শেষ হতে চলেছে নাইকো মামলা

দীর্ঘ অপেক্ষার পর আন্তর্জাতিক আদালতে নাইকো মামলা শেষ হতে যাচ্ছে। নভেম্বরের ২ থেকে ৬ তারিখ এ মামলার শেষ শুনানী অনুষ্ঠিত হবে। এরপর চূড়ান্ত রায়। তবে এ মামলায় এখন পর্যন্ত যতগুলো শুনানী হয়েছে সেখানে বাংলাদেশের পক্ষে যথাযথ তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করা হয়নি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এজন্য বাপেক্সের পক্ষ থেকে নতুন করে সময় চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু আদালত তা দেয়নি। নভেম্বরের শুনানীতেই ঘাটতি থাকা তথ্য উপস্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক মামলািট নিজেই তদারকি করছেন।
জাতীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ঠ মামলাটি কানাডীয় কোম্পানি নাইকো রিসোর্স করেছিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্সের বিরুদ্ধে। যদিও বাংলাদেশই ছিল ক্ষতিগ্রস্থ।
বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এনার্জি বাংলাকে বলেন, সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। শুনানীর সময় নতুন করে সকল তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করা হবে।
বাপেক্স সূত্র জানায়, মামলার আইনজীবি প্রয়োজনীয় তথ্য বিচারকের কাছে উপস্থাপন করেননি। বিষয়টি বাপেক্সের দৃষ্টিগোচর হলে আইনজীবি বাদ দেয়া হয়েছে। নতুন আইনজীবি নিয়োগ দেয়া হয়েছে এবং নতুনভাবে যুক্তি, তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপনের আবেদন করা হয়েছে। বাপেক্সের পক্ষ থেকে সময় চাওয়া হলেও বাড়তি সময় দেয়নি আদালত। ফলে নভেম্বরেই এর শুনানী শেষ হবে।
পেট্রোবাংলার সচিব আশরুফুজ্জামান এনার্জি বাংলাকে বলেন, নভেম্বরে দুটি মামলার শুনানী শেষ হবে। আদালতের রায় না দেয়া পর্যন্ত এবিষয়ে কিছুই বলা যাবে না। তিনি বলেন, আগের আইনজীবি বাদ দেয়া হয়েছে। নতুন করে আইনজীবি নিয়োগ দেয়া হয়েছে। নতুন আইনজীবি নভেম্বরে শুনানী পরিচালনা করবেন।
সূত্র জানায়, ১লা অক্টোবর ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রাক শুনানী করা হয়েছে। শুনানীতে বাপেক্সের পক্ষে নতুন করে তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করা হয়েছে। অতীতে যেসব তথ্য আদালতে জানানো হয়নি সেসব তথ্য জানানো হয়েছে এবং হবে।
নাইকো আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতে ২০১০ সালের ১২ই এপ্রিল এবং ১৬ই জুন দুটি মামলা করে। একটি গ্যাসের বকেয়া বিল আদায় সংক্রান্ত (আরবি/১০/১৮) অন্যটি টেংরাটিলা বিষ্পোরণের ক্ষতিপূরণ থেকে অব্যাহতি চেয়ে (আরবি/১০/১১)।
বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আতিকুজ্জামান এনার্চি বাংলাকে বলেন, বাপেক্সের পক্ষে প্রথমে যথাযথ তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করা হয়নি। এজন্য রায় বাপেক্সের বিপক্ষে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরী হয়েছিল। বিষয়টি জানতে পেরে নতুন করে আদালতে তথ্য উপাত্ত উপস্থাপনের সুযোগ চেয়ে আবেদন করা হয়েছে।
এদিকে মামলার বিষয়ে আইনজীবির সাথে বিস্তারিত আলোচনার জন্য আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গত শনিবার লণ্ডন গিয়েছেন। গত বৃহষ্পতিবার তিনি এনার্জি বাংলাকে বলেন, মামলার বিষয়টি নিয়ে আইনজীবির সাথে আলোচনা হবে। এখনও কী কী সম্ভাবনা আছে তা দেখব। বিচারাধিন বিষয়ে মন্তব্য করা ঠিক নয়।
টেংরাটিলা গ্যাসক্ষেত্রে দু’দফা আগুন লাগার ঘটনায় ক্ষতিপূরণ দাবি করে বাংলাদেশ। নাইকোর গাফিলতির জন্যই এই দুর্ঘটনা হয়েছে বলে বাপেক্স দাবি করে। কিন্তু ক্ষতির পরিমান ও গাফিলতি নিয়ে মতভেদ হয়। নাইকো ক্ষতিপূরণ দিতে অস্বীকৃতি জানায়। তারা দাবি করে এবিষয়ে তাদের কোন গাফিলতি হয়নি। এই ক্ষতিপূরন দেবে না বলে নাইকো লণ্ডনে  বিনিয়োগ বিরোধ নিষ্পত্তি সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতে (ইকসিড) মামলা করে। একই সাথে বাপেক্স ও এই ক্ষতি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তাদের ফেণি গ্যাসক্ষেত্রর পাওনা অর্থ না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। স্থানীয় আদালতের রায়ের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। স্থানীয় আদালতে মামলাটি এখনও চলছে। এই অর্থ আদায়ের জন্য নাইকো আরও একটি মামালা করে বাপেক্সের বিরুদ্ধে।
মামলা পরিচালনার জন্য নতুন করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আইনী প্রতিষ্ঠান ফলে হগ এলএলপিকে (ওয়াশিংটন ডিসি) নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানকে সহায়তার জন্য সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিষ্টার ইমতিয়াজ উদ্দিন আহমদ আসিফকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
বাপেক্সের পক্ষে মামলা পরিচালনা করছিল আইনজীবি তৌফিক নেওয়াজ। বাপেক্স সূত্র জানায়, অনেক আগেই তৌফিক নেওয়াজকে গাফিলতির অভিযোগে এই মামলা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। তৌফিক নেওয়াজের অসহযোগিতার কারণে এই মামলার বিদেশী যে আইনজীবি ছিলেন তারাও নিজেদের থেকেই পদত্যাগ করেছেন।

জ্বালানি বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, নাইকোর মামলা পরিচালনার জন্য ইকসিডে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যথাযথ তথ্য উপস্থাপন করা হয়নি। এতোদিন ধরে বাংলাদেশের পক্ষ হয়ে যারা মামলা পরিচালনা করেছেন তাদের গাফিলতি ও সংশ্লিষ্ঠ সরকারি কয়েকজন কর্মকর্তার দায়িত্বে অবহেলার কারণে এ বিপর্যয় হয়েছে।
সংশ্লিষ্ঠরা জানান, নাইকো আদালতে জানিয়েছে, দুর্ঘটনার পর গ্যাস কূপ বন্ধ করা হয়েছে। সেখান দিয়ে আর কোন গ্যাস বের হচ্ছে না। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ১০ বছর আগে দুর্ঘটনা হলেও এখন পর্যন্ত টেংরাটিলার বিভিন্ন গ্রামে গ্যাসের বুদবুদ বের হচ্ছে। গ্যাস উবে যাওয়া বন্ধ হয়নি। অনেক স্থান দিয়ে গ্যাস উবে যাওয়ার এই ভিডিওচিত্রটি ভিডিওকনফারেন্সের মাধ্যমে প্রাক শুনানীতে দেখানো হয়েছে।
ছাতকের টেংরাটিলা গ্যাসক্ষেত্রে ২০০৫ সালের ৭ জানুয়ারি ও ২৪ জুন দুই দফা অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এর ক্ষতিপূরণ দাবিতে স্থানীয় আদালতে মামলা করে পেট্রোবাংলা। এই গ্যাস ক্ষেত্রের ৯০ ভাগের মালিক নাইকো। বাকী ১০ ভাগের মালিক ছিল বাপেক্সের। পরিচালনার মূল দায়িত্ব ছিল নাইকো। কিন্তু সে অগ্নিকাণ্ডের দায় নাইকো নিতে চাইনি। ফলে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে সম্মত হয়নি। নাইকো ফেনি গ্যাসক্ষেত্রও পরিচালনা করত। অন্য সকল বিদেশী কোম্পানির মত নাইকোর কাছ থেকেও পেট্রোবাংলা গ্যাস কিনে নিত। নাইকো যখন টেংরাটিলার পুরো ক্ষতিপূরণ দিতে সম্মত হল না তখন উচ্চ আদালতের অনুমোতি নিয়ে ফেনির গ্যাসের দাম শোধ করা বন্ধ করে দেয়া হল। বলা হল, টেংরাটিলার ক্ষতিপুরণ না দিলে ফেনির পাওনা টাকা দেয়া হবে না। স্থানীয় আদালতে এনিয়ে একটি মামলা এখনও চলছে। নাইকো ফেনি গ্যাসক্ষেত্রের পাওনা আদায়ে এবং টেংরাটিলার ক্ষতির হিসাব তাদের মত করে করার দাবিতে আন্তর্জাতিক আদালতে যায়।
দুর্ঘটনার কারণে নাইকোর কাছে ৭৪৬ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করে পেট্রোবাংলা। কিন্তু নাইকো এর তিনভাগের একভাগও ক্ষতিপূরণ দিতে সম্মত নয়। নাইকো বলতে চাই, গ্যাসক্ষেত্রের মূল মজুদে কোন ক্ষতি হয়নি। উপরে থাকা গ্যাস উবে আগুণ ধরেছে। ফলে গ্যাস সম্পদের কোন ক্ষতি হয়নি। আশপাশের গ্রামে মানুষের এবং পরিবেশের যে ক্ষতি হয়েছে শুধু তাই দিতে চাই নাইকো।