প্রাথমিক জ্বালানি সংস্থানের দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই

প্রাথমিক জ্বালানি সংস্থানের দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি নেই। ফলে শিল্পে গ্যাস সমস্যার সহসা সমাধান দেখা যাচ্ছে না। দেশের জ্বালানি সমস্যা মেটাতে নানা উদ্যোগের কথা বলা হলেও তার কোন কাজই এখনও শুরু হয়নি। এজন্য সরকার বারবার যে পথনির্দেশনা দিচ্ছে তাতে আস্থা রাখতে পারছে না উদ্যোক্তা।
সাত বছরেও শুরু করা যায়নি এলএনজি আমদানি। শুরু হয়নি সমুদ্রে তেল গ্যাস অনুসন্ধান। স্থলভাগেও  থেমে আছে সন্তোষজনক অনুসন্ধান। হয়নি কয়লা আমদানির জন্য গভীর বন্দর। বিদ্যুৎ উৎপাদনে অগ্রগতি হলেও তা সব উচ্চমুল্যের এবং অল্প সময়ের। স্থায়ী ও কম উৎপাদন খরচের বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে অগ্রগতি নেই।
এসব কারণে দেশের প্রাথমিক জ্বালানি নিয়ে আসন্ন সংকট যে তীমিরে ছিল সেখানেই আছে। প্রতিনিয়ত এসব সমস্যা সমাধানের আলোচনা হচ্ছে। একটি নির্দিষ্ট সময় বেধে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু কাজ শুরু হচ্ছে না। উদ্যোক্তারা জ্বালানি নিশ্চয়তা পাচ্ছেন না বলে বিনিয়োগ করছেন না।
এই পরিস্থিতিতে যে জ্বালানি ব্যবহার হচ্ছে তা শিল্পকে প্রাধান্য দিয়ে করতে হবে। অনুৎপাদনশীল খাতে গ্যাস ব্যবহার করা যাবে না। বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের বিকল্প ব্যবহার বাড়াতে হবে – সরকারের দায়িত্বশীল সকলে এই মন্তব্য প্রতিনিয়ত করছেন। কিন্তু বাস্তবে এর কোন প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে না। শিল্পকে অগ্রাধিকার দেয়ার হলেও, সিএনজি বন্ধ করা হবে বলা হলেও প্রতিনিয়ত সিএনজি’র ব্যবহার বাড়ছে। শিল্পের জন্য বিশেষ সুবিধা দেয়া হচ্ছে না।
বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এনার্জি বাংলাকে এ বিষয়ে বলেন, সংকট উত্তোরণের চেষ্টা চলছে। সারকারখানাগুলো অনেক পুরানো। এখানে যে পরিমান সার উৎপাদন হচ্ছে সেই তুলনায় অনেক বেশি গ্যাস ব্যবহার হচ্ছে। এজন্য দেশে সার উৎপাদনের চেয়ে আমদানি করা ভাল। পর্যায়ক্রমে আবাসিক ও সিএনজিতে যে গ্যাস ব্যবহার হচ্ছে তা বন্ধ করা হবে। এই সব গ্যাস শিল্পে দেয়া হবে।
গ্যাস সংকট পূরণ করতে এলএনজি আমদানির কথা বলা হচ্ছে প্রায় সাত বছর। কিন্তু এখনও চূড়ান্ত জায়গাতে পৌছানো সম্ভব হয়নি। গতবছর ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের এক্সিলারেট এনার্জি লিমিটেডের সাথে এলএনজি আমদানির জন্য অনুসাক্ষর করা হয়। কিন্তু এখনও চুড়ান্ত চুক্তি করা যায়নি। ফলে এলএনজি নিয়ে শুধু কথায় হচ্ছে। বাস্তবায়ন ভিন্ন। যদিও ২০১৮ থেকে দেশে এই জ্বালানির ব্যবহার শুরু পরিকল্পনা করা হয়েছে। আবাসিক ও সিএনজির গ্যাস শিল্প দেয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এজন্য  আবাসিক ও সিএনজি খাতে  পাইপলাইনের পরিবর্তে আমদানি করা সিলিণ্ডার গ্যাস দেয়া হবে। আবাসিকের ব্যবহারের জন্য সিলিণ্ডার গ্যাসের দাম কমানোর উদ্যোগ নেয়ার ঘোষণা অর্থমন্ত্রী পাঁচ বছর আগে দিয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত তা হয়নি। কথা ছিল আমদানি শুল্ক কমিয়ে এবং বাজার নিয়ন্ত্রন করে এর দাম কমিয়ে আনা হবে। কিন্তু সে কাজ হয়নি। বরং আমদানি শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। আর এলপিজি বাজারে কারও কোন নিয়ন্ত্রন নেই। ফলে ইচ্ছেদামে বিক্রি করছে বেসরকারি কোম্পানিগুলো।
প্রধানমন্ত্রী ঘোষনা দিয়েছেন দেশের কয়লা ব্যবহার হবে না। আমদানি করা কয়লা দিয়ে চাহিদা মেটানো হবে। কিন্তু আমদানির যে অবকাঠামো তা তৈরীর দৃশ্যমান কোন উদ্যোগ এখনও দেখা যাচ্ছে না। কয়লা কোথা থেকে আসবে। তার দাম কত হবে। কয়লা নিয়šúনে যে বন্দও হবে তা কোথায় হবে। এগুলো এখনও ঠিক হয়নি। এনিয়ে নির্দিষ্ট কোন সমীক্ষাও হয়নি।
এই অবস্থায় প্রতিনিয়ত শিল্পে যে চাহিদা বাড়ছে তা মেটানো যাচ্ছে না। ঘাটতি দিন দিন বাড়ছে। পর্যায়ক্রমে গ্যাস ফুরিয়ে যাচ্ছে।  এজন্য গত কয়েকবছর স্বাভাবিকভাবে গ্যাস সংযোগ দেয়া হচ্ছে না। জাতীয় সংসদে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, ২০৩১ সালে গ্যাস ফুরিয়ে যাবে।
বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে ৫০ থেকে ৭০ কোটি ঘনফুট গ্যাস ঘাটতি আছে। এই ঘাটতি ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। আগামী পাঁচ বছরের গ্যাসের চাহিদা পর্যবেক্ষণ করে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালের মধ্যে পর্যায়ক্রম শুধু বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দৈনিক ২৯৩ ঘনফুট গ্যাস প্রয়োজন হবে। আর চলতি বছর লাগবে ১৫১ কোটি ঘনফুট। ২০১৬ সালে বিদ্যুতে গ্যাস লাগবে দৈনিক ১৮৫ কোটি ঘনফুট, ২০১৭ সালে ১৯৫ কোটি এবং ২০১৮ সালে বিদ্যুতে গ্যাস লাগবে ২০৯ কোটি ঘনফুট। একই সাথে সার উৎপাদনে ২০১৯ সালে দৈনিক লাগবে ৩১ কোটি ঘনফুট। সার উৎপাদনে গ্যাসের ব্যবহার বাড়বে না বলে জানানো হয়েছে। চলতি বছরও সার উৎপাদনে দৈনিক ৩২ কোটি ঘনফুট করে গ্যাসের প্রয়োজন হবে। শিল্প কারখানায়  চলতি বছর গ্যাস লাগবে দৈনিক ৪৫ কোটি ঘনফুট। পর্যায়ক্রমে ২০১৯ সালে এর পরিমান বেড়ে হবে ৬০ কোটি ঘনফুট। আবাসিক গ্রাহকদের চলতি বছর দৈনিক প্রয়োজন ৩১ কোটি এবং ২০১৯ সালে গিয়ে লাগবে প্রায় ৪০ কোটি ঘনফুট। বাণিজ্যিক গ্রাহকদের এবছর দৈনিক লাগবে দুই কোটি ৬০ লাখ এবং ২০১৯ সালে গিয়ে তিন কোটি ঘনফুট। ক্যাপটিভ বিদ্যুতে চলতি বছর দৈনিক ৪৭ কোটি এবং ২০১৯ সালে গিয়ে লাগবে ৪৮ কোটি ঘনফুট। সিএনজিতে বর্তমানে দৈনিক ১৪কোটি এবং ২০১৯ সালে গিয়ে দৈনিক লাগবে ১৬ কোটি ঘনফুট। চা ও ইটভাটায় বর্তমানে দৈনিক ৭০ লাখ ঘনফুট এবং ২০১৯ সালে গিয়ে লাগবে ৯০ লাখ ঘনফুট গ্যাস।  সিএনজি ও আবাসিকে গ্যাস দেয়া হবে না বলা হলেও পরিকল্পনায় বাড়তি চাহিদা দেখানো হচ্ছে।
এই অবস্থায় আস্থা পাচ্ছেন না উদ্যোক্তারা। তারা বলছেন, দৃশ্যমান কোন কিছুই নেই। যা দেখে নির্ভর করা যায়। যা হচ্ছে তা শুধু প্রতিশ্রুতি। বাস্তবে নয়। বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, গ্যাস বিদ্যুৎ কারখানা পরিচালনার জন্য অন্যতম একটি উপাদান। জ্বালানি ছাড়া কারখানা চলবে না। কিন্তু সেই জ্বালানির নিশ্চয়তা এখনও পাওয়া যাচ্ছে না। এটা খুবই জরুরী। সরকারের পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট নীতি থাকলে বিনিয়োগে সুবিধা হবে। বিনিয়োগ বাড়বে। বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়লেও এখনও মানসম্মত নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে জ্বালানি নিশ্চয়তা এখনও বিনিয়োগে বাধা তৈরী করছে। এখান থেকে বের হয়ে আসার যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তা দ্রুত বাস্তবায়ন বা দৃশমান করতে হবে।
প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর কাজের গতি শ্লথ। নির্ধারিত সময়ে কেন্দ্রগুলো আসতে পারবে কিনা তা অনিশ্চিত। অন্যদিকে জ্বালানি খাতের উল্লেখ করার মতো কিছুই হয়নি। সরকার এলএনজি আমদানির কথা বলছে। কিন্তু এই এলএনজি দিয়ে তো আর সব সংকট মোকাবিলা করা যাবে না। প্রাথমিক জ্বালানির ক্ষেত্রে এটি সমাধান হতে পারে না। স্থল ও জলভাগে অনুসন্ধান কাজের কোনো গতি নেই। দেশীয় কয়লা উত্তোলনের ক্ষেত্রেও সরকারের অবস্থান হতাশাজনক।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত কয়েক বছর প্রায় পুরো সময়টা নতুন গ্যাস সংযোগ দেয়া বন্ধ ছিল। কিন্তু তবুও চাহিদা বেড়েছে। নিয়ম অনুযায়ি নতুন সংযোগ না দিলেও চাহিদা বেড়েছে। যার পুরোটাই হয়েছে অবৈধ।
পেট্রোবাংলা সূত্র জানায়, শিল্প ও বাণিজ্যিক মিলিয়ে এক হাজারেরও বেশি আবেদন জমা আছে। নিষেধাজ্ঞা থাকায় বিতরণ কোম্পানিগুলো এ সংযোগ দিতে পারছে না। পেট্রোবাংলার হিসাব অনুযায়ি গত অক্টোবর মাস পর্যন্ত ৩৮৫টি শিল্প প্রতিষ্ঠানের আবেদন জমা আছে। এছাড়া ১৩৫টি ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ জেনারেটর, ৯৭৩টি বাণিজ্যিক এবং ১৮টি সিএনজি স্টেশনের আবেদন জমা আছে। কয়েকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রর আবেদনও জমা আছে।
গত ছয় বছরে (২০০৯ থেকে ২০১৫) সর্বোচ্চ  প্রায় ৭০ কোটি ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন বাড়ানো হয়েছে। একই সময়ে বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে প্রায় ২০ কোটি ঘনফুট গ্যাস কমেছে। ফলে মূলত যোগ হয়েছে গড়ে ৫০ কোটি ঘনফুট। নতুন গ্যাস যোগ হওয়ার সাথে চাহিদা এবং নতুন সংযোগ বেড়েছে। তাই সমস্যা যে তীমিরে ছিল সেখানেই রয়ে গেছে।