রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনায় ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হতে যাচ্ছে

রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনায় রাশিয়ার সঙ্গে এবার যুক্ত হচ্ছে ভারত। চলতি মাসেই একটি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হতে পারে। এজন্য ১৯ নভেম্বর রাশিয়া যাচ্ছে বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধিদল। এই চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশকে পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে রাশিয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের সহায়তা দেবে ভারত।
এ বিষয়ে বিজ্ঞানমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান বলেন, এ বিষয়ে বাংলাদেশ, রাশিয়া ও ভারতের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি সই হবে। এ চুক্তি করতে ১৯ নভেম্বর রাশিয়া যাবে বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধিদল। সেখানে এ বিষয়ে তিন দেশের মধ্যে আলোচনা হবে। আলোচনা ফলপ্রসু হলে চুক্তি সই হতে পারে। তিনি জানান, এই প্রকল্প বাস্তবায়নে আমরা ভারতের কাছ থেকেও সহযোগিতা নেব, রাশিয়ার কাছ থেকেও সহযোগিতা নেব। কোন দেশের কাছ থেকে কিভাবে কতটুকু সহায়তা নেয়া হবে, সে বিষয়ে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হবে। মন্ত্রী বলেন, পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বাংলাদেশের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। কিন্তু ভারতের আছে। এ ক্ষেত্রে তারা আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে। তাই তাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে চাই। রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে রাশিয়া থেকে বাংলাদেশে যেসব যন্ত্রাংশ আসবে সেগুলো যাচাই করা বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো বিশেষজ্ঞ নেই। ভারত এই কাজটিই করবে। পাশাপাশি কিছু কিছু যন্ত্রাংশ ভারতেও তৈরি করা হবে। সেগুলোরও দেখভাল করবে তারা।
বিজ্ঞান মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গত সেপ্টেম্বর মাসে ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারকের একটি খসড়া বাংলাদেশকে পাঠিয়েছে ভারত। ‘রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য ভারত-রাশিয়া-বাংলাদেশ সহযোগিতা সমঝোতা স্মারক’ শিরোনামের চুক্তির খসড়া বাংলাদেশ এখন যাচাই বাছাই করছে। এই সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে প্রকল্পের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ সব ধরনের সহযোগিতা করতে চায় ভারত।
সমঝোতা স্মারকের খসড়ার ২ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎকেন্দ্র নিরাপদভাবে পরিচালনা এবং নিরাপত্তার ক্ষেত্রসহ কর্মীদের দক্ষতা উন্নয়ন ও সক্ষমতা বাড়াতে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বিনিময়, পরামর্শক সেবা, কারিগরি সহায়তা, সম্পদ ও অভিজ্ঞতা বিনিময় করা হবে। এতে আরো বলা হয়েছে, পক্ষগুলো রেডিওঅ্যাকটিভ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পরিশোধনসহ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, পরিচালন, নিয়ন্ত্রণ, মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে পরামর্শক, কারিগরি ও সক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করবে। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণে অভিজ্ঞতা বিনিময় করবে তারা।
পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়ন ও কেন্দ্র পরিচালনায় আইনিভাবে কারিগরি সহায়তা বিনিময় করবে পক্ষগুলো। এ ছাড়া এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের উপকরণ, যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ সরবরাহ করাসহ তিন পক্ষ লিখিতভাবে একমত হয়ে অন্য যেকোনো বিষয়ে সহযোগিতা করতে পারবে।
খসড়ায় বলা হয়েছে, ২ নম্বর অনুচ্ছেদে উল্লিখিত ক্ষেত্রগুলোতে সহযোগিতার বিষয়ে তিন দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো সক্ষমতা বাড়াতে কর্মশালা, প্রশিক্ষণের আয়োজন করবে। এ ক্ষেত্রে পক্ষগুলো পরামর্শক সেবা ও কারিগরি সহায়তার ক্ষেত্রও প্রস্তুত করবে। দেশগুলো বিশেষজ্ঞ, বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী ও শিক্ষাবিদদের সফর বিনিময় করবে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের চাহিদা মোতাবেক অনুমোদিত কর্তৃপক্ষ বিশেষজ্ঞ মোতায়েনের বিষয়ে মনোনয়ন দেবে। পক্ষগুলো পারমাণবিক ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাষ্ট্র্রি ও এর ব্যবহারের তথ্য বিনিময় করবে।
দেশগুলোর জাতীয় পারমানবিক নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষগুলোর মধ্যে অভিজ্ঞতা বিনিময় করাসহ তিন দেশের সম্মতিতে অন্য যেকোনো ধরনের সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হবে।
খসড়ার ১ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, এমওইউর আওতায় বাংলাদেশের অনুরোধ ও প্রয়োজন অনুযায়ী রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প-ইউনিট ১ ও ২ সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে সব পক্ষ যৌথভাবে সহযোগিতা করবে। এই এমওইউর কোনো
কিছুই তিন দেশের অভ্যন্তরীণ আইন ও নীতি এবং আন্তর্জাতিক কোনো চুক্তি, কনভেনশনসহ দ্বিপক্ষীয় কোনো চুক্তি বা আইএইএর (ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি) সঙ্গে পক্ষগুলোর সেফগার্ড চুক্তিকে প্রভাবিত করবে না।
খসড়ার ৬ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, এই সমঝোতা ১৫ বছরের জন্য বলবৎ থাকবে। তবে এই মেয়াদকালের মধ্যেও ছয় মাসের আগাম নোটিশ দিয়ে যেকোনো পক্ষ তা বাতিল করতে পারবে। আর মেয়াদ শেষে সমঝোতা স্মারকটি নবায়ন করা হবে কি না সে বিষয়ে এটি কার্যকর হওয়ার ১৪ বছরের মাথায় অর্থাৎ মেয়াদ শেষ হওয়ার এক বছর আগে থেকে তিন পক্ষ পরস্পরের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
খসড়ায় বলা হয়, রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সই করা চুক্তি ভারতের সঙ্গে এই এমওইউ স্বাক্ষরে কোনো বাধা সৃষ্টি করবে না। এ বিষয়ে বলা হয়, টেকসই, পরিবেশগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার মধ্য দিয়ে উন্নয়নশীল দেশে উন্নিত হতে পারমানবিক বিদ্যুতের শান্তিপূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি। তিনটি দেশই আইএইএর সদস্য। পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ব্যবস্থাপনাসহ বেসামরিক উন্নয়নে পারমানবিক শক্তি ব্যবস্থাপনায় ভারতের তাৎপর্যপূর্ণ অভিজ্ঞতা রয়েছে। বিশেষ করে রাশিয়ার ডিজাইন করা রিঅ্যাক্টর পরিচালনার ক্ষেত্রেও ভারতের বিস্তর অভিজ্ঞতা রয়েছে। সুগঠিত আইনগত কাঠামো,
উন্নত পারমানবিক ম্যানুফ্যাকচারিং খাত এবং বিপুল দক্ষ জনশক্তির ওপর ভর করে ভারত পারমানবিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অনেক অগ্রসর হয়েছে। ২০১১ সালের ২ নভেম্বর বাংলাদেশ ও রাশিয়ার সরকারের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির আওতায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকাজ চলছে।
শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পারমানবিক শক্তি ব্যবহারের বিষয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের একটি প্রস্তাবে বাংলাদেশ ও ভারত একমত হয়েছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ভারত বাংলাদেশিদের বেসামরিক পারমানবিক শক্তি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এ ছাড়া তৃতীয় কোনো দেশে রাশিয়ার ডিজাইন করা পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা জোরদার করার বিষয়ে ভারত-রাশিয়া ২০১৪ সালের ১১ ডিসেম্বর কৌশলগত লক্ষ্য নির্ধারণ করা আছে, যার আওতায় রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে ভারতের সহযোগিতা করার সুযোগ রয়েছে।
তাই রাশিয়া ও ভারতের অভিজ্ঞতার সম্মিলন ঘটিয়ে বাংলাদেশের রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দ্রুত উন্নয়ন সম্ভব। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, খসড়া সব কিছু নাও ঠিক থাকতে পারে। মন্ত্রণালয় যাচাই বাছাই করছে। এছাড়া রাশিয়া ও ভারতেরও মতামত নেয়া হবে। চুক্তি সাক্ষরিত হওয়ার আগে পর্যন্ত খসড়া পরিবর্তন হতে পারে। এ কেন্দ্র স্থাপনে ১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হবে। এরমধ্যে রাশিয়া থেকে ১১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ হিসেবে নেবে বাংলাদেশ। কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট ২০২৩ সালের অক্টোবরে উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে। অন্যদিকে এর এক বছর পর দ্বিতীয় ইউনিট ২০২৪ অক্টোবরে উৎপাদনে আসবে। কেন্দ্রটি ৫০ বছর ধরে বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। রাশিয়া ও ভারতের সহযোগিতায় কেন্দ্রটি পরিচালনা করবে নিউক্লিয়ার পাওয়ার কোম্পানি বাংলাদেশ।