তু ডলার না হলে এটা রুপিতে পরিশোধ করতে হবে। ভারত যেহেতু আমাদের কাছে তিনগুণ রপ্তানি করে তাহলে আমরা কীভাবে এত রুপি পরিশোধ করব?
“এমন পরিস্থিতিতে কী করা যেতে পারে, সেই আলোচনায় আমদানি পরিশোধে ৫ বছরের একটা সময় নিয়ে করা যায় কিনা, তা বের করার বিষয়েও আলোচনা হয়েছে বলে জানান প্রতিমন্ত্রী।
যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের পরে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী দেশ রাশিয়া আগে প্রতিদিন প্রায় ৫ মিলিয়ন ব্যারেল অপরিশোধিত তেল রপ্তানি করত, যার অর্ধেকের বেশি যেত ইউরোপে।
গত ফেব্রুয়ারিতে রুশ বাহিনী ইউক্রেইনে আগ্রাসন শুরু করলে যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের ইউরোপীয় মিত্ররা একের পর এক অবরোধ আরোপ শুরু করে রাশিয়ার ওপর।
এক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার তেলের ওপরও নিষেধাজ্ঞা দেয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নও জ্বালানির জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনার ঘোষণা দেয়।
নিষেধাজ্ঞার মুখে অন্য ক্রেতারা রুশ তেল কেনা থেকে পিছু হটলেও বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ তেল আমদানিকারক ও ভোক্তা দেশ ভারত সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ব্যাপক মূল্য ছাড়ে তাৎক্ষণিক টেন্ডারের মাধ্যমে রাশিয়া থেকে বাড়তি তেল কেনা শুরু করে। চীনও আবার রাশিয়া থেকে তেল কেনা বাড়িয়েছে বলে খবর এসেছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে।
এমনিতে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার তেল কিনতে অন্য দেশের বাধা নেই। তবে ইউক্রেইন যুদ্ধ নিয়ে কূটনৈতিক টানাপড়েনের মধ্যে রাশিয়া থেকে ভারতের অতরিক্ত তেল কেনার বিষয়টি যে যুক্তরাষ্ট্র ভালোভাবে নেয়নি, তা স্পষ্ট করেই বলেছে ওয়াশিংটন।
রাশিয়ার পণ্য কেনার ক্ষেত্রে দাম পরিশোধ নিয়েও জটিলতা রয়েছে। সুইফটে নিষেধাজ্ঞার কারণে ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলারে দাম পরিশোধ সম্ভব না। আর রাশিয়াও অনেক দেশের ক্ষেত্রে রুবলে দাম পরিশোধের শর্ত দিচ্ছে
যুদ্ধ শুরুর পর পর বিশ্ববাজারে অপরিশোধিতি জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলে ১৩০ ডলার ছাড়িয়ে গেলেও এখন তা কিছুটা কমে এসেছে। কিন্তু তেল আমদানির খরচ বেড়ে যাওয়ায় ভর্তুকি কমাতে আর ডলার বাঁচাতে সরকার অগাস্টের শুরুতে জ্বালানি তেলের দাম ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে, যার প্রভাবে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে গেছে অনেকটা।
তেল বাঁচাতে সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনও কমিয়ে দিয়েছে, পরিস্থিতি সামাল দিতে রুটি করে সব এলাকায় লোড শেডিং করতে হচ্ছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গত মে মাসে জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছে রশিয়া।
তবে রাশিয়ার তেল বাংলাদেশের রিফাইনারিতে ‘পরিশোধনযোগ্য নয়’ জানিয়ে ওই প্রস্তাব এড়িয়ে যাওয়ার ইংগিত সে সময় দিয়েছিলেন তিনি।
‘সেপ্টেম্বর থেকে লোডশেডিং থাকবে না’
পরিকল্পনা মন্ত্রী ব্রিফিংয়ে বলেন, “বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়নের পর এখন লোডশেডিং হবে এটা তিনি চান না। তিনি (প্রধানমন্ত্রী) বলেছেন, ‘আশা করি সেপ্টেম্বর মাস থেকে দেশে লোড শেডিং থাকবে না’।”
কৃষিকাজে ব্যবহৃত সেচের পাম্প চালাতে জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুতের বদলে প্রধানমন্ত্রী সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের ওপর জোর দিয়েছেন বলে জানান এম এ মান্নান।
তিনি বলেন, “বর্তমানে কিছু পাম্প সোলার দিয়ে চলছে। ক্রমান্বয়ে বাকিগুলোও নিতে হবে।”
জ্বালানি তেলের দাম নিয়েও বৈঠকে কথা হয়েছে জানিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর বলেছেন, জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে নিম্ম আয়ের মানুষের বেশি কষ্ট হচ্ছে। কীভাবে এটি সমন্বয় করা যায় সেটা দেখা হচ্ছে।
“বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য কমে এলে দেশেও তা সমন্বয় করা হবে। এখন বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমলেও তার প্রভাব দেশের বাজার পড়বে না। কারণ এখন দেশে আসছে দুই মাস আগে কেনা তেল। এই তেল ১৪৪ ডলারে কেনা। তাই এখন বিশ্ববাজারে দাম কমার সুফল দেশের বাজারে দিতে প্রায় দেড় থেকে দুই মাস সময় লাগবে।
সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতি ‘নজরদারির মধ্যে’ রাখা হয়েছে মন্তব্য করে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, “প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমাদের ব্যয় সংকোচন সাবধানতার জন্য যেসব কৌশল নেওয়া হয়েছে সেই কৌশলগুলো কাজে দিয়েছে। আমরা ব্যয় সংকোচন নয়, সাবধানে ব্যয় করেছি। এর মানে এই নয় যে প্রয়োজনীয় ব্যয় বন্ধ থাকবে।”
“বিশেষ করে স্পর্শকাতর বিষয়- যেমন চাল, জ্বালানি তেল এগুলো আমরা খুবই দায়িত্বশীল অবস্থান থেকে ওয়াচডগ বা নজরদারির মধ্যে রেখেছি। সরকার যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে, তাতে আগামী ছয় মাসের মধ্যে দেশের অর্থনীতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।”