সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধান: যে সব সুবিধা দেয়া হবে বিদেশী কোম্পানিকে

রফিকুল বাসার:
বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রে খনিজ অনুসন্ধান করতে বিদেশী কোম্পানিকে দেওয়া হচ্ছে নানা সুযোগ-সুবিধা। বাংলাদেশে বিনিয়োগ করলে আর গ্যাস পেলে তার ৩৫ ভাগ দিয়ে দেওয়া হবে বিনামূল্যে। আজীবন দেওয়া লাগবে না আয়কর। জ্বালানি উপাদান বা হিটিং ভ্যালুতে নয় গ্যাসের দাম দেওয়া হবে পরিমানের ভিত্তিতে।
সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য বিদেশি কোম্পানিকে কাজ দিতে যে চুক্তি করা হবে তার খসড়া ইতিমধ্যে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে অনুমোদন পেয়েছে। খসড়ার আলোকে যে কোম্পানি আসবে তাদের সাথে আবার দরকষাকষির মাধ্যমে কাজ দেওয়া হবে।
পেট্রোবাংলা বলছে, সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধান করতে বিনিয়োগ ও ঝুঁকি বেশি। তাই বেশি সুযোগ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। চুক্তির শর্ত যৌক্তিক করা হয়েছে দাবি করেছেন পেট্রোবাংলা’র পরিচালক (পিএসসি) প্রকৌশলী মো. শাহীনুর ইসলাম।
বিদেশী কোম্পানির সাথে যে চুক্তি করা হবে তার খসড়ার নাম ‘প্রডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট’ বা ‘উৎপাদন অংশীদারিত্ব চুক্তি’। সংক্ষেপে পিএসসি।
সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানের আগে চুক্তির এমন খসড়া করা হয়। সম্প্রতি চুক্তির যে খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে তার কিছু বিষয় তুলে ধরা হলো।
সম্পদের বন্টন:
যদি সমুদ্রে গ্যাস পাওয়া যায় তবে সকল খরচ বাদ দিয়ে ৩৫ ভাগ বিনামূল্যে দিয়ে দেয়া হবে বিনিয়োগকারী কোম্পানিকে। আর ৬৫ ভাগ থাকবে পেট্রোবাংলা’র। ২০১৯ সালের পিএসসিতে পেট্রোবাংলা’র অংশ ছিল ৭০ ভাগ আর বিদেশী কোম্পানির ৩০। নতুন করে বিদেশি কোম্পানির অংশ পাঁচ ভাগ বাড়ানো হয়েছে।
আগে খরচের হিস্যা পরে বণ্টন:
গ্যাস পাওয়া গেলে তা বিক্রি থেকে প্রথমে পর্যায়ক্রমে অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য খরচ করা অর্থ নিয়ে নেবে সংশ্লিষ্ট বিদেশি কোম্পানি। খরচের টাকা তোলা আর মালিকানার অংশ সময় সময় পরিবর্তন হবে। দ্রুত সময়ে খরচ ওঠা নিশ্চিত করা হয়েছে। এজন্য উৎপাদনের শুরু থেকে যতদিন খরচ না উঠবে ততদিন ৬৫ ভাগ গ্যাস নেবে বিদেশি কোম্পানি। এই গ্যাস কিনে নিতে হবে পেট্রোবাংলাকে। পরে যতদিন গ্যাস উঠবে ততদিন সবার আগে খরচের টাকা নেবে পরে উভয়ের মধ্যে চুক্তি অনুযায়ি ভাগ হবে।
যত কূপ তত মালিকানা:
যদি প্রথম কূপ খনন করে গ্যাস না পাওয়া যায় তবে বিদেশি কোম্পানির অংশ আরও বাড়বে। জরিপ শেষে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে গ্যাসের অস্তিত্ব নিশ্চিত করতে কূপ খনন করতে হবে। প্রথম কূপ খনন করেই যদি গ্যাস পাওয়া যায় তবে ৩৫ ভাগই থাকবে। কিন্তু যদি প্রথম কূপে গ্যাস না পাওয়া যায় আর দ্বিতীয় কূপ খনন করতে হয় এবং সেখানে গ্যাস পাওয়া যায় তাহলে তাদের অংশ ৩৬ ভাগ হবে। যদি দ্বিতীয় কূপেও গ্যাস না পাওয়া যায় আর তৃতীয় বা ততধিক কূপ খনন করতে হয় তবে আরও ২ শতাংশ বিনামূল্যে দেওয়া হবে। অর্থাৎ তখন যে গ্যাস পাওয়া যাবে তার ৩৮ শতাংশ বিনামূল্যে দেওয়া হবে বিদেশি কোম্পানিকে। আর ৬২ ভাগ থাকবে পেট্রোবাংলা’র।
বাধ্যবাধকতা:
যে বিদেশি কোম্পানি পেট্রোবাংলার সাথে চুক্তি করবে – তাকে অবশ্যই অন্তত একটি অনুসন্ধান কূপ খনন করতে হবে। তার আগে করতে হবে ত্রিমাত্রিক ভূতাত্ত্বিক জরিপ। ত্রিমাত্রিক জরিপের মাধ্যমে গ্যাসের কাঠামো নিশ্চিত হয়ে কূপ খনন করবে। একমাত্র কূপ খননের মাধ্যমেই জানা যাবে সম্পদের অস্তিত্ব এবং পরিমাণ।
সময় ও কাজের পরিকল্পনা:
চুক্তির তিন বছরের মাথায় সিদ্ধান্ত নিতে হবে কূপ খননের। প্রথম দুই বছর ভূতাত্ত্বিক জরিপ। পরের বছর জরিপের তথ্য নিয়ে পর্যালোচনা। আর তিন বছরের মাথায় গিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে কূপ খননের। কূপ খনন করে যদি গ্যাস পাওয়া যায় তবে তার দুই বছরের মধ্যে উৎপাদনে যেতে হবে। এই সময় পেট্রোবাংলা এবং বিদেশি কোম্পানি আলোচনার মাধ্যমে কম বেশি করতে পারবে।
দাম নির্ধারণ পদ্ধতি:
গ্যাস পাওয়া গেলে বিদেশি কোম্পানিকে বিনামূল্যে যে অংশ দেয়া হবে তা পেট্রোবাংলা কিনে নেবে। একই সাথে প্রথমে অনুসন্ধানের খরচ তোলার অংশের গ্যাসও কিনে নেবে পেট্রোবাংলা। এই গ্যাসের দাম নির্ধারণ পদ্ধতি এবার একদম নতুনভাবে করা হয়েছে। আগে এটা নির্ধারিত ছিল। এবার বাজারদরের উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
আন্তর্জাতিক বাজারের তেলের দামের সাথে সমন্বয় করে এই দাম নির্ধারণ হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের যখন যে দাম থাকবে তার ১০ ভাগ হবে গ্যাসের দাম। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বাজারে যদি জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেল প্রতি হয় ৭০ ডলার, তবে এক একক গ্যাসের (এক হাজার ঘনফুট) দাম হবে সাত ডলার। এভাবেই প্রতিনিয়ত আন্তর্জাতিক বাজারে যখন যত দাম থাকবে তখন সেই দামেই কিনবে পেট্রোবাংলা। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমে গেলে কম দামে আর বেড়ে গেলে বেশি দামে কিনতে হবে।
পেট্রোবাংলা না নিলে রপ্তানির সুযোগ:
বিনিয়োগের অর্থ এবং যে ৩৫ ভাগ বিনামূল্যে দেয়া হবে তা পেট্রোবাংলা’র কাছেই বিক্রি করতে বাধ্য থাকবে বিদেশি ওই কোম্পানি। পেট্রোবাংলা যদি কিনতে রাজি না হয় বা প্রয়োজন না হয় তখন তারা তৃতীয়পক্ষ বা বিদেশে রপ্তানি করতে পারবে। ২০১২ সালের পিএসসিতে কোনোভাবেই রপ্তানির সুযোগ ছিল না। এখন পেট্রোবাংলা না নিলে পাইপলাইন, এলএনজি কিংবা অন্য যে কোন প্রক্রিয়ায় রপ্তানি করতে পারবে। যদি সমুদ্রে অনেক পরিমাণে গ্যাস পাওয়া যায় তাহলে এই পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। পেট্রোবাংলার যে অংশ তা দিয়েই যদি দেশের চাহিদা পূরণ হয় তখন প্রয়োজনে পেট্রোবাংলা নাও কিনতে পারে। আর সে ক্ষেত্রেই রপ্তানির প্রসঙ্গ আসতে পারে।
উপাদান নয় পরিমাণ হিসেবে দাম:
জ্বালানির দাম সাধারণত উপাদানের ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। খনিজ সম্পদের কোন্ উপাদান কতটা নেয়া হচ্ছে এবং তার শক্তির পরিমাণ কত- তার ওপর নির্ভর করে দাম ঠিক হয়। একে হিটিং ভ্যালু বলে।
বর্তমানে শেভরনের কাছ থেকে বিবিয়ানা’র গ্যাস হিটিং ভ্যালু ভিত্তিতে কেনে পেট্রোবাংলা। আবার তিতাস গ্যাসসহ দেশের অন্য বিতরণ কোম্পানিগুলো সাধারণ গ্রাহকের কাছে পরিমাণের ভিত্তিতে বিক্রি করে।
সমুদ্রের গ্যাস পাওয়া গেলে বিদেশি কোম্পানির অংশ হিটিং ভ্যালুতে নয় পরিমাপের ভিত্তিতে কেনা হবে, ঘনফুট হিসেবে। গ্যাসের মধ্যে কোন্ উপাদান কতটা থাকলো না থাকলো; তার জ্বালানির শক্তি কতটা- তা বিবেচনায় না নিয়ে যতটা চাপ পাওয়া যাবে তার দাম দেয়া হবে।
আয়কর:
যে বিদেশি কোম্পানি এখানে কাজ করবে আর যতদিন কাজ করবে ততদিন তাদের কোন আয়কর দেয়া লাগবে না; পেট্রোবাংলা দিয়ে দেবে। একই সাথে অনুসন্ধান ও উত্তোলন প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট সকল পণ্য আমদানি শুল্কমুক্ত হবে।
অন্য সম্পদ পেলে:
অনুসন্ধানে গ্যাস ছাড়া অন্য কোন খনিজ সম্পদ পাওয়া গেলে তার অংশও একইভাবে ভাগ হবে। অর্থাৎ খরচ বাদে বিদেশি কোম্পানি পাবে বিনামূল্যে ৩৫ ভাগ আর পেট্রোবাংলা নেবে ৬৫ ভাগ। সেই সময়ের আন্তর্জাতিক বাজার মূল্যেই তার দাম নির্ধারণ হবে। পেট্রোবাংলা না কিনলে অন্য জায়গায় বিক্রি করতে পারবে।
বিনিয়োগ ও ঝুঁকি:
যে কোম্পানির সাথে চুক্তি হবে তারাই অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য সকল বিনিয়োগ করবে। গ্যাস বা খনিজ সম্পদ পাওয়া গেলে তা বিক্রি করে এই বিনিয়োগের অর্থ আলাদা করে নিয়ে নেবে ওই কোম্পানি। তারপর সম্পদ ভাগ হবে। কিন্তু যদি কোন সম্পদ না পাওয়া যায় তবে এই অর্থ আর ফেরত পাবে না। সম্পদ পাওয়া না পাওয়া অনিশ্চিত। তাই এই ঝুঁকি বিবেচনা করেই বেশি বেশি সুবিধা দেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে পেট্রোবাংলা।
বিমা ও ক্ষতিপূরণ:
অনুসন্ধান কাজের প্রথম থেকেই বিমা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অনুসন্ধানের সময় যদি কোন বিস্ফোরণ বা অন্য কোনোভাবে খনিজ সম্পদের ক্ষতি হয় তবে সেই ক্ষতিপূরণ দিতে হবে বিদেশি কোম্পানিকে।
আত্মীকরণ:
যেকোনো সময় যেকোনো পরিস্থিতিতে সরকার বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে গ্যাসক্ষেত্র আত্মীকরণ বা নিজের করে নিতে পারবে। সেক্ষেত্রে সম্পদের বাজারদর অনুযায়ি অর্থ দিয়ে দিতে হবে। বাংলাদেশের ‘দ্যা ফরেন প্রাইভেট ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন অ্যান্ড প্রটেকশন অ্যাক্ট’ ১৯৮০ এর ৭ এর ১ ও ২ নম্বর ধারা পিএসসিতে রেফারেন্স হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এতে যদি কখনো সরকার বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে তাদের অংশের সম্পদ আত্মীকরণ করে তখন বাজারমূল্য অনুযায়ী সেটা দিয়ে দিতে হবে।
যৌথ কমিটি:
বিদেশি কোম্পানি আর পেট্রোবাংলা’র যৌথভাবে একটা কমিটি থাকবে। এই কমিটি সময় সময় সব সিদ্ধান্ত নেবে। কিভাবে কখন কত খরচ করতে হবে; কি কিনতে হবে; কিভাবে কিনতে হবে; সব এই কমিটির মাধ্যমে হবে।
বাপেক্সের অংশ:
গভীর সমুদ্রে বাপেক্সের কোন অংশ রাখা হয়নি। তবে অগভীর অংশে বাপেক্সের দশ শতাংশ মালিকানা রাখা হয়েছে। গভীর সমুদ্রে বাপেক্স-এর মালিকানা রাখা হলে রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি বাড়তো বলে দাবি করেছে পেট্রোবাংলা।
দ্বিমাত্রিক জরিপ:
সমুদ্রে খনিজ সম্পদের ধারণা পেতে নরওয়ের টিজিএস ও যুক্তরাষ্ট্রের এসএলবি নিজস্ব খরচে ‘মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভে’ বা দ্বিমাত্রিক জরিপ করছে। জানুয়ারি থেকে এই কাজ শুরু হয়েছে। ডিসেম্বরে শেষ হতে পারে। ৩২ হাজার লাইন কিলোমিটার দ্বিমাত্রিক জরিপ করবে। এতে প্রায় এক কোটি ডলার খরচ হচ্ছে বলে জানিয়েছে পেট্রোবাংলা। জরিপের তথ্য বিক্রি করে এই অর্থ নেবে ঐ কোম্পানি। খরচ ওঠার পরে লাভের একটা অংশ এবং ১০ বছর পরে সম্পূর্ণ তথ্যের মালিক হবে পেট্রোবাংলা।
এক্সন মবিলের প্রস্তাব:
গভীর সমুদ্রের ১৫টি ব্লকই এককভাবে অনুসন্ধান করার প্রস্তাব দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের এক্সন মবিল। দরপত্র ছাড়া সরাসরি তারা ব্লক ইজারা নিতে চায়। এনিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
খনিজ অনুসন্ধানের জন্য বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ অংশকে ২৬টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে। এরমধ্যে ১১টি অগভীর এবং ১৫টি গভীর। প্রায় ৬৫০ ফুট পানির গভীরতা পর্যন্ত অগভীর ব্লক। এরপরের বাকি অংশ গভীর। গভীর সাগরে গ্যাস পাওয়ার সুখবরের অপেক্ষায় দেশবাসী।