রুদ্ধশ্বাস ২৩ ঘন্টা: ক্ষমা কর জিহাদ
২৩ ঘণ্টা পর রাজধানীর শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনির মৈত্রী সংঘ মাঠের কাছে রেলওয়ের পানির পাম্পের পাইপের মধ্যে থেকে শিশু জিহাদকে উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধারের সময় সে অচেতন অবস্থায় ছিল। তবে সে জীবিত না মৃত, তা জানা যায়নি।
আজ শনিবার বেলা তিনটার দিকে শিশুটিকে উদ্ধার করা হয়। এর কিছুক্ষণ আগে ফায়ার সার্ভিস উদ্ধারকাজ স্থগিত ঘোষণা করে। সকাল থেকে পাইপের ভেতর শিশুটির পড়ে যাওয়া ও তার অবস্থান নিয়ে সংশয় বাড়তে থাকে। পরে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক (ডিজি) বিগ্রেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ খান সাংবাদিকদের জানান, ২৮০ ফুট গভীরে ক্যামেরা দিয়ে তল্লাশি চালানো হয়। সেখানে শক্ত স্তর থাকায় ক্যামেরা আর নামানো যায়নি বলে দাবি করে ফায়ার সার্ভিস। শিশুটির অস্তিত্ব না পাওয়ায় উদ্ধারকাজ স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নেয় ফায়ার সার্ভিস। তবে ওই স্তরের নিচে শিশুটি রয়েছে কি না, তা নিয়ে তারা সন্দেহ প্রকাশ করে।
ফায়ার সার্ভিসের ডিজি আলী আহমেদ খান জানান, ক্যামেরায় পাওয়া ছবিতে শিশুটির কোনো অস্তিত্ব মেলেনি। তার পরও শিশুটির পরিবারের আকুতি ও স্থানীয়দের কথা বিবেচনা করে ফায়ার সার্ভিস উদ্ধারকাজ চালিয়ে যায়। পাইপের ২৮০ ফুট গভীরে ক্যামেরা যায়। এর পরের স্তর ভেঙে আর ক্যামেরা নামানো যায়নি। ক্যাচার (খাঁচা দিয়ে তৈরি বিশেষ ধরনের রড) দিয়েও ওই স্তর ভাঙা যায়নি। ফায়ার সার্ভিস কূপটি রেলওয়ের কাছে হস্তান্তর করে দেবে বলে জানায়। তাদের প্রয়োজনে তারা সহযোগিতা করবে বলেও জানায়।
ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক (ডিএডি) আবদুল হালিম বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সাংবাদিকদের জানান, তাঁরা পাইপের ২৪৫ ফুট গভীর পর্যন্ত ক্যামেরা দিয়ে তল্লাশি চালিয়েছেন। সেখানে ভিকটিমের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। শিশুটি না থাকার সম্ভাবনাই বেশি। উদ্ধারকাজে পুলিশের মেকানিক্যাল টিমের একজন এসেছেন বলে তিনি দাবি করেন। তাঁর দাবি, দেশীয় প্রযুক্তি দিয়ে অনেকে উদ্ধারকাজ চালাতে চাইছেন। ফায়ার সার্ভিস তাঁদের সহায়তা করছে।
সকালে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন) মেজর শাকিল নেওয়াজ জানান, তাঁরা এখন পাইপের ভেতরে ময়লা পরিষ্কার করে ভেতরে কিছু আছে কি না, তা খুঁজে দেখার চেষ্টা করছেন। তাঁর ভাষ্য, পাইপের ভেতরে আবার দুই ইঞ্চি পাইপ ছিল। সেখান থেকে কিছু খুঁজে বের করা খুব কষ্টসাধ্য। সব ধরনের চেষ্টাই করা হচ্ছে। যতক্ষণ পর্যন্ত সম্ভব অভিযান চলবে। নতুন আরেকটি যন্ত্রও ভেতরে ঢোকানো হচ্ছে বলে তিনি জানান।
শিশু জিহাদের বাড়ি ওই পানির পাম্পের পাশেই। এ/৪০ নম্বরের ওই বাড়ির দোতলায় সাবলেটে থাকে তারা। জিহাদরা তিন ভাইবোন। বড় মেয়ে স্বর্ণা (১৩), মেজো ছেলে ঈশান (৬) ও সবচেয়ে ছোট জিহাদ (৪)। প্রথম আলোকে দেওয়া মা খাদিজা আক্তারের ভাষ্য, গতকাল দুপুরে ভাত খেয়ে দুই পাশে দুই ছেলেকে নিয়ে তিনি ঘুমিয়েছিলেন। ঘরের দরজা খোলা ছিল। বিকেলে ঘুম থেকে উঠে দেখেন জিহাদ পাশে নেই। ছেলের শোকে বারবার জ্ঞান হারাচ্ছেন তিনি।
রেলওয়ের ওই পানির পাম্পের পাইপের পাশে আরেক জায়গায় গর্ত খুঁড়ে পানির পাইপ বসানোর কাজ চলছে। বেলা ১১টার দিকে প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে সাড়ে ১১টার দিকে ঘটনাস্থলের পাশের বাড়ির বাসিন্দা ফাতেমা নামে এক কিশোরী জানায়, সে ব্যাডমিন্টন খেলছিল। খেলার একপর্যায়ে কর্ক পানির পাম্পের পাইপের পাশে পড়ে যায়। আনতে গেলে সে পাইপের ভেতরে কী যেন পড়ার শব্দ শোনে। সে শুনতে পেয়েছে, ‘বাঁচাও মা’। মতিঝিলে পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) আনোয়ার হোসেনের ভাষ্য, জিহাদের বাবা নাসির উদ্দিনকে নিরাপত্তার স্বার্থে পুলিশের হেফাজতে রাখা হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন) মেজর শাকিল নেওয়াজ বলেন, চার বছরের শিশু জিহাদ পড়ে যাওয়ার ঘটনার কোনো প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া যায়নি। ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেওয়ার আগেই সেখানে উৎসুক মানুষের ভিড় জমে। শিশুটিকে উদ্ধারের জন্য তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ কাঠ, দড়ি নানা জিনিস ফেলেন।
রাতভর রুদ্ধশ্বাস অভিযান
পাইপটি কতটা গভীর জানতে চাইলে শাকিল নেওয়াজ বলেন, এখন পর্যন্ত তাঁরা সঠিক গভীরতা জানেন না। পাইপটির গভীরতার ব্যাপারে ওয়াসাও কোনো সঠিক তথ্য দিতে পারেনি। ঘটনার পর আশপাশে থাকা ওয়াসার পাম্পের কর্মকর্তাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে তিনি দাবি করেন। তবে তাঁদের ক্যামেরার কেব্ল ৩০০ ফুট গভীর পর্যন্ত গিয়েছিল। এর মধ্যে কোনো কিছুর সন্ধান পাওয়া যায়নি।
গতকাল শুক্রবার বিকেল চারটার দিকে জিহাদের গভীর পাইপে পড়ে যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ে। খেলতে গিয়ে সে ওই পাইপে পড়ে যায়। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে শুরু হয় শিশুটিকে উদ্ধারের তৎপরতা। এরপর প্রায় রাতভর চলে এই অভিযান।
সন্ধ্যা ছয়টার দিকে উদ্ধারকারী দলের একজন জানান, শিশুটি পাইপের ভেতর থেকে সাড়া দিচ্ছে। তার জন্য পাঠানো হয় খাবার ও পানি। পাইপের মধ্যে দেওয়া হয় অক্সিজেন। এরপর থেকে উদ্ধার তৎপরতা নিয়ে পাওয়া যায় একের পর এক বিভ্রান্তিকর তথ্য। রাত পৌনে তিনটার দিকে গর্তে পাঠানো ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ দেখে পাইপের মধ্যে আদৌ কোনো শিশু পড়েছে কি না, এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন উদ্ধারকর্মীরা। কেউ কেউ বলতে থাকেন, এটি গুজব। তবে অভিযান চলতে থাকে।
রাজনৈতিক উত্তাপসহ সব আলোচনা ছাপিয়ে প্রধান হয়ে ওঠে এ ঘটনা। দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে উৎকণ্ঠা। ঘটনাস্থলের আশপাশে জড়ো হওয়া শত শত মানুষ প্রার্থনা করতে থাকে শিশুটির জন্য।
রেলওয়ে পাম্প থেকে প্রায় ১০০ গজ দূরে রেলওয়ে কলোনির একটি বাড়ির দোতলার একটি কক্ষে পরিবারের সঙ্গে থাকে জিহাদ। তার বাবা নাসির উদ্দিন মতিঝিলের একটি বিদ্যালয়ের নিরাপত্তাকর্মী। দুই ভাই, এক বোনের মধ্যে জিহাদ সবার ছোট।
খবর: প্রথম আলোর সৌজন্যে