লোকসানে রেকর্ড পিডিবি: এক বছরে ১১ হাজার ৫০৯ কোটি টাকা
নিজস্ব প্রতিবেদক:
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) রেকর্ড পরিমান লোকসান হয়েছে। অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙে ২০২০-২১ অর্থবছর সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকার বেশি লোকসান দিয়েছে পিডিবি।
উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে বিক্রির কারণে এই লোকসান বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ঠরা। বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া, সিস্টেম লসসহ নানা কারণে এই লোকসান হয়েছে।
ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের মাধ্যমে লোকসান কিছুটা কমানো যেত বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
তবে পিডিবি মনে করছে, গ্যাস সংকট থাকায় তেল চালিত বা বেশি খরচের কেন্দ্র চালাতে হয়েছে। এজন্য খরচ বাড়ছে। এর বিকল্প ছিল না।ু
এক বছরের ব্যবধানে ২০২০-২১ অর্থবছর ৫৫ শতাংশ লোকসান বেড়েছে। তবে ঘাটতির চেয়ে ভর্তুকি কিছুটা বেশি হওয়ায় উদ্বৃত্বপত্রে (ব্যালেন্স শিট) লোকসানের পরিবর্তে মুনাফা দেখাচ্ছে পিডিবি।
গত অর্থবছর পিডিবির লোকসান হয়েছে ১১ হাজার ৫০৯ কোটি ১২ লাখ টাকা। এর আগের ২০১৯-২০ অর্থবছর লোকসান ছিল সাত হাজার ৪৪৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। এক বছরে বেড়েছে চার হাজার ৬০ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। এর আগে ২০১৭-১৮ অর্থবছর লোকসানের পরিমাণ ছিল ৯ হাজার ৩১০ কোটি ১৫ লাখ টাকা।
পিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. বেলায়েত হোসেন বলেন, গ্যাসের সরবরাহ কমায় তরল জ্বালানিভিত্তিক কেন্দ্রগুলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে হয়েছে। সবচেয়ে খরচ যে জ্বালানিতে তা দিয়ে বাধ্য হয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হয়েছে। ফলে লোকসান বেড়ে গেছে।
লোকসান মেটাতে গত অর্থবছর রেকর্ড পরিমাণ, ১১ হাজার ৭৭৭ কোটি ৯১ লাখ টাকা ভর্তুকি দেয়া হয়েছে। আগে ২০১৯-২০ অর্থবছর ভর্তুকি দেয়া হয়েছিল সাত হাজার ৪৩৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। এক বছরে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি বাড়ে চার হাজার ৩৩৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকা বা ৫৮ দশমিক ৩১ শতাংশ।
লোকসানের চেয়ে গত অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি কিছুটা বেশি ছিল। এতে উদ্বৃত্বপত্রে লোকসানের পরিবর্তে ২৬৮ কোটি ৭৯ লাখ টাকা মুনাফা দেখিয়েছে পিডিবি।
পিডিবি জানায়, আন্তর্জাতিক বাজারে ফার্নেস অয়েলের দাম বেড়ে প্রতি মেট্রিক টন ৫৩০-৫৫০ ডলার হয়েছে, যা ২০২০ সালের মে মাসে ছিল ৩৪০-৩৬০ ডলার। আর ২০২০ সালের জুনে ফার্নেস অয়েল আমদানিতে শুল্ক-কর অব্যাহতি প্রত্যাহার করায় এ খাতে ৩৪ শতাংশ খরচ বেড়েছে। যার পরিমাণ বছরে ৩৫০-৪০০ কোটি টাকা। যদিও জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম স্থিতিশীল থাকায় এ খাতে খরচ তেমন বাড়েনি।
পিডিবি সূত্র জানায়, গ্যাসভিত্তিক আইপিপি ও ভাড়ায় আনা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় ২০২০ সালের মে মাসে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৬৮ শতাংশ। আর তরল জ্বালানিভিত্তিক কেন্দ্র থেকে হয়েছে ৩২ শতাংশ। তবে গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ায় চলতি বছর মে মাসে গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোয় উৎপাদনের পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে ৪৩ শতাংশ, তরল জ্বালানিতে ৪৫ শতাংশ, কয়লায় ১১ শতাংশ এবং সৌর বিদ্যুৎ থেকে এক শতাংশ। এতে গত বছরের মে মাসের তুলনায় চলতি বছর মে মাসে ঘাটতি বেড়েছে ৫৭ শতাংশ।
বাংলাদেশ ও চীন যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত পায়রার এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি উৎপাদনে এলেও সঞ্চালন লাইন না হওয়ায় সম্পূর্ণ বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে নেয়া যাচ্ছে না। বিদ্যুৎ না নেয়া গেলেও ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে। এতে ঘাটতি হয়েছে ১৭০-১৮০ কোটি টাকা।
২০১০-১১ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত এক দশকে ৭৫ হাজার ১৪২ কোটি ৪২ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে পিডিবি’র। এর মধ্যে ২০১০-১১ অর্থবছর লোকসান ছিল চার হাজার ৬২০ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। পরের অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ছয় হাজার ৬৯৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। তবে ২০১২-১৩ অর্থবছর তা কিছুটা কমে দাঁড়ায় পাঁচ হাজার ৪৩ কোটি ৮৪ লাখ টাকায়।
আবার ২০১৩-১৪ অর্থবছর লোকসান বেড়ে হয় ছয় হাজার ৮০৯ কোটি ২৫ লাখ টাকা এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছর সাত হাজার ২৮২ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আবার কমে হয় তিন হাজার ৮৭৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে চার হাজার ৪৩৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছর পিডিবির লোকসান বেড়ে হয় ৯ হাজার ৩১০ কোটি ১৫ লাখ টাকা।
পরের দুই অর্থবছর লোকসান কিছুটা কমে। এর মধ্যে ২০১৮-১৯ অর্থবছর আট হাজার ১৪১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা এবং ২০১৯-২০ অর্থবছর সাত হাজার ৪৪৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা লোকসান হয়।