রফিকুল বাসার:
বিশেষ আইনে এবার সমুদ্রে গ্যাস ব্লক ইজারা দেয়ার কথা ভাবছে সরকার। যুক্তরাষ্ট্রের তেল গ্যাস কোম্পানি এক্সজোনমোবিল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের সাথে এই আলোচনা চলছে। তারা সম্মত থাকলে দরপত্র আহ্বান না করেই আলোচনার মাধ্যমে সমুদ্রের ব্লক ইজারা দেয়া হবে।
সংশ্লিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিয়ে হলেও সরকার চাইছে তাদের বিনিয়োগ আনতে। ইতিমধ্যে উৎপাদন অংশীদারি চুক্তি’র (পিএসসি) বিভিন্ন সুবিধা বাড়াতে পর্যালোচনা শুরু হয়েছে।
তবে একই সাথে সমুদ্রে গ্যাস ব্লক ইজারার দরপত্র আহ্বান প্রক্রিয়াও চলতে থাকবে। বিদেশী তেল গ্যাস কোম্পানির জন্য সুবিধা বাড়িয়ে পিএসসি সংশোধনের কাজ শুরু হয়েছে। ডিসম্বরের মধ্যেই দরপত্র আহ্বান করার চেষ্টা চলছে বলে পেট্রোবাংলা জানিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা ড. তৌফিক ই ইলাহী চৌধুরী, বীর বিক্রম এনার্জি বাংলাকে বলেন, আমরা আলোচনা করেছি। এক্সজোনমোবিল পৃথিবীর অন্যতম বড় তেল গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনকারী কোম্পানি। এখানে যদি তাদের বিনিয়োগ আনা যায় তবে ভাল হবে। সেক্ষেত্রে গ্যাসের দাম নির্ধারণ না করে বাজার দরের উপর ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বাজারে যখন যে দাম থাকবে তখন সেই দামের সাথে গ্যাসের দামও সমন্বয় হবে। গ্যাস পেলে তা কীভাবে আনা হবেÑ পাইপ লাইন স্থাপন করে না অন্য কোন উপায়ে তা গ্যাসের পরিমান দেখে নির্ধারণ করা হবে। তবে এসবই আলোচনা পর্যায়ে। কিছুই চূড়ান্ত হয়নি বলে তিনি জানান।
সূত্র জানায়, এক্সজনমবিলের ঊর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানে আগ্রহ দেখিয়েছে।
সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানে বিদেশী কোম্পানিকে আকৃষ্ট করতে সুযোগ সুবিধা বাড়িয়ে পিএসসির খসড়া তৈরির কাজ শুরু করেছে পেট্রোবাংলা। খসড়ায়, গ্যাস পাওয়া গেলে তা রপ্তানির সুযোগ থাকছে। তবে প্রথম পেট্রোবাংলা অগ্রাধিকার পাবে। পেট্রোবাংলা না নিলে গ্যাস রপ্তানি করতে পারবে।
ডিসেম্বরের মধ্যে দরপত্র আহ্বানের উদ্যোগ
তেলের সাথে গ্যাসের দাম সমন্বয় করার পরামর্শ উডমেকেঞ্জির
কিভাবে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা যায় আর কোন কোন সুবিধা দিলে বাংলাদেশ সমুদ্রে বিদেশি বিনোয়োগ পেতে পারে তা জানতে পরামর্শক নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান উড মেকেঞ্জি সম্প্রতি তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। সেখানে তারা, তেলের সাথে সমন্বয় করে গ্যাসের দাম নির্ধারণের পরামর্শ দিয়েছে।
পেট্রোবাংলা’র চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান এনার্জি বাংলাকে বলেন, উড মেকাঞ্জির প্রতিবেদন পেয়েছি। আমরা পর্যালোচনা করছি। ডিসেম্বরেই সমুদ্রের গ্যাসব্লক ইজারা দিতে দরপত্র আহ্বানের প্রস্তুতি নিচ্ছি। বিদেশি কোম্পানিকে আকৃষ্ট করার জন্য এখন উৎপাদন অংশীদারি চুক্তির প্রস্তাব সংশোধন করা হচ্ছে। দ্রুতই পর্যালোচনা শেষে এ বছরের মধ্যে দরপত্র আহ্বান প্রক্রিয়া শুরু করা যাবে বলে আশা করেন তিনি।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম তামিম এনার্জি বাংলাকে বলেন, বিদেশী বিনিয়োগ পেতে সবার আগে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। সমুদ্রের যত তথ্য আছে তা বিদেশী কোম্পানিকে দিতে হবে। যে তথ্য আমাদের আছে তা আগে থেকেই নিজেরা বিশ্লেষণ করে তাদের কাছে উপস্থাপন করতে হবে। যত বেশি তথ্য তাদের দেয়া যাবে তারা ততই আকৃষ্ট হবে। তথ্য ছাড়া পিএসসি সংশোধন করে সুবিধা বাড়ালেও ফল খুব একটা ভাল নাও হতে পারে।
২০০৯ সালে ভারত আর ২০১২ সালে মিয়ানমারের সাথে সীমানা নির্ধারণের পর গভীর সমুদ্রে এখনও খনিজ অনুসন্ধান শুরু করা যায়নি। এরআগে পোসক্যু দাইয়ুকে দেয়া হলেও তারা কোন কারণ না দেখিয়ে কোন কাজ না করেই চলে যায়।
এখন স্থলভাগের কাছাকাছি অগভীর সমুদ্রে মাত্র একটি ব্লকে ভারতীয় কোম্পানি ওএনজিসি জরিপ এবং অনুসন্ধানের কাজ করছে। ইতিমধ্যে একটি অনুসন্ধান কূপ খনন করেছে। কিন্তু সেখানে কিছু পাওয়া যায়নি। আরও দুটো কূপ খনন করার কথা আছে। কবে করবে তা এখনও অনিশ্চিত।
ভূগঠন বিশ্লেষণ করে সমুদ্রে ২৬টি ব্লক নির্ধারণ করা হয়েছে। এই ব্লকগুলোর দুই পাশে ভারত ও মিয়ানমার তাদের অংশে গ্যাস পেয়েছে। সেই গ্যাস তারা তুলছে। কিন্তু বাংলাদেশ অংশে এখনও অনুসন্ধান করাই হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগ (ইউএসজিএস) ও পেট্রোবাংলা ২০০০ সালে যৌথভাবে অনাবিষ্কৃত গ্যাসসম্পদের সম্ভাবনা নিয়ে মূল্যায়ন করে। তাতে দেখানো হয়, দেশে ৫০ শতাংশ সম্ভাবনায় উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের গড় পরিমাণ ৩২ টিসিএফ। এর মধ্যে ২৩ টিসিএফ গ্যাস স্থলভাগে। বাকি নয় টিসিএফ অগভীর সাগরে (পানির গভীরতা ২০০ মিটার পর্যন্ত)। গভীর সাগরের হিসাব এখানে নেই।
নরওয়ে সরকারের নরওয়েজীয় পেট্রোলিয়াম ডাইরেক্টরেট সরকারের সাথে যৌথভাবে ২০০১ সালে আবার জরিপ করে। তারা পেট্রোবাংলা ও বিদেশি কোম্পানির বিভিন্ন ভূতাত্ত্বিক ভূপদার্থিক ও আনুষঙ্গিক তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদন দেয়। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়,
৫০ শতাংশ সম্ভাবনায় বাংলাদেশের অনাবিষ্কৃত গ্যাসসম্পদের গড় পরিমাণ ৪২ টিসিএফ। এ জরিপেও দেশের গভীর সমুদ্র অঞ্চলকে মূল্যায়নের আওতায় আনা হয়নি।
২০১১ সালে আন্তর্জাতিক তেল-গ্যাস পরামর্শক গুসতাফসন অ্যাসোসিয়েট আর একটি মূল্যায়ন করে। সেখানে ৫০ শতাংশ সম্ভাবনায় বাংলাদেশ অনাবিষ্কৃত গ্যাসসম্পদের গড় পরিমাণ ৫৪ টিসিএফ বলে জানানো হয়। এই মূল্যায়নে ৯০ শতাংশ সম্ভাবনায় ৩৪ টিসিএফ গ্যাস আছে বলে জানানো হয়। ২০১৮ সালে করা গ্যাস খাতের মহাপরিকল্পনায় এই মূল্যায়নকে স্বীকৃতি দিয়েছে পেট্রোবাংলা।