রেকর্ড বিদ্যুৎ উৎপাদনেও ভোগান্তি
চলতি জুনে দেশে সর্বোচ্চ বিদ্যুত্ উত্পাদনের রেকর্ড দুবার ভাঙ্গা হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুত্ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। গত ৯ই এপ্রিলের আট হাজার ১৭৭ মেগাওয়াট উত্পাদন রেকর্ড ভঙ্গ করে গত ৫ই জুন উত্পাদিত আট হাজার ৪৮২ মেগাওয়াট বিদ্যুত্। এর ১০ দিন পরেই গত ১৫ জুন আগের রেকর্ড ভঙ্গ করে সর্বোচ্চ আট হাজার ৭৭৬ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদিত হয়।িদিনে দিনে রেকর্ড চ্ছ্।ে তবু সমস্যা কাটছে না।
সংশ্লিষ।টরা জানিয়েছেন, সর্বোচ্চ উৎপাদন হলেও তা দিনে রাতের অল্প কিছু সময়ের জন্য। এজন্য স্র্োচ্চ বা রেকর্ড পরিমান উৎপাদন করেও ভোগাুন্ত কমছে না।
দেশের বিদ্যুত্ পরিস্থিতি নিয়ে সরকার একদিকে বিদ্যুত্ উত্পাদনের রেকর্ড ও লোডশেডিং না থাকার বিবৃতি দিচ্ছে, অন্যদিকে বাস্তব পরিস্থিতি বলছে ভিন্ন কথা। রাজধানীসহ সারাদেশে বিদ্যুতের লোডশেডিং ও বিভ্রাট বেড়েছে। তীব্র গরম ও রোজার মধ্যে বিদ্যুত্ না পেয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। কোথাও ঘন্টায় ঘন্টায় বিদ্যুতের আসা-যাওয়া আবার কোথাও টানা চার-পাঁচ ঘন্টার লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে জনগণ। চাহিদানুযায়ী বিদ্যুত্ না থাকায় শিল্প উত্পাদনও ব্যাহত হচ্ছে। ফলে একদিকে পণ্যের উত্পাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে অন্যদিকে ঈদ কেন্দ্রিক বিভিন্ন পণ্যের বিপুল চাহিদার বিপরীতে জোগান দেয়াও ব্যবসায়ীদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ছে।
বিদ্যুত্, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশে বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি ১০৪টি বিদ্যুেকন্দ্রের উত্পাদন ক্ষমতা ১২ হাজার ৩৩৯ মেগাওয়াট। কেন্দ্রগুলোর প্রকৃত ক্ষমতা ১১ হাজার ৭৪৪ মেগাওয়াট বিদ্যুত্। কিন্তু কারিগরি ত্রুটি, গ্যাস সংকট, বিদ্যুতের উত্পাদন মূল্য সমন্বয় এবং উত্পাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে গড়ে সাড়ে আট হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুত্ উত্পাদন করা যাচ্ছে না। অন্যদিকে গরম ও বর্ষা মৌসুমের পাশাপাশি রমজানের কারণে চাহিদা আরও বেড়ে গেছে। তাই লোডশেডিংও বেড়ে গেছে।
সূত্র জানায়, সম্প্রতি বিপুল পরিমাণ ট্রান্সফরমার একসাথে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় বিদ্যুত্ বিভ্রাট বেড়েছে। শুধু গত মে মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঁচ হাজার ৩৭৯টি ট্রান্সফরমার পুড়ে গেছে। ১৭টি পুরনো সরকারি বিদ্যুেকন্দ্রে প্রতি ইউনিট (কিলোওয়াট/ঘণ্টা) বিদ্যুতের উত্পাদন খরচ পড়ছে ৩০ থেকে ৪০ টাকা। এক হাজার ৮৭২ মেগাওয়াট ক্ষমতার এ কেন্দ্রগুলোর উত্পাদন ক্ষমতাও কমে গেছে তিন গুণ। এ কেন্দ্রগুলোতে তাই উত্পাদন কমিয়ে দেয়া হয়েছে। গ্যাসভিত্তিক বেসরকারি বিদ্যুেকন্দ্রগুলোতেও উত্পাদন কমিয়ে দেয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে জ্বালানি সংকট, বিদ্যুতের উত্পাদন মূল্য সাধারণের সামর্থ্যের মধ্যে রাখার চ্যালেঞ্জ এবং সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থায় দুর্বলতার কারণে চাহিদানুযায়ী বিদ্যুত্ সরবরাহ করতে ব্যর্থ হচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। বিদ্যুতের বড় প্রকল্পগুলোও সময়মত বাস্তবায়িত না হওয়ায় সংকট দূর করা যাচ্ছে না। চলতি বছরের বার্ষিক উন্নয়ন বরাদ্দের (এডিপি) প্রায় ৪০ শতাংশ প্রকল্পের বাস্তবায়ন করতে পারেনি বিদ্যুত্ বিভাগ। অনেকগুলো প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ থাকলেও কাজই শুরু করা যায়নি।
লোডশেডিং পরিস্থিতি
গত তিন-চার বছরে বিদ্যুতের দাম কয়েক গুণ বাড়লেও অন্তত শহরাঞ্চলে বিদ্যুতের সরবরাহ বেশ ভালো থাকায় নাগরিক জীবনে স্বস্তি ছিল। কিন্তু এখন ফের সেই পুরনো দুর্ভোগ ফিরে এসেছে। শহরে কিছুটা কম হলেও গ্রামে লোডশেডিং বহুগুণে বেড়ে গেছে। পিডিবির হিসাব মতে, গত মঙ্গলবার দেশে আট হাজার ১৮৬ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদার বিপরীতে লোডশেডিং হয় ১৮৯ মেগাওয়াট। এর মধ্যে খুলনা অঞ্চলে ১০১, কুমিল্লায় ৭৪ এবং বরিশালে ১৪ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়। ওই দিন ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, সিলেট ও রংপুর অঞ্চলে কোনো লোডশেডিং হয়নি বলে পিডিবির দৈনিক উত্পাদন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এ অঞ্চলের স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, ওই দিন একাধিকবার লোডশেডিং হয়েছে।
পিডিবির তথ্য অনুযায়ী, চলতি জুনের ১লা তারিখে ১৯৬ মেগাওয়াট, ২রা জুন ১৪৮ মেগাওয়াট, ৩রা জুন ১৮১ মেগাওয়াট, ৪ঠা জুন ২৯২ মেগাওয়াট, ৬ই জুন ২১০ মেগাওয়াট, ৮ই জুন ১২৬ মেগাওয়াট, ১৮ই জুন ১০৬ মেগাওয়াট এবং ২০শে জুন ১০৯ মেগাওয়াট বিদ্যুতের লোডশেডিং হয়। মাসের অন্য দিনগুলোতে কোনো লোডশেডিং হয়নি। কিন্তু ঢাকা, গাজীপুর, বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, সিলেট, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রংপুর, দিনাজপুর, কুমিল্লা, চাঁদপুর, নোয়াখালী, খুলনা, বাগেরহাটসহ বিভিন্ন জেলাা থেকে খবর পাওয়া গেছে, চলতি মাসের প্রতিদিনই জেলাগুলোর বিভিন্ন জায়গায় কমবেশি লোডশেডিং হয়েছে। কোথাও টানা চার-পাঁচ ঘণ্টাও বিদ্যুত্ ছিল না। আবার অনেক স্থানে ঘণ্টায় তিন-চার বার বিদ্যুত্ আসা-যাওয়া করেছে। বিদ্যুত্ বিতরণকারী সংস্থা ঢাকা বিদু্যৎ বিতরণ কোম্পানি (ডিপিডিসি), ঢাকা বিদ্যুত্ সরবরাহ কোম্পানি (ডেসকো), পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) এবং পিডিবির একাধিক সূত্রও জানায়, বিদ্যুতের চাহিদা ও সরবরাহের ঘাটতির ব্যবধান সরকারিভাবে উল্লিখিত তথ্যের চেয়ে বেশি। কর্তৃপক্ষ কাগজে কলমে ঘাটতি কম দেখাচ্ছে। এর আগে গত এপ্রিলে নৌ শ্রমিকদের ধর্মঘট এবং গত মে মাসে ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর আঘাতের পূর্বাপর সময়েও তীব্র লোডশেডিংয়ের শিকার হন জনগণ।
সঞ্চালনে দুর্বলতা ও ত্রুটি
পিডিবি ও পিজিসিবি সূত্রে জানা যায়, দেশে অনেক এলাকায় সক্ষমতার বেশি বিদ্যুত্ সংযোগ দেওয়া হয়েছে। এতে হঠাত্ কোনো কোনো এলাকায় বিদ্যুতের চাহিদা ধারণার চেয়ে বেড়ে যায়। এ বাড়তি চাহিদা তৈরি হওয়াকেই ওভারলোড বলা হয়। এ সময় বিদ্যুত্ সরবরাহ বন্ধ করে না দিলে বিতরণ ব্যবস্থায় বিপর্যয় দেখা দেয়। পিক আওয়ারে (সর্বোচ্চ চাহিদার সময়) ওভারলোডেড ফিডারগুলোয় একাধিকবার বিদ্যুত্ সরবরাহ বন্ধ রাখতে বাধ্য হয় বিতরণ কোম্পানিগুলো। এতে বেড়ে যায় লোডশেডিং।
দেশে বর্তমানে ২৮ হাজার ৮১টি ট্রান্সফরমার ওভারলোডেড অবস্থায় রয়েছে। এগুলোর সরবরাহ ক্ষমতা প্রায় ৯ লাখ ২২ হাজার কিলো ভোল্ট। এর মধ্যে শুধু মে মাসেই পুড়ে গেছে ৫ হাজার ৩৭৯টি। এতে প্রায় ৬০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। বিদ্যুত্ সঞ্চালনের বাড়তি চাপ ও নিম্নমানের কারণে এ ট্রান্সফরমারগুলো পুড়ে গেছে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুত্ উত্পাদনের সক্ষমতা ঠিক কতটুকু তা অস্পষ্ট রেখেছে সরকার। লোডশেডিংয়ের জন্য সঞ্চালন ব্যবস্থাকে দায়ী করে যে বক্তব্য সরকারের কর্তাব্যক্তিরা দিচ্ছেন তার সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তবতার মিল নেই।
এ প্রসঙ্গে পিডিবির চেয়ারম্যান মো. শামসুল হাসান মিয়া বলেন, বিতরণে রেশনিং করে লোডশেডিং কমানো ও নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে। সার কারখানাগুলো বন্ধ করে আবাসিক ও বাণিজ্যিক খাতে বিদ্যুত্ সরবরাহ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, গ্যাস সংকটের কারণে প্রায় দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদন করা যাচ্ছে না। সঞ্চালন ব্যবস্থায় কিছু দুর্বলতাও লোডশেডিং সমস্যা তৈরি করছে। তবে তেলভিত্তিক বেশ কয়েকটি কেন্দ্র দ্রুত চালু করার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে বড় প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে এ সমস্যা থাকবে না।